No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ইতিহাসের ধুলোয় ঢাকা চিৎপুরের কাঠখোদাই শিল্প

    ইতিহাসের ধুলোয় ঢাকা চিৎপুরের কাঠখোদাই শিল্প

    Story image

    সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা-কাহিনি ‘গোরস্থানে সাবধান’-এ  জটায়ু তোপসেকে বলেছিলেন, ছোটোবেলা কবিতায় তিনি পড়েছেন “Dust thou art to dust returnest”। আমরা অনেকই বিখ্যাত মানুষদের শিল্প নিয়ে ভাবি। তাঁদের অপূর্ব সব কাজ আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্ত বাংলার নিজস্ব শিল্পে যে বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে, সেই ঐতিহ্যকে হয়তো আমরা ভুলে যাই। যেন সেসব ধূসর হয়েই জেগে থাকে। আধুনিক প্রজন্মের কাছে উপেক্ষিত হয়ে আমাদের কৃষ্টি অচিরেই হারিয়ে যায়। তবে তথাকথিত আজকের নাগরিক সমাজ এগিয়ে আসছেন এই দেশীয় শিল্প সংস্কৃতিগুলিকে রক্ষা করতে। মেনে নিতে হয়, কিছুজনের মধ্যে আজও এক উদাসীন ভাব রয়েছে যার জেরে এক শ্রেণির ঐতিহ্যের প্রতি চেতনা অনেকটাই কমে গিয়েছে। একসময় ইংল্যান্ডের ধনী পরিবারগুলিতে এখানকার স্বদেশী শিল্পগুলি নিয়ে আড্ডা জমে উঠত। এখনও সেই অবস্থা খুব একটা বিশেষ পাল্টে যায়নি।

    চিৎপুর রোড

    কলকাতার সুপ্রাচীন ও প্রথম পিচের রাস্তা চিৎপুর। অতীতে ব্যবসায়ীরা এই অঞ্চলে এসে ভিড় করতে শুরু করলে ক্রমে হোগলা পাতার ছাউনি সরে গিয়ে সেইখানে বড়ো অট্টালিকা গড়ে উঠতে থাকে। পাশাপাশি কাঠখোদাই শিল্প এই স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। গরানহাটা অঞ্চলে নদী পথে আসতো কাঠ আর সেই কাঠ নিয়ে যেতেন কারিগররা। তারপর তাঁদের হাতের ছোঁয়ায় তৈরী হতো অসাধারণ সব কাঠখোদাই। চিৎপুরের কাঠখোদাই শিল্প কলকাতার নিজের একটি আর্ট যা হয়ত সময়ের সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে। তবু এই শিল্পকর্ম বাঙালি জাতির সাথে মিশে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। যতদিন ছবি থাকবে, কাঠখোদাই শিল্পের জনপ্রিয় দিকটা চিরকাল একই থাকবে। শহরের চেহারা বদলালেও এ আর্ট থেকে গেছে সব কিছুর সাথে তাল মিলিয়ে। কাঠখোদাই অপূর্ব সূক্ষতা ও কাজের দক্ষতায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। ‘India Art Works Wooden Types & Block Makers’-এর মতো কিছু পুরানো দোকান ঘুরেফিরে আজো চিৎপুরে রাস্তার পাশে দেখা যায়। একটা সময়ে আর্থিক অনটনে শিল্পীরা কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অন্য পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন।

    উনিশ শতকে শিল্পীরা বংশ পরম্পরা মেনে কারিগরি দক্ষতায় কাঠের ব্লক খোদাই করে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সেকালের জীবনযাত্রার ছবি, দেবদেবীর কাহিনী, পোট্রেট, সুসজ্জিত রমণী, ছোটো বড়ো অক্ষর ইত্যাদি। কাঠখোদাইয়ে ছাপা ছবি আগে লোকেরা ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতেন। আস্তে আস্তে তা বন্ধ হয়ে যায়। চাটাইয়ের ওপর বসে শিল্পীরা একনাগাড়ে কাঠের ব্লকে লোহার বুলি চালিয়ে এচিং করে সামান্য অর্থের বিনিময়ে খোদাই করে যেতেন। ব্লকে কাঠের বাংলা বা ইংরেজি হরফ ও ছবির প্রতিটি রেখায় থাকতো নান্দনিক রূপ। সেগুলোই বইয়ের জন্য ছাপা হতে শুরু করল। অতীতের জনপ্রিয় বটতলার বই একসময়ে ছিল বাঙালির ঘরে ঘরে। এখানকার বইতে বড়ো আকারের কাঠখোদাই ছবি ছেপে বের হত। পাঠকদের খুবই আকৃষ্ট করত সেই সব ছবি। পঞ্জিকার ছবিতে কাঠখোদাই কাজের এক আলাদা চাহিদা ছিল। আর পঞ্জিকার পাতাতে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ছবিতে শিল্পীর দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যেত। 

    কাঠের ব্লক

    ‘দৈনিক বসুমতী’, ‘বঙ্গবাসী’ ও ‘প্রবাসী’র মতো অসংখ্য পত্রপত্রিকায় কাঠের ব্লক থেকে ছাপা ছবি বের হয়েছে। একটা সময় ছিল বিজ্ঞাপন  কাঠের ব্লকে অথবা বড়ো হরফে ছেপে বের হত। 

    কালি ও ছাপার কাজ বাণিজ্যের সাথে শিল্পের এক সুষম মেলবন্ধন ঘটায়। প্রথম বাংলা হরফ খোদাই করে বিজ্ঞাপন ছাপা হয় ১৭৭৮ সালে ‘Calcutta Chronicle’ ইংরেজি পত্রিকায়। বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ে এক বইয়ের জন্যে পঞ্চানন কর্মকার তৈরি করেন এই বিজ্ঞাপন। সেকালের পত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা দুষ্প্রাপ্য ওইসব বিজ্ঞাপনগুলি আজকের সময়ে মেলে ধরা হলে সত্যি অবাক হয়ে যেতে হয়। ওষুধ, অলংকার, সাবান, চুলের তেলের বিজ্ঞাপন ইত্যাদি নানা ধরনের অক্ষর ছবি নিখুঁত ভাবে খোদিত ও এঁকে ছাপানো হত। 

    ‘ঠাকুরমার ঝুলি’-তে কাঠখোদাইয়ে ছাপা ছবি 

    দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের লেখা ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ আর ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’ ছোটো-বড়ো সকলের খুব প্রিয়। সকলেই বড়ো হয়েছি সে গল্পের বইগুলি পড়ে। সেখানে প্রিয়গোপাল দাস, কুঞ্জবিহারী পাল, হেমচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বিখ্যাত কাঠখোদাই শিল্পীদের নাম পাওয়া যায়। বইয়ের ছবিতে তাঁদের কাজ চিরস্মরণীয় হয়ে বেঁচে থাকবে আগামী প্রজন্মের কাছে। চিৎপুরের বেশ কিছু কাঠখোদাইয়ের জায়গা সময়ের সাথে হারাচ্ছে। আগের মতো নতুন করে আর কোনও শিল্পী কাজ শিখছেন না। আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় নানা সমস্যার মোকাবিলার মধ্যেও কোথাও যদি ঐতিহ্যে শিল্পের সামান্য উপস্থিতি থাকে-- সে অতীতের স্মৃতি হোক বা বাস্তবতায়,তাহলে ইচ্ছে হতে পারে সেরকম কোনও সন্ধানের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে ফেলতে।

    ঋণ- সত্যজিৎ রায়ের ‘গোরস্থানে সাবধান’ এবং দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। 
    চিৎপুর রোডের ছবি সৌজন্যে অঙ বুধ
    কাঠের ব্লকের ছবি সৌজন্যে মুকুট তপাদার 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @