তৃণমূল কংগ্রেসে তারুণ্যের অভিষেক

এবারের বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে একশোর কম আসনে আটকে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারা দেশের গণতান্ত্রিক মানুষের কাছে তাঁর নিজের উচ্চতা অনেকটাই বাড়িয়ে নিয়েছেন। প্রকৃতির নিয়মে কোনও শূন্যস্থানই দীর্ঘস্থায়ী নয়। বিরোধী রাজনীতির পরিসরে কংগ্রেসের নিষ্ক্রিয়তা যত বাড়ছে, ততই বিরোধী জোটের নেতৃত্ব দিতে পারে, জাতীয় স্তরে এমন একটি দলের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। এইখানেই, মোদি-শাহকে গুণে গুণে দশ গোল দিয়ে, তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় ভাবমূর্তি অনেকটাই উজ্জ্বলতর। লোকসভা ভোটের দেরি আছে। তার আগে উত্তরপ্রদেশের ভোট, যা নিয়ে মোদি-শাহের মাথাব্যথা কম নেই। মোদির পছন্দের গুজরাট ক্যাডারের ভিআরএস নেওয়া আইএএস অফিসারকে উপমুখ্যমন্ত্রী পদে বসানোর প্রচেষ্টাকে যেভাবে মোদির মুখের উপর যোগী ‘না’ বলে দিয়েছেন বলে খবর, তাতে বোঝা যাচ্ছে, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় ভাবমূর্তিতে অনেকটাই টোল খেয়েছে প্রধানমন্ত্রিত্বের অষ্টম বছরে।
সারা দেশে মমতার যোগ্যতাই এখন সর্বাধিক
একেবারে সামনেই তৃণমূল কংগ্রেসের ২৯তম ২১ জুলাই। সেই অনুষ্ঠান ব্রিগেডে হবে না ভার্চুয়াল হবে, না অল্প সংখ্যক লোকজন নিয়ে নেতাজি ইন্ডোরে হবে তা নির্ভর করছে আগামী প্রায় এক মাস সময়ে, ‘ফুলস্টপ’ চিহ্নের দশ হাজার ভাগের এক ভাগের সমান জীবাণু, করোনা ভাইরাসকে আমরা কতটা কব্জা করতে পারি ‘দো-গজ-কি-দুরি’, মুখোশ, ভ্যাকসিন আর স্যানিটাইজার দিয়ে, তার উপর। তবে যদি মোটামুটি বড়ো সভাও হয়, তবে বলা যায় সেখান থেকেই সম্ভবত শুরু হবে তৃণমূল কংগ্রেসের দিল্লি চলো কর্মসূচির সলতে পাকানোর কাজ। তার ভূমিকা অবশ্য হয়ে গেল গত ৫ জুন। যেখানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আনা হয়েছে দলের সংগঠনের শীর্ষে। একব্যক্তি-একপদ নীতিতে দলের বর্ষিয়ান নেতা, রাজ্য সভাপতি ৬১ বছরের সুব্রত বক্সী ছাড়লেন সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ। আর সেই দায়িত্ব তৃণমূল সুপ্রিমো তুলে দিলেন ৩৪ বছরের যুবক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঁধে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সিদ্ধান্ত সাহসী, বঙ্গ রাজনীতিতে প্রায় বিরল। সর্ব ভারতীয় স্তরে নয়, কিন্তু রাজ্যস্তরে পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেস বা সিপিএমের দলের সংগঠনের শীর্ষে যখন প্রমোদ দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাস, গনি খান চৌধুরী, সিদ্ধার্থ রায়, প্রণব মুখোপাধ্যায়রা এসেছেন, তখন তাঁরা প্রায় সবাই ৫০ পেরিয়ে গিয়েছেন, অভিজ্ঞতাতেও অনেকটা এগিয়ে। ব্যতিক্রম অতুল্য ঘোষ এবং জ্যোতি বসু। অতুল্য ঘোষ রাজ্য সভাপতি হন ১৯৪৮ সালে ৪৪ বছর বয়সে। আর জ্যোতি বসু রাজ্য সম্পাদক হয়েছিলেন ১৯৫৩ সালে ৩৯ বছর বয়সে।
মমতার মহিলা-মহল
২০১৯ থেকেই প্রবণতাটা শুরু হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য করেছিলেন ৩২ বছরের তরুণ অভিষেককে। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে মোদি-শাহের সেই আক্রমণ সুনামির চেহারা নেয়। ভোটে বিজেপির ভরাডুবি হলেও, দেশের ১ নং এবং ২ নং ব্যক্তির এই আক্রমণের ফলে অভিষেকের একটা সর্বভারতীয় পরিচিতি তৈরি হয়ে গিয়েছে। তৃণমূল বলতে এতদিন সবাই মমতা বুঝতেন। এখন সঙ্গে অভিষেকের নামও বলছেন ভিন রাজ্যের লোকজন।
