No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    উনিশ শতকে মেয়েদের চিঠি চালাচালি : যৌনতা, যন্ত্রণা, কান্নার প্রতিবাদপত্র

    উনিশ শতকে মেয়েদের চিঠি চালাচালি : যৌনতা, যন্ত্রণা, কান্নার প্রতিবাদপত্র

    Story image

    ছবি: আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কালেকশনস (১৯১২)

    শ্রীমতি অমুকীদেবীর মায়ের সঙ্গে তার আরও চার মাসির বিয়ে হয় এক কুলীন বামুনের। সেই বামুনের বহু শ্বশুরবাড়ি হওয়ায় সকলের বাড়ি ঘুরতে চার-পাঁচ বছর লেগে যেত। ফলে তাদের বাড়িতেও তাঁর মা-মাসির সঙ্গে তিনি দেখা করতে আসতেন চার-পাঁচ বছর ছাড়া। সেই সূত্রেই অমুকীদেবী এবং তাঁর দুই মাসির দুই মেয়ের জন্ম হয়। তারা বরাবর মামাবাড়িতেই থেকেছেন। কোনোদিন তাঁর বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা দেখা করতেও আসেননি। কিন্তু তাদের বিয়ের বয়স হলে পাছে তার মা-মাসিরা নিজেদের মতানুযায়ী বিয়ে দেন, সেই ভয়ে কোনোদিন না দেখা দেওয়া সেই দাদারা এক কাকাকে সঙ্গে নিয়ে তাদের গ্রামে আসে এবং এক রাতের মধ্যে তাদের তিন বোনকে লুকিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে এক কুলীনের সঙ্গে বিয়ে দেয়। তারপর থেকে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু স্বামীর সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। ফলে তখনও পর্যন্ত তারা মামাবাড়িতে থেকেই দাসী বা পাচিকা হিসেবে জীবন কাটাচ্ছিলেন। ১৬ ফাল্গুন ১২৩৭ সালে (১৮৩১) অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ১৯২ বছর আগে অমুকীদেবীর এই চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল রামমোহন-ঘরানার সাময়িক পত্র ‘সম্বাদ কৌমুদী’-তে। সেই সময় কৌলীন্য প্রথা নিয়ে বঙ্গীয় সমাজে নানা জলঘোলা চলছে, সতীদাহ-বিরোধী বিল পাস হয়ে গেছে, বিধবা-বিবাহ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সেই ডামাডোলের মধ্যে বাঙালি মেয়ের প্রথম ভাবনামূলক গদ্য-এর জন্ম। সম্বাদ কৌমুদীতে লেখাটা প্রকাশের পিছনেও কিন্তু গভীর কারণ রয়েছে। সেটা খুঁজতে গেলে আমাদের পৌঁছোতে হবে রামমোহনের কাছে।

    ১৮১৯ সালে সতীদাহ বিষয়ে কাশীনাথ তর্কবাগীশের ‘বিধায়ক নিষেধকের সম্বাদ’ প্রকাশিত হয়, সেটি রামমোহনের ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’-এর প্রতিক্রিয়ায় লেখা হয়েছিল। উত্তরে রামমোহন আবার ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ’ লিখবেন ১৮১৯-এর নভেম্বরে। সেখানে শাস্ত্র ব্যাখ্যার চেয়েও সমাজপতিদের গোঁড়ামির প্রত্যুত্তরে কৌতুক, ব্যঙ্গ এবং মেয়েদের প্রতি সহমর্মীতার কথাই বারবার উচ্চারণ করেছেন।

    সতীদাহ

    কাশীনাথ তর্কবাগীশের জবানে, “…স্ত্রীলোক স্বভাবত অল্পবুদ্ধি অস্থিরান্তঃকরণ বিশ্বাসের অপাত্র সানুরাগা এবং ধর্ম্মজ্ঞানশূন্যা হয়। স্বামীর পরলোক হইলে পর শাস্ত্রানুসারে পুনরায় বিধবার বিবাহ হইতে পারে না। এককালে সমুদায় সাংসারিক সুখ হইতে নিরাশ হয় অতএব এ প্রকার দুর্ভগা যে বিধবা তাহার জীবন অপেক্ষা মরণ শ্রেষ্ঠ।” মেয়েদের চরিত্রের উপরে বিধায়কের (এখানে শুধু কাশীনাথকে ধরলে হবে না) আরোপিত পাঁচখানা দোষ খণ্ডন করতে গিয়ে রামমোহন বলেছেন, “স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরিচয় কোন্ কালে লইয়াছেন যে অনায়াসেই তাহাদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন”। এর সঙ্গে মেয়েদের ধর্মবোধ, স্থৈর্য্য, পাতিব্রত্যের নানান প্রমাণ উত্থাপন করেছেন। বিশ্বাসের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, “প্রতি নগরে প্রতি গ্রামে বিবেচনা কর যে কত স্ত্রী পুরুষ হইতে প্রতারিতা হইয়াছে আর কত পুরুষ স্ত্রী হইতে প্রতারণা প্রাপ্ত হইয়াছে।”

