শংকরের ‘চৌরঙ্গী’ নাকি ‘অশিক্ষিতের উপন্যাস’, যদিও স্যাটা বোসকে ভুলল না বাঙালি

মণিশংকর মুখোপাধ্যায়, আপামর পাঠকদের কাছে তিনি শংকর নামেই পরিচিত। তাঁর কলমেই সৃষ্ট হয়েছে স্যাটা বোস, মার্কো পোলো, মিসেস পাকড়াশি, সুজাতা মিত্ররা। শংকরের জন্ম বাংলাদেশের যশোরে হলেও বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে আসেন পশ্চিম বাংলার হাওড়ায়। এই শহরেই বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা এবং লেখালেখির শুরু। যুবকবয়স খুব একটা সুখের ছিল না। আজীবন লিখতে চাওয়া এই মানুষটি কখনও ফেরি করেছেন, টাইপরাইটার ক্লিনারের কাজ করেছেন, প্রাইভেট টিউশানি করেছেন, আবার কখনও জুট ব্রোকারের কেরানিগিরিও করেছেন। তারপরেই শংকরের সঙ্গে আলাপ হয় এক ইংরেজের। যাঁর অনুপ্রেরণায় শুরু করেন লেখালেখি।
চৌরঙ্গী (১৯৬৮)
আজীবন লিখতে চাওয়া এই মানুষটি কখনও ফেরি করেছেন, টাইপরাইটার ক্লিনারের কাজ করেছেন, প্রাইভেট টিউশানি করেছেন, আবার কখনও জুট ব্রোকারের কেরানিগিরিও করেছেন। তারপরেই শংকরের সঙ্গে আলাপ হয় এক ইংরেজের। যাঁর অনুপ্রেরণায় শুরু করেন লেখালেখি।
শংকরকে আমরা আজীবন মনে রাখব ‘জন অরণ্য’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘কত অজানারে’, ‘স্থানীয় সংবাদ’, কিংবা ‘চৌরঙ্গী’র জন্য। ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসের জন্য তিনি অমর। এখনও এই শহরে স্যাটা বোস যে কোনো তরুণের কাছেই বড়দার মতো। যাকে ঘিরে বা যার সঙ্গে মিশে সারাটা জীবন বাঁচা যায়। সেই স্বপ্নের চরিত্রকে কীভাবে খুঁজে পেলেন শংকর? এক সাক্ষাৎকারে সেই প্রসঙ্গে নিজেই জানাচ্ছেন, “ইস্টার্ন রেলওয়েতে এক ভদ্রলোক ছিলেন। তাঁর নাম ছিল সত্যসুন্দর বসু। আমি তখন ওখানে চাকরি করি। তিনি সাহেবদের সঙ্গে খুব মিশতেন। স্কাউটিং করতেন। স্মার্ট লোক ছিলেন। কায়দা করে ইংরেজি বলতেন। সব সময় বলতেন আমার নাম স্যাটা বোস। খুব পপ্যুলার ফিগার ছিলেন। আমি অবশ্য দূর থেকে দেখেছি। অতটা আলাপ ছিল না। আবার স্পেনসেস হোটেলে একজনকে পেয়েছিলাম, যিনি পরে গ্রেট ইস্টার্নে চলে যান। তাঁর মধ্যে একটা অভিভাবক সুলভ ব্যাপার ছিল। তাঁরও ধারণা ছিল ওঁকে ভিত্তি করে লিখেছি।”
সীমাবদ্ধ (১৯৭১)
‘চৌরঙ্গী’র প্রেক্ষাপট ১৯৫০ সালের কলকাতা। উপন্যাসের কথক একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবক। এক ইংরেজ ব্যারিস্টারের কাছে সচিবের চাকরি করত। কিন্তু সেই ব্যারিস্টারের অকালমৃত্যুর পর সে বেকার হয়ে পড়ে।
আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই হয়তো স্যাটা বোসেরা আছেন তাঁদের নিজস্ব ভঙ্গিমায়। ‘চৌরঙ্গী’র প্রেক্ষাপট ১৯৫০ সালের কলকাতা। উপন্যাসের কথক একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবক। এক ইংরেজ ব্যারিস্টারের কাছে সচিবের চাকরি করত। কিন্তু সেই ব্যারিস্টারের অকালমৃত্যুর পর সে বেকার হয়ে পড়ে। দরজায় দরজায় ঘুরে নিউজপেপার বিক্রির পেশা গ্রহণ করতে হয়। একদিন বন্ধু বায়রন শহরের সবচেয়ে পুরোনো ও খ্যাতনামা হোটেল শাহজাহানে একটি কাজ জোগাড় করে দেয়। সেই হোটেলের চিফ রিসেপশনিস্ট স্যাটা বোস। কিছুদিন টাইপিস্টের কাজ করার পর সে স্যাটা বোসের প্রধান অ্যাসিস্ট্যান্ট হয় এবং হয়ে ওঠে স্যাটা বোসের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তি। কলকাতার উচ্চবিত্ত সমাজের খানিক কুৎসিত একটি দিক তুলে ধরেন শংকর। সমাজের লোভ, অপকর্ম ও লজ্জাজনক ব্যবহার প্রথম দিকে সেই যুবককে অবাক করেছিল। অচিরেই এই সবে সে ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে উঠল। আর উপন্যাসের কেন্দ্রে রইল প্রেম। ১৯৬৮ সালে পরিচালক পিনাকী ভূষণ মুখোপাধ্যায় চলচ্চিত্রের আকার দেন এই উপন্যাসটিকে। সেখানে অভিনয় করেন উত্তমকুমার, সুপ্রিয়াদেবী, অঞ্জনা ভৌমিক, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
জন অরণ্য (১৯৭৬)
‘চৌরঙ্গী’ প্রসঙ্গে শংকর বলেছেন, “প্রথম দিন থেকেই শক্তিমানদের নাক-উঁচু ঘেন্না। প্রথম দিন থেকেই সমালোচনা যে রেস্টুরেন্ট আর রেস্তোরাঁর তফাৎ বোঝে না, সে লিখেছে হোটেল নিয়ে বই। এক নামী লেখিকা ‘দেশ’-এর সম্পাদককে চিঠি পাঠালেন ‘অশিক্ষিতের উপন্যাস’ অভিযোগ করে। বললেন, যে লোকটা ‘ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট’-এর সঙ্গে ‘বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট’-কে গুলিয়ে ফেলতে পারে সে লিখেছে হোটেল নিয়ে বই। পাঠকরা যেমন ঢেলে দিয়েছেন, সমালোচকেরাও তেমনই ঢেলে আক্রমণ করে গেছেন। মানুষ বলে কেউ মনে করেনি। কোনও পুরস্কার দেয়নি। ভুল বললাম। একটা পুরস্কার ‘চৌরঙ্গী’ পেয়েছিল। শ্রেষ্ঠ বাইন্ডিং-য়ের জন্য।”
শংকরের দুটি গল্প নিয়ে কাজ করেছেন পরিচালক সত্যজিৎ রায় – ‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১) এবং ‘জন অরণ্য’ (১৯৭৬) [কলকাতা ত্রয়ীর অন্যতম দুটি ছবি। যেখানে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসাবে ‘সীমাবদ্ধ’ পেয়েছিল জাতীয় পুরস্কার।] শংকর এখনও যে কথাটি বিভিন্ন জায়গায় বলে থাকেন, সেটা হল সত্যজিৎবাবুই তাঁকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।
শংকর লিখিত চৌরঙ্গী উপন্যাস (দে'জ পাবলিকেশন)
এই এতকিছুর পরেও শংকর ঝেড়ে ফেলতে পারেননি ‘ওয়ান বুক অথার’-এর তকমা। অন্যান্য সাধারণ মানুষরা মৃত্যুর পর মরে যান, কিন্তু লেখক-শিল্পীদের মরণ নেই। সমস্ত বিতর্ক উস্কে শংকর বাঙালি পাঠক সমাজে থেকে যাবেন ‘বেস্টসেলার’ হয়ে। শংকর বলেন, “মৃত্যুর পর পাঁচটা বছর আমার পরীক্ষা”। ...সংসারে যে যত বেশি থাকবে, যে যত বেশি দেরি করবে তাকে তত বেশি বিল মিটিয়ে যেতে হবে।”
____
সাক্ষাৎকার ঋণঃ আনন্দবাজার পত্রিকা/ ‘জীবনটাই তো একটা চৌরঙ্গী’/ সাক্ষাৎকার গ্রাহক গৌতম ভট্টাচার্য