সোনিয়া গান্ধি অসুস্থ। তিনি এউপিএ চেয়ার পার্সনের পদ ছেড়ে দিতে পারেন, এমন কথা মাঝে মধ্যেই শোনা যায়। তেমন হলে সেই পদে সারা দেশে মমতার যোগ্যতাই এখন সর্বাধিক। তেমন হলে অন্য বিরোধী নেতারাও তাতে বাধা দেবেন বলে মনে হয় না। আরেকটা সম্ভাবনাও আছে। কংগ্রেসকে বাইরে রেখে বিরোধী দলগুলির মধ্যে জোট হতে পারে ২০২৪-এর আগে। আর এই কাজে দলের হয়ে অকংগ্রেসি, অবিজেপি নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালানোর বড়ো দায়িত্ব দলের তরুণ সর্ব ভারতীয় সম্পাদকের উপরেই পড়বে। সেদিক থেকে বলাই যায় অদূর ভবিষ্যতে অভিষেকের জন্য বড়ো পরীক্ষা অপেক্ষা করছে। দলের আরও একটা দায়িত্ব তাঁর উপর পড়েছে। সাংবাদিক সম্মেলন করে তিনি জানিয়েছেন, বাংলার বাইরে দলকে প্রতিষ্ঠা করার কাজ। শালকিয়া প্লেনাম থেকে সিপিএম এই স্বপ্ন দেখেছিল, কিন্তু তিন রাজ্যের বাইরে তারা বেরোতে পারেনি। আপ হয়তো দিল্লির পর ২০২২ সালে পাঞ্জাবেও ক্ষমতায় আসবে, গুজরাটেও পা রাখার মতো জায়গা পেয়েছে, কিন্তু তার বাইরে বেরোতে পারছে না। তৃণমূল কংগ্রেস ২০১১-র পর একবার এই উদ্যোগ নিয়েছিল। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কিছুটা সাফল্য এলেও তা ধরে রাখা যায়নি। ফলে কাজটা অসম্ভব না হলেও খুব কঠিন সন্দেহ নেই। দেখার আছে কী পরিকল্পনা নিয়ে এগোন অভিষেক। রোডম্যাপ কী হবে, তা অবশ্য তিনি ভবিষ্যতে জানাবেন, বলেছেন সাংবাদিক সম্মেলনে।
সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্য যুব সভানেত্রী সায়নী ঘোষ : TMC
তারুণ্য প্রসঙ্গে ফেরা যাক। আর এখানেই, অভিষেকের সঙ্গেই এসে পড়ছে সায়নী ঘোষের নামও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসে যে পদে থেকে মমতা হয়ে উঠেছিলেন, তিনি তাঁর নিজের দলে সেই পদে, যুব সংগঠনের সভানেত্রীর পদে, নিয়ে এসেছেন মাত্র ২৮ বছর বয়সী সায়নী ঘোষকে। রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা যদি বলতে হয় তা হলে তাই। কিন্তু এই যে দলের সংগঠনের দায়িত্ব এবং যুব সংগঠনের দায়িত্ব দু’জন কম বয়সির কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হল, এটাকে এক কথায় বলা যায়, তৃণমূল কংগ্রেসে তারুণ্যের অভিষেক হল। ২০১৪-তে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে জাতীয় স্তরে বেশ কয়েক জন সম্ভাবনাময় তরুণ নেতা-নেত্রী উঠে এসেছেন বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে । কানহাইয়া কুমার, উমর খলিদ, জিগনেশ মেভানি, সাফুরা জারগর, হার্দিক প্যাটেল, সহেলা রশিদ এমনই কয়েকটি নাম। বাংলায় আমরা এই জিনিসটা দেখতে পাচ্ছিলাম না। এবারের বিধানসভা ভোটে দেখা গেল প্রায় প্রথা ভেঙে সিপিএম ঐশী ঘোষ, দীপ্সিতা ধর, সৃজন ভট্টাচার্য, প্রতীক উর রহমান, মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়-সহ বেশ কয়েক জন তরুণ তরুণীকে প্রার্থী দাঁড় করাল। তাঁরা হয়তো জিততে পারেননি। কিন্তু তাঁরা রাজনীতিতে থাকবেন বলেই মনে হয়। সেদিক থেকে দেখলে বাংলায় তারুণ্যের অভিষেকের সেটাই ছিল শুরু। আগামী দশ বছরে বাঙালির রাজনীতির খোল-নলচে পাল্টে দিতে পারে এই কম বয়সীরা। বোঝা যাচ্ছে এটা সময়েরও দাবি। কোনও দলের পক্ষেই এই দাবি অস্বীকার করা সম্ভব হচ্ছে না।
যুব সংগঠনে সভানেত্রীর পদে ২৮ বছর বয়সী সায়নী ঘোষ
আরও পড়ুন: বাংলার ভোটে বাঙালির ঐতিহাসিক ভূমিকা
তরুণ নেতা হিসেবে তেজস্বী যাদব, জগনমোহন ইতিমধ্যেই সারা দেশে পরিচিত নাম। তাঁরা যে যোগ্য সে প্রমাণও তাঁরা ইতিমধ্যেই দিয়েছেন। অন্যদিকে, ১৯৭৭-এ কংগ্রেস বাংলায় পরাজিত হওয়ার পর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাদ দিলে কংগ্রেস কোনও উল্লেখযোগ্য তরুণ নেতা এই রাজ্যকে দিতে পারেনি। এবং কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়াতেও পারেনি সম্ভবত এই কারণেই। সিপিএম-এ এক সময়ে প্রমোদ দাশগুপ্ত বিমান বসু , বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের সামনে এগিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর একে সামনে এগিয়ে দেওয়া হয়েছিল সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তী, অনিল বিশ্বাসদের। তার সুফল সিপিএম হাতে হাতে পেয়েছে। যদিও শৈলেন দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাসরা চেষ্টা হয়তো করেছেন, কিন্তু নতুন তরুণ নেতৃত্ব তৈরি করতে খুব একটা সফল হননি। এত দিনে সেই সংকট থেকে দল বেরোনোর চেষ্টা করছে। ফলে বলাই যায়, তৃণমূল কংগ্রেস যেভাবে দলে তারুণ্যকে গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটা তাদের দূরদৃষ্টিরই প্রমাণ। বাকিটা ইতিহাস।