No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    কাঠের দরজায় খোদাই করা পদ্ম-ময়ূর-দেবদেবী, বিস্মৃত হয়েও বিস্ময় বাংলার দারুশিল্প

    কাঠের দরজায় খোদাই করা পদ্ম-ময়ূর-দেবদেবী, বিস্মৃত হয়েও বিস্ময় বাংলার দারুশিল্প

    Story image

    পুরোনো বাংলার কাঠের কাজ বা দারুশিল্প বাঙালির এক অনালোচিত অবহেলিত রত্ন। কাঠের গায়ে তক্ষণ করে নিপুণ দক্ষতায় শিল্পী ফুটিয়ে তোলেন কারুকার্য। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের গঙ্গারিডির কাঠের চিরুণি ও স্তম্ভে নর্তকী, তৎকালীন বাঙালি নরনারী, মাতৃমূর্তি, ময়ূর, হাতি, পদ্মবন প্রভৃতির নিপুণ চিত্রায়ন দেখতে পাই আমরা। শিলামূর্তির থেকে কাঠের মূর্তি বা কাঠের কাজের স্থায়িত্ব কম। অগ্নিদগ্ধ হয়ে বা অন্য কারণে ধ্বংসের আশঙ্কাও বেশি। তাই পাল ও সেনযুগের বাংলায় যে পরিমাণে ভাস্কর্যের নিদর্শন মিলেছে; দারুশিল্পের নিদর্শন সে তুলনায় বেশ কম। এযাবৎ পালযুগের চারটি দারুবিগ্রহের নিদর্শন পাওয়া গেছে। প্রথমটি তারা মূর্তি, নবম শতাব্দীর। দ্বিতীয়টি স্থিরচক্র মঞ্জুশ্রীর। তৃতীয়টি প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে প্রাপ্ত একটি অধুনালুপ্ত বিহারগাত্রে উৎকীর্ণ সুরসুন্দরীর। আর চতুর্থটি লোকনাথ অবলোকিতেশ্বরের।

    পঙ্খে প্রায়শই দেখা যেতো সপ্তডিঙার অবয়ব, হংস ময়ূরের দেহভঙ্গি। কাঠের দরজায় খোদাই করে আঁকা হতো পদ্ম, লতা, ময়ূর, দেবদেবী, কৃষ্ণলীলা, মহিষমর্দিনী সহ আরও কতো কী।

    অন্যদিকে মধ্যযুগের বাংলায় দারুশিল্পের অনেক নিদর্শন মিলেছে। এবং সেই সমস্ত শিল্পকর্ম শুধু মন্দির বা বড়ো ভবনে সীমাবদ্ধ ছিল না। পল্লীবাংলার সাধারণ সম্পন্ন গৃহস্থের খড়ের চালের কাঠের পঙ্খ থেকে দোতলা মাটির বাড়ির রেলিংয়ের স্তম্ভ, সদর থেকে খিড়কি দরজা সর্বত্র কাঠের শিল্পীরা নিজেদের অসামান্য দক্ষতার নিদর্শন রেখে গিয়েছেন। পঙ্খে প্রায়শই দেখা যেতো সপ্তডিঙার অবয়ব, হংস ময়ূরের দেহভঙ্গি। কাঠের দরজায় খোদাই করে আঁকা হতো পদ্ম, লতা, ময়ূর, দেবদেবী, কৃষ্ণলীলা, মহিষমর্দিনী সহ আরও কতো কী।

    আজও পল্লীবাংলায় প্রায়শই ধ্বংস হতে বসা মাটির বাড়িতে চোখে পড়ে এমন সুচারু কাঠের কাজের নিদর্শন। যা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। পুরোনো দিনের মাটির বাড়ির দরজার কারুকার্য এবং পঙ্খের কাজ নিয়ে বেশ কিছু মূল্যবান গবেষণাও হয়েছে। মাটির বাড়ির কাঠের থাম বা স্তম্ভের কারুকার্যও কখনও কখনও চমকে দেওয়ার মতো শৈল্পিক দক্ষতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে। তেমনই এক নিদর্শন চোখে পড়ল মুর্শিদাবাদের আলুগ্রামের এক পরিত্যক্ত দোতলা মাটির বাড়ির উপরের তলার রেলিংয়ে। সারিবদ্ধ রেলিংয়ের সারি ধরে আছে কাঠের থাম। থামের মাঝে সমদূরত্বে  খোদিত দুটি পদ্ম। যেন থাকে থাকে উঠে যাচ্ছে ক্রমশঃ; পাঁকের গর্ভ থেকে আকাশের দিকে। এই কাঠের কাজ করেছিলেন গ্রামেরই কোনো সূত্রধর; কম বেশি একশো বছর আগে। নির্মাণশৈলী পাল সেনযুগের পদ্মের মোটিফের সাথে আশ্চর্য সাদৃশ্য বহন করে।

    প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পালযুগের অধিকাংশ বিগ্রহে পদ্মের উপস্থিতি অনিবার্য ছিল। এই পদ্ম সমগ্র চরাচরের প্রতীক; যার ভাব সাধক ধারণ করেন হৃদয়ে। তাঁর সাধনায় সেই পদ্মে মহাকরুণার প্রকাশ রূপে আবির্ভূত হন তাঁর ইষ্ট; কখনও তারা বজ্রযোগিনী কখনও আবার লোকনাথ রূপে। এই পদ্মকে তাই সাধনক্রমে বলা হতো বিশ্বপদ্ম বা জগদ্দল। এই মাটির বাড়ির কাঠের কাজে খুঁজে পাওয়া গেল পালযুগের ভাস্কর্যে ফুটে ওঠা বিশ্বপদ্মের পাপড়ির সেই বক্রতা; সেই সূক্ষ্ম পরিসমাপ্তি। যে জগদ্বিখ্যাত ভাস্করগণ আজ থেকে হাজার বছর আগে আর্যতারা কিম্বা লোকনাথের অধিষ্ঠানের জন্য বিশ্বপদ্ম ফুটিয়েছিলেন কঠিন পাষাণের গায়ে আর যে গ্রাম্য তথাকথিত অশিক্ষিত সূত্রধর কাঠের গায়ে পদ্ম এঁকেছিলেন; তাঁদের মনোজগত এত কালের ব্যবধান হেলায় নস্যাৎ করে দিয়েছে। এইই হচ্ছে এক জাতির শিকড়। তাকে বিস্মৃত হওয়া যায়; অবহেলাও করা যায়; তবে লুপ্ত করা যায় না।

    বিশেষ দ্রষ্টব্য: তুলনা করার জন্য পালযুগের দেবী পর্ণশবরীর একটি বিগ্রহের পাদপীঠের বিশ্বপদ্মের ছবি থাকল প্রতিবেদনের সঙ্গে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @