২০১৭ ছিল গোরুর বছর

বিদায় নিচ্ছে ২০১৭। এক কথায় বলা যায়, এই বছরটা ছিল গোরুদের বছর। এই একটি বছরে খবরের কাগজে ‘গোরু’ শব্দটা যে কত হাজার বার লেখা হয়েছে তার কোনও হিসেব নেই। অনেক রাজনৈতিক নেতাকেই এ ব্যাপারে হারিয়ে দেবে গোরুর দল। শোনা যায় এক সময় ঘোড়াদের খুব কদর ছিল রাজনীতিতে। মানে যুদ্ধে-টুদ্ধে! আর্যরাও নাকি ঘোড়ায় চেপে এসেছিল। ঘোড়াদের সে সুখের দিন অনেক কাল আগেই গিয়েছে। এখন গোরুদের যুগ। মাত্র কয়েক দিন আগেও দেখা গেল কর্ণাটকের বিরাট গোঁফওয়ালা এক ‘গবাদি-নেতা’ বলছেন, মুরগি খাও, ছাগল খাও, পাঁঠা খাও, হাঁস খাও, ব্যাঙ খাও, আরশোলা খাও কিন্তু খবরদার, গোরু মেরে খেয়েছ কী খতম করা হবে। শোনা যাচ্ছে এই রাজ্যে ওরা ক্ষমতায় এলে নাকি কলকাতার নাম বদলে রাখা হবে ‘গো-লকাতা’।

তা বলে কী এই বছরে ভালো কিছুই হয়নি? তা কিন্তু হয়েছে। তবে তার বেশির ভাগটাই অবশ্য হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আঙিনায়। উত্তরপ্রদেশের এক মুসলিম মহিলার আবেদনে সাড়া দিয়ে তাৎক্ষণিক তিন তালাক বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্ট। সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে সংসদে বিল এনে আইন করতে। মোদী সরকার সেটা করেছে। শাহবানু মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আদেশ পালটে দিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী, মোদী তা করেননি। যদিও খাদিজা বানুর মতো মুসলিম নেত্রী, যারা মুসলিম মহিলাদের অধিকারের জন্য দীর্ঘ কাল ধরে লড়াই করছেন, তাদের মতে, এটা সিন্ধুতে বিন্দু। ভারতীয় মহিলাদের অধিকারের বিচারে মুসলিম মহিলারা এখনও অনেক পিছিয়ে। তবে একটা শুরু তো হল, সেটা কম ভালো নয়!
মোদী সরকার চায়নি, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বলেছে ‘প্রিভেসি’ মানে ‘ব্যক্তিগত পরিসর’, সেটা ‘ফান্ডামেন্টাল রাইট’। ২০১৭ সালে এটাও ভারতবাসীর একটা বিরাট জয়।
এই বছর আরও একটা লক্ষণীয় বিষয় হল মোদী সরকারের পিছু হটা। ব্যাপারটা খুলে বলি। মোদী সরকারের সাড়ে তিন বছর অতিক্রান্ত। আর দেড় বছর বাকি। ভোটের আগে বা ম্যানিফেস্টোতে কখনও প্রধানমন্ত্রীর দল, মানে বিজেপি বলেনি যে তাদের টার্গেট সরকারের ৫ বছরের মেয়াদ নয়, অর্থাৎ ২০১৯ সাল নয়। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর, ২০২২ সাল হচ্ছে তাদের লক্ষ্য। প্রথম কথা হল ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে এই দলটার কোনও সম্পর্কই নেই। বিজেপির তখন জন্মই হয়নি। আর ‘আর এস এস’ নামের এই সংগঠনটির স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনও ভূমিকাই ছিল না। ক্ষুদিরাম, ভকৎ সিংদের ছায়ার থেকেও তারা একশো মাইল দূরে দূরে হেঁটেছে। এখন হঠাৎ তারা ‘গোরু-প্রীতি এবং পাকিস্তান বিরোধিতা’র মাপকাঠিতে নতুন এক জাতীয়বাদের জন্ম দিয়ে নিজেদের সব থেকে বড় দেশপ্রেমিক বলে দাবি করতে শুরু করেছে। সে যাই হোক, মোদী সরকারের যে পিছিয়ে আসার কথা হচ্ছিল, সেটা এরকম। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, নীতিন গড়করি, প্রকাশ জাভরেকররা গত ছ’মাস ধরে বলতে শুরু করেছেন ২০১৯ নয়, ২০২২ সালের মধ্যে দেশের সব গরিবের বাড়ি হবে। সবার বাড়িতে বিদ্যুৎ এসে যাবে। সবার চাকরি হবে, ভারত প্রায় ইওরোপের দেশগুলির মতো উন্নত দেশে পরিণত হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী যে বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় এলে কৃষকের রোজগার বাড়বে, ফসলের ‘সাপোর্ট প্রাইস’ দেড়গুণ হবে, ২ কোটি চাকরি হবে, কালো টাকা ফিরিয়ে এনে গরিবদের ব্যাঙ্ক অক্যাউন্টে ভরে দেওয়া হবে, দেখা যাচ্ছে এই কথাগুলো তাঁরা আর বলছেন না। তাঁরা সবাই এখন বলছেন, সব নাকি হবে ২০২২ সালের মধ্য। অর্থাৎ খেলতে খেলতে হঠাৎ গোল পোস্টটা কখন যে তিন বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে অনেকের চোখেই পড়েনি। ২০১৭ তে এটা একটা বড় ‘পাওনা’।
ভোটে দুর্নীতি বা কারচুপি নিয় অভিযোগ ভারতে নিয়মিতই ওঠে, আমেরিকার মতো আধুনিক দেশেও ওঠে। এই ধরনের কারচুপি নির্মূল করতে এক বিরাট নিবাচনী সংস্কার করে ফেলল ভারতের নির্বাচন কমিশন এই ২০১৭ তে-ই।পাকিস্তানে গিয়ে শুনেছিলাম, সে দেশের এক বিশিষ্ট সাংবাদিক বলেছিলেন, পাকিস্তানের অন্যতম দুর্বলতা হল, তারা ভারতের মতো একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন তৈরি করতে পারেনি। ইভিএম নিয়ে কারচুপির অভিযোগ করছিলেন আপ, বিএসপি, এসপি, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা। সেই ‘দুর্নাম’ রুখতে এ বছরর গুজরাটের বিধানসভা ভোটে এভিএম-এর সঙ্গে রাখা হয়েছিল ভি ভি প্যাট (Voter Verifiable Paper Audit Trail)। ৫০,১২৮টি বুথেই এই ব্যবস্থা ছিল। এই প্রথম একটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটের সব বুথে ভি ভি প্যাট দেওয়া হল। এই মেশিন ভোটারের ভোট দানের একটি হার্ড কপিও রেখে দেয়। ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ওই হার্ডকপি ব্যালট দেখা হবে। এটি ভোট দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা বড় পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