    শান্তিপুরনিবাসিনীর মূল প্রশ্ন ছিল— কুলীনের মেয়ের সমমিল না হলে বিয়ে হয় না, বিধবা হলে বিয়েও হয় না আবার পর-পুরুষের সঙ্গে মিশলে কুল নষ্ট হয়।

    ভারতবর্ষীয় উপকূলে সম্ভবত রামমোহনই প্রথম ব্যক্তি যিনি সচেতন যুক্তিতে ও সহমর্মীবোধে মেয়েদের পক্ষে এহেন সওয়াল ছুড়ে দিয়েছিলেন সমাজপতিদের উদ্দেশে। ফলে রামমোহন-ঘরানার পত্রিকাতেই মেয়েদের ভাবনামূলক প্রথম গদ্য লেখাটি প্রকাশিত হবে এ যেন খুবই স্বাভাবিক ছিল (যদিও রামমোহন ১৮৩০-এর নভেম্বরেই বিলেতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন)।

    অমুকীদেবীর চিঠি প্রকাশের বছর চারেক পরে মাত্র সাত দিনের ব্যবধানে সমাচার দর্পণে দুটি চিঠি প্রকাশিত হয়। প্রথম চিঠিটা লিখেছিলেন কোনো এক শান্তিপুরনিবাসিনী, ১২৪১-এর (১৮৩৫), ২ চৈত্র তারিখে। সেখানেও বিধবা বিবাহ ও বহু-বিবাহের সমস্যা নিয়েই লেখিকা কথা বলেছিলেন। শান্তিপুরনিবাসিনীর মূল প্রশ্ন ছিল— কুলীনের মেয়ের সমমিল না হলে বিয়ে হয় না, বিধবা হলে বিয়েও হয় না আবার পর-পুরুষের সঙ্গে মিশলে কুল নষ্ট হয়। অন্যদিকে পুরুষরা স্ত্রী ঘরে থাকতেও পতিতাপল্লিতে যান, তাতে তাদের কুল যায় না। তাই সমাজের উদ্দেশে তাঁর প্রশ্ন, “কেবল স্ত্রীলোকের সুখ সম্ভোগ নিষেধার্থে কি ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণ তন্ত্র সৃজন হইয়াছিল।”

    যেখানে বিধবা বিবাহ হিন্দু শাস্ত্র সম্মত। তাই ইংরাজ বাহাদুরের কাছে তাঁর দাবি, হয় বিধবা মেয়ের বিয়ের কথা ভাবা হোক অথবা পুরুষের উপস্ত্রী রাখা বন্ধ করা হোক। কেননা, “স্ত্রীলোক ব্যভিচারী কেবল পুরুষের দ্বারা যদ্যপি পুরুষসকল উপস্ত্রী বর্জ্জিত হন তবে স্ত্রীলোক কুলটা হইতে পারে না।”

    উনিশ শতকের তিনের দশকে লেখা এই চিঠিগুলি বাঙালি মেয়েদের লেখা প্রথম গদ্যের নমুনা, অর্থাৎ সচেতন মনের অভিব্যক্তি। তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় সে সময়ে মেয়েদের জীবনের জটিল যন্ত্রণাকাতর দিকগুলোকে।

    তৎকালীন বাড়ির সাবেকি চিত্র

     

    এই চিঠিতে নারীদের যৌন জীবনের সমস্যা নিয়ে সরাসরি কথা বলা হয়েছে। সে সময় এভাবে যৌনজীবনে বুভুক্ষু বহু মহিলা পতিতালয়ে শেষ আশ্রয় নিত। ভবানীচরণের লেখা ‘নব বিবি বিলাস’-এ সে কথা বেশ ফলাও করে লেখা আছে। পাশাপাশি ‘নব বাবু বিলাস’ পড়লে শান্তিপুরনিবাসিনীর অভিযোগ ও খেদের সত্যতা যাচাই করে নেওয়া যায়।

    অন্য চিঠিটা চুঁচুড়ানিবাসী স্ত্রীগণের লেখা। সে চিঠিটি আজকালকার মহিলা সমিতির মতো কোনো সংগঠনের সম্মিলিত ভাবনা বলে মনে হতে পারে। তাঁরা মোট ছ’টা সমস্যা সমাধান চেয়ে চিঠিটা লিখেছিলেন, বিদ্যাদান বিষয়ে, সকল লোকের সঙ্গে মেলামেশার বিষয়ে, নিজেরা নিজেদের স্বামী নির্বাচনের বিষয়ে, বাবা-ভাইদের টাকার বিনিময়ে মেয়েকে পরের হাতে ছেড়ে দেওয়া বিষয়ে, বহুস্বামীর সংসার বিষয়ে এবং পুরুষের মতো নারীর বৈধব্যের পরে বিয়ে করা বিষয়ে। সে চিঠির একটু নমুনা নেওয়া যাক, “বলদ ও অচেতন দ্রব্যাদির ন্যায় আমারদিগকে কি নিমিত্ত হস্তান্তর করিয়া আপনারা নির্দ্দয়াচরণ করিতেছেন, আমরা কি আপনারাই বিবেচনাপূর্ব্বক স্বামী মনোনীত করিতে পারি না।” চিঠির ভাষার টেম্পারামেন্টের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কী প্রচণ্ড যন্ত্রণাজাত ক্ষোভ থেকে এই চাঁচা-ছোলা ভাষা বেরিয়েছে।

