রাইটার্স বিল্ডিঙের কেরানি মানেই নবাব হওয়ার ছাড়পত্র

কেরানির জীবন নিয়ে আমাদের সমাজজীবনে গালিগালাজ কিছু কম নেই। ‘শুধু কেরানি’, ‘মাছি-মারা কেরানি’, ‘হরিপদ কেরানি’- লিস্টি বিশাল। অথচ একদা ব্রিটিশ-ঘরের ছেলেপুলের জীবনের স্বপ্নই ছিল কেরানি হওয়া। একবার কেরানি হতে পারলেই নবাব হওয়া আর কেউ ঠেকাতে পারত না। কেরানিগিরিকে তখন গাল দেয়, কার সাধ্যি! কথাটা অবিশ্বাস্য ঠেকলেও, ধ্রুব সত্য। ইংল্যান্ডবাসী তরুণের কাছে কলকাতায় রাইটার হয়ে আসা মানেই ছিল প্রচুর প্রচুর নগদ টাকা ওড়ানোর সুযোগ। নবাবি চালে, নবাবি আদবকায়দায় জীবন কাটানোর বেলাগাম ছাড়পত্র। দেশে ফেরার সময়ও পকেট উপচানো টাকা। সে দেশের নামিদামিদের পুত্ররাও পর্যন্ত কেরানি হওয়ার লাইনে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াত। আজকের মহাকরণ সেইসব মহার্ঘ কেরানিগিরির জীবন্ত সাক্ষী।
আরো পড়ুন
বেলভিডিয়ার এস্টেট ও আলিপুরের ভূত
বিলেত থেকে কলকাতার মাটিতে পা রাখলেই নাকি রাইটাররা বাড়ির খোঁজ করত। কেতাদুরস্ত বাংলো বাড়ি। সাহেবি সুযোগসুবিধা সেখানে থাকবেই। আর সঙ্গে থাকবে গণ্ডা গণ্ডা ভৃত্য। হুকোবরদার, খিদমতগার, বাবুর্চি, খানসামা, পালকিবাহক, পাখাকুলি। সবমিলিয়ে ভৃত্যের সংখ্যা পৌঁছে যেত পঁচিশ-তিরিশে। একজন সাহেবের পেছনে এতজন ভৃত্য। তাদের বাবুয়ানি তখন দেখে কে। আর এদেশে তো সেই আদ্যিকাল থেকেই শ্রমের মূল্য বড়ো সস্তা। ভৃত্যবর্গও সস্তায় খেটে দিত সাহেব-অন্দরে।
কিন্তু কোম্পানির কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হলেন কেরানিদের এই বাবুয়ানিতে। এত সুবিধে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে খুব রূঢ় হলেন না তারাও। একে তো শীতল লন্ডন থেকে আগুনে কলকাতায় এলেই মৃত্যুদোষ জাঁকিয়ে ধরত। মন্বন্তর আর মারী নিয়ে ঘর-করা এদেশীয়দের সয়। ব্রিটিশদের তা মোটেই সইত না। তা এইসব ভেবে কোম্পানি ঠিক করল গঙ্গার পাড়ে তৈরি হবে ব্রিটিশ সিভিলিয়নদের বাড়ি। কলকাতায় পা-রেখে প্রথম একবছর থাকতে হবে সেখানে। বিশেষ করে যাদের বেতন তিনশো টাকার কম, তাদের ওখানেই থাকতে হবে।
সত্যি বলতে কী, ব্যবস্থা যা হল, আমাদের আজকের খাঁচাফ্ল্যাটের কাছে তা রাজকীয়। গঙ্গার পাড়ে এই জমিটি লিজ নেওয়া হয়। আর তারপর ১৭৭৬ সাল নাগাদ টমাস লায়ন্স ১৯টি ফ্ল্যাট তৈরি করেন রাইটার্স বিল্ডিঙের ভেতর। একেকটি ফ্ল্যাট সেখানে একেকটি বাড়ির মতো। রাইটারদের আনন্দের শেষ নেই। তাদের বিলাসিতাতেও কমতি হল না। চাকরবাকর নিয়ে ভরা সংসার। কিন্তু তারপরেই নিয়ম বদলাল। ঠিক হল, রাইটাররা চাকর রাখতে পারবেন মাত্র দু’জন। বাবুর্চি থাকবে একজন, আর হ্যাঁ, কোনোরকম ব্যয়বহুল সাজপোশাক চলবে না। বাগানবাড়িতেও বসল নিষেধাজ্ঞা।
আরো পড়ুন
কলকাতার পুরোনো দোলের গল্প
তবে, রাইটাররা তাতেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। একবছর পেরোলে তাদের মাইনে বাড়ে। তারা ফ্যাক্টর হয়। ব্যস রাইটার্স বিল্ডিংকে টাটা করে তারা বেরিয়ে পড়ে বাড়ির খোঁজে। তারপর জুনিয়র থেকে সিনিয়র মার্চেন্ট - আর তারপর যেমন ইচ্ছে বিচরণ। কেরানি হয়ে জীবন শুরু করে নবাব হয়ে দেশে ফেরে তারা। পকেট আতপ্ত হয়ে থাকে তিরশ-চল্লিশ হাজার পাউন্ডে।
স্বাভাবিকভাবেই, এমন কেরানি জীবন ক্রমশ কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে ব্রিটিশদের কাছে। কেরানি তালিকা থেকে বাদ যেতে থাকে মধ্যবিত্তরা। ব্যাঙ্কার, যাজকপুত্র, ব্যারনপুত্রেরা জায়গা দখল করে। ১৮৫৫-তে এডমিশন টেস্টও শুরু হয়। সেখানেও নামজাদাদের ভিড়। শোনা যায়, ইংল্যান্ডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী মিসেস সিডনের ছেলে জন সিডন এদেশে আসতে চেয়েছিলেন রাইটার হয়ে। কিন্তু প্রথম সুযোগ মিস হয়ে যায়। তারপর ইংল্যান্ডের রাজবাহাদুর ব্যাকিং দেন।
আরো পড়ুন
পাজি ‘সঙের দল’ আর সেকেলে কলকাতা
মোদ্দা কথা, ইংল্যান্ডে অভিজাত মহলে ঘোরাফেরা করতে চাইলে, সবথেকে সহজ রাস্তা ছিল কলকাতা বা মাদ্রাজে রাইটার হয়ে চলে আসা। লাইফটাইম সেটেলমেন্টের এমন সুন্দর সুযোগ আর ছিল না।
আমাদের দিশি কেরানিরা নিশ্চিত এসব কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। কেরানি বলে পদমর্যাদা আর অর্থমর্যাদা - দুইই কম। তাদের আর অভিজাত হওয়া চলে না। যাইহোক, আজকের মহাকরণে আর মহাকারণিকদের দেখা মেলে না। ইমারতের মেরামতিতে তারা চলে গেছে গঙ্গার ওইপারে। প্রাচীন রাইটারদের রোমান্টিক কল্পনার আঁতুরঘর এই সুপ্রাচীন বাড়িটি। তার অন্দর-বাহিরেও এসেছে দেদার বদল। বিলিতি রাইটারদের প্রবাসজীবনের গল্পগুলো নেহাতই আজ রূপকথা।