সাংবাদিক গৌরী লংকেশ খুন হয়েছেন এই বছরেই। এই হত্যায় অনেকেই তাদের খুশি গোপন রাখতে পারেননি।কেউ টুইট করে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। কেউ প্রকাশ্যে। সবাই তা দেখেছে। লঙ্কেশের আগেও ইসলামিক মৌলবাদের বিপরীত শক্তি হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলে বেশ কয়েক জন বুদ্ধিজীবী খুন হয়েছেন। মোদি সরকারকে খুব বিচলিত মনে হয়নি এই সব খুনের ঘটনায়।
বিশ্বহিন্দু পরিষদের নেতা সুরেন্দ্র চৌহান এই বছরই ঘোষণা করেছেন, ২০১৮ সালের অক্টোবরে অযোধ্যায় রাম মন্দির গড়ার কাজ শুরু হবে। এই রাম মন্দির আন্দোলনকে ঘিরে কত জন ভারতীয়ের মৃত্যু হয়েছে তার একটা শ্বেতপত্র প্রকাশের সময় বোধহয় এসে গে্ছে। আরও কত মৃতদেহ দেখতে হবে কে জানে!

২০১৭ সালকে মনে রাখতে হবে সিনেমার উপর শাসক দলের খবরদারির জন্য। ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখায় পতিতালয়ে যাঁকে খুঁজে পেল দাদা তার নাম ছিল সীতা। আজকের দিনে ঋত্বিক ওই ছবি করলে হিন্দুত্ববাদীরা হলে আগুন লাগিয়ে দিত।

২০১৭-এর আর একটি বড় ঘটনা হল, ডিমনিটাইজেশন বা বিমুদ্রায়ণের পর দেখা গেল প্রায় সব টাকাই ব্যাঙ্কে ফিরে এল। অর্থাৎ কালো সব টাকাই সাদা হয়ে গিয়েছে। প্রশ্ন উঠে গেল, বিমুদ্রায়ণে এবং নতুন নোট ছাপতে যে বিপুল খরচ হল, যদি কালো টাকা ধরাই না গেল, তা হলে কি এই খরচ যুক্তি সঙ্গত?

২০১৭-এর আর একটি বড় ঘটনা, রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হলেন। একই সঙ্গে বলতেই হবে, পশ্ছিমবঙ্গে বামপন্থীরা এবং কংগ্রেস প্রায় অপ্রাসঙ্গিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। আর হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির কিছুটা শক্তি বৃদ্ধি।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সব থেকে বড় বেদনার খবর হল একদা মানবাধিকারের প্রতীক মিয়ানমারের সুচির হাতে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা বিতারণ, হাজার হাজার রোহিঙ্গার মৃত্যু। ডোনাল্ড ট্রাম্প, উত্তর কোরিয়া চিন গত এক বছরে যে ভাষায় কথা বলেছে, তা দেখে মানুষের খুশি হওয়ার কোনও কারণ নেই। বছরের শেষে জেরুজালেম ঘিরে নতুন রক্তপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইতিমধ্যেই সেখানে বেশ কয়েক জন প্যালেস্তাইন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে ইসরায়েলি সেনার গুলিতে। হতাশার কথা এটাও, একদা জনতার নেতা জিম্বাবোয়ের রবার্ট মুগাবেকে পদ ছাড়তে হল হাজার রকম দুর্নীতির অভিযোগে।
তাহলে কী পেলাম এই বিদায়ী বছরে? যে কোনও ভারতবাসী এই প্রশ্নটা করতেই পারেন, সুপ্রিম কোর্টের কয়েকটি রক্ষা কবচ ছাড়া প্রাপ্তির তালিকায় বলার মতো তেমন কিছু রইল কি?