    মোট ছ’টা সমস্যা সমাধান চেয়ে চিঠিটা লিখেছিলেন, বিদ্যাদান বিষয়ে, সকল লোকের সঙ্গে মেলামেশার বিষয়ে, নিজেরা নিজেদের স্বামী নির্বাচনের বিষয়ে, বাবা-ভাইদের টাকার বিনিময়ে মেয়েকে পরের হাতে ছেড়ে দেওয়া বিষয়ে, বহুস্বামীর সংসার বিষয়ে এবং পুরুষের মতো নারীর বৈধব্যের পরে বিয়ে করা বিষয়ে।

    চুঁচুড়াবিবাসিনীরা স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে যে প্রথম সমস্যার কথা বলেছেন সে নিয়ে দু-একটা কথা এখানে বলে রাখা ভালো। মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা মিশনারীরা উনিশ শতকের প্রথম থেকেই করে আসছিলো। এমনকি সে সময়ে বঙ্গীয় প্রতিক্রিয়াশীল সমাজের মাথা রাধাকান্ত দেব স্ত্রীশিক্ষাকে সমর্থন করতেন। গৌরমোহন বিদ্যালংকারের ‘স্ত্রীশিক্ষাবিধায়ক’ তার প্রমাণ। তাছাড়াও প্রচুর নতুন স্কুল চালু হচ্ছিল বাংলার বিভিন্ন বর্ধিষ্ণু অঞ্চলে—তার প্রমাণ সে সময়ের বিভিন্ন সংবাদপত্রের পাতায় আখছার মেলে। ১৮৩৪ সালে এডামের শিক্ষা বিষয়ক যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয় সেখানেও ১৯টি বালিকা বিদ্যালয়ে পাঠরত ৪৫০ জন মহিলার কথা বলেছিলেন। কিন্তু স্কুলগুলো হয় মিশনারীদের ধর্মীয় মোড়কে পরিচালিত হত, নয় হিন্দু শাস্ত্রীয় মোড়কে। সেখানে পড়তও প্রান্তিক জাতির মানুষেরা নয় পতিতা প্রভৃতি অপাংক্তেয়রা। বঙ্গদূত পত্রিকায় ১৮৩১-এর জুন মাসে প্রকাশিত একটা নিবন্ধে স্ত্রীশিক্ষার বিরুদ্ধে যুক্তি ছিল—ভদ্রঘরের মেয়েরা পতিতা বনে যেতে পারে ফলে তা ভয়ের। যদিও মহিলারা নিজ চেষ্টায় বাড়িতেই কিছু কিছু যে শিখছিলেন তার প্রমাণ শিবচন্দ্র দেবের কয়েকপাতার আত্মজীবনী বা রাসসুন্দরী দাসীর জীবনী পড়লেই জানা যায়। তবু সর্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা তখনও ছিলো না। তা হবে ১৮৪৯-এ বেথুনের হাত ধরে। বাংলার নবজাগরণের মাইলফলক বেথুন ছিল কলকাতার প্রথম মেয়েদের স্কুল। সে সঙ্গেই বলার, স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে এরকম চিঠি সমাচার দর্পণে প্রকাশের পিছনেও একটা সমাপতন আছে—শ্রীরামপুর মিশনারীদের পত্রিকা ছিল সমাচার দর্পণ, যারা মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে প্রথম উদ্যোগী হয়েছিল। পাশাপাশি উনিশ শতকে মেয়েদের অন্যতম কাগজ ছিল ‘বামাবোধিনী’

    উনিশ শতকের তিনের দশকে লেখা এই চিঠিগুলি (উনিশ শতকে লেখা মেয়েদের চিঠি) বাঙালি মেয়েদের লেখা প্রথম গদ্যের নমুনা, অর্থাৎ সচেতন মনের অভিব্যক্তি। তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় সে সময়ে মেয়েদের জীবনের জটিল যন্ত্রণাকাতর দিকগুলোকে। শুধু সামাজিক সংকট নয়, মেয়েদের গহন মনের চাহিদাও উঠে এসেছে লেখাগুলোয়। যদিও অনেক সমালোচকই চিঠিগুলি পুরুষের বেনামে লেখা বলে মনে করেন, তা যে হতে পারে না তার প্রমাণ ইতিমধ্যেই নানাভাবে দেওয়া গেছে। অন্তত মেয়েদের যৌন খিদে নিয়ে কথা বলা কোনো পুরুষের পক্ষে সম্ভব ছিলো না বলেই আমাদের বিশ্বাস, সে সময়ে তো নয়ই।

    ____

    ছবিসূত্র: গুগল

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @