No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    এ দেশে বিপ্লবের অবস্থা কি গাওয়া ঘি-এর মতো হবে? প্রশ্ন তুলেছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

    এ দেশে বিপ্লবের অবস্থা কি গাওয়া ঘি-এর মতো হবে? প্রশ্ন তুলেছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

    Story image

    ভ্রান্তি বিলাস ছবিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৬২

    ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (Bhanu Bandopadhyay)। সিনেপর্দা কাঁপানো ‘রসিক ভানু’ প্রতি বছর শহিদ দিবসে অবশ্য করণীয় কর্মতালিকা অনুসারে শত ব্যস্ততার মধ্যেও একটু সময় বার করে মহাকরণে উপস্থিত হয়ে শ্রদ্ধেয় ক্ষুদিরাম, বিনয়, বাদল, দীনেশ প্রমুখ বিপ্লবী শহিদদের ছবিতে মালা দিয়ে প্রণাম করতে ভুলতেন না। আজীবন নিজের আদর্শে অবিচল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে মনে রেখেছে আজকের প্রজন্ম। তাই বারবার তাঁর অভিনীত ছবিগুলির পাশে ফিরে যাওয়া। তবে বহু আলোচিত ‘অভিনেতা’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Actor Bhanu Bandopadhyay) নিয়ে নয়, এ লেখার উদ্দেশ্য একজন ‘লেখক – দার্শনিক – কমিকস রচয়িতা’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফিরে দেখার। যিনি বিপ্লবীদের স্মরণ করে তাঁর ডায়েরিতে লেখেন, “আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দীনেশদা-বিনয়দা যদি বিদেশে জন্মাতেন, তবে তাঁদের জীবনী পাঠ্যপুস্তক হত – আমাদের দেশে খাঁটি মানুষ তৈরি হত।” তাঁদের জীবনী আজ পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু দেশে খাঁটি মানুষ তৈরি হয়েছে কিনা তা সময় বলবে।

    এই সংশয় প্রকাশ করেন শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। ‘বিপ্লব’ শব্দটি ব্যাখ্যা করে বলেন, “১৯৩০-৩২ সাল পর্যন্ত বিপ্লবীদের কথা স্মরণ করে গর্ববোধ করি আমি তাঁদেরই দেশের ছেলে বলে। কিন্তু এখন বিপ্লব মুখের বুলি। দেওয়ালে দেওয়াল যত বিপ্লব। তবে কি বিপ্লবের অবস্থাও গাওয়া ঘি-এর মতন হবে!”

    ‘নেতা কই? সব ভাঁওতাবাজ’ শীর্ষক পর্বে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে আনছেন তৎকালীন নেতাদের কর্মকাণ্ড। পাঠকদের খেয়াল রাখতে বলছি, এ কথা শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন সত্তরের দশকে। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। লিখেছেন, “স্বাধীনতা হল। যে বাঙালিরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে লড়লেন, তাঁরাই আবার বঙ্গভঙ্গ করলেন। পূর্ববঙ্গ আর অপূর্ববঙ্গ। ...স্বাধীনতার পর একই রাজনীতি চলছে – নির্বাচন হবে, নির্বাচন প্রতিনিধিরা গদিতে যাবেন, আর সাধারণ মানুষ নদীতে ভাসবেন।” পঞ্চাশ বছর আগের সেই ছবিটা এ সমাজে আজও বিরাজমান। অতএব যা হবার, তাই-ই হয়েছে।

    সিনেপর্দা কাঁপানো ‘রসিক ভানু’ প্রতি বছর শহিদ দিবসে অবশ্য করণীয় কর্মতালিকা অনুসারে শত ব্যস্ততার মধ্যেও একটু সময় বার করে মহাকরণে উপস্থিত হয়ে শ্রদ্ধেয় ক্ষুদিরাম, বিনয়, বাদল, দীনেশ প্রমুখ বিপ্লবী শহিদদের ছবিতে মালা দিয়ে প্রণাম করতে ভুলতেন না।

    ‘আজকাল’ থেকে ১৯৯১ সালের কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লেখালেখি’ (Lekhalekhi of Bhanu Bandopadhyay)। যেখানে অসামান্য দুটি ভূমিকা লিখেছিলেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee) এবং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় (Nilima Bandopadhyay)। এই বই থেকেই জানা যাবে সিনে টেকনিসিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল এবং অভিনেতৃ সংঘের খাদ্য আন্দোলন-পীড়িতদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করার ইতিহাস। যে দলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করেছিলেন অনুপকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অজিত লাহিড়ী, নৃপেন গাঙ্গুলি, অনিল চৌধুরী, সৌম্যেন্দু রায়।

    ইডেনে বাংলা - বম্বে তারকাদের বিচিত্রানুষ্ঠানে ভানু ও নীলিমা, ১৯৫৬

    শিল্পীর চেয়েও শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে একজন শ্রমিক বলতেই বেশি পছন্দ করতেন। বলতেন নিজেদের রাজনীতি থেকে পৃথক করে রাখায় বিশ্বাসী নন। তার কারণ দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক অবস্থা যুক্ত। ভরসা করতেন কার্ল মার্ক্স কথিত সেই অমোঘ বাক্যটির ওপর – “শ্রমিক শ্রেণির বন্ধনমুক্তির প্রথম পদক্ষেপ হল রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া।” বারবার অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্পীদের ঐক্যে বিশ্বাস করেছেন। ঐক্য থাকলেই হয়তো একচেটিয়া ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলির শোষণের বিরুদ্ধে জোরদার প্রতিবাদ জানানো যাবে।

    শিল্পীর চেয়েও শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে একজন শ্রমিক বলতেই বেশি পছন্দ করতেন। বলতেন নিজেদের রাজনীতি থেকে পৃথক করে রাখায় বিশ্বাসী নন।

    এই দার্শনিক ভানুই অভিনয় করেছেন ‘ভানু পেল লটারি’ (Bhanu Pelo Lottery) এবং ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ (Jamalaye Jibanta Manush) ছবিতে। শুরু হয়েছিল ভানু-জহরের অসম্ভব যাত্রা। গ্রাম্য ভানুর সেই ‘জহুরে’ সম্বোধন এক কথায় অনবদ্য। জহর রায়-এর সঙ্গে ভানুর একটা অসম্ভব রসায়ন ছিল, তাঁদের কমিক টাইমিং, সংলাপ বলার ধরন এবং দুজনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং এতটাই ছিল যে সেইসব ছবি যারা না দেখেছেন তাদের পক্ষে অনুধাবন করা শক্ত। অবশ্য ভানু-জহর জুটির ছবি দেখেননি, এরকম বাঙালি মনে হয় খুব বেশি নেই।

    ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট ছবিতে ভানু, জহর রায় ও পাহাড়ী সান্যাল

    ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন। স্বর্গে গিয়ে ভানু যখন সব দেবতাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন এবং তাঁদের যারপরনাই নাজেহাল করছিলেন, সেই দৃশ্যগুলি আজও সাজিয়ে রাখার মতন। এরমধ্যে চিত্রগুপ্তরূপী জহর রায়ের সঙ্গে ভানুর কথোপকথনগুলি দুর্ধর্ষ। দু’একটি নমুনা পেশ করা যাক –

    নমুনা এক – 
    ভানু: অকালমৃত্যুই যদি হবে, তবে জন্মাল কেন?
    জহর: আজ্ঞে, ঠিকই তো, আমার সব কীরকম গুলিয়ে যাচ্ছে!

    নমুনা দুই – 
    জহর: আজ্ঞে, সে আপনি ঠিক বলেছেন, দেবতারা যত না খাচ্ছেন, তার থেকে বেশি ছড়াচ্ছেন।
    ভানুঃ ছড়াচ্ছেন! ছড়ানো বের করছি, একবার ফিরে যাই, কন্ট্রোলের লাইনে চালের জন্য যারা গুঁতোগুতি করছে, তাদের কাছে ব্যাপারটা ফাঁস করে দিচ্ছি; এরপর তারা যখন স্বর্গরাজ্যে এসে হামলা চালাবেন, তখন কত্তারা বুঝবেন ফুড ক্রাইসিস কাকে বলে!
    জহর: হেঁ হেঁ হেঁ…তা তো বটেই!

    ওখানেই নারদরূপী পাহাড়ি সান্যাল (Pahari Sanyal) যখন সবে গান ধরার আগে গলা সাধছেন, ভানুর বক্তব্য: না না, চলবে না, আধুনিক জানা আছে? না জানলেও ক্ষতি নেই, আমি শিখিয়ে নেব’খন, গলা কাঁপাতে পারেন তো?

    ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’-এ সেই ‘হাম-হাম-গুড়ি-গুড়ি নাচ’ নিশ্চয় মনে আছে! যা ভানু শেখাচ্ছিলেন ঊর্বশীকে।

    গল্প হলেও সত্যি ছবিতে ভানু, বঙ্কিম ও রবি

    সেই রসিক ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ডায়েরিতে লেখেন দেশ স্বাধীনের কথা। স্বাধীন দেশের পুলিশের কথা। লিখেছেন, “এল ১৯৪৭ সাল। ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের তখন জন্ম। হঠাৎ সরকারপক্ষ স্থির করল পুলিশের পুরোনো পোশাক বাতিল করতে হবে। ...পরিবর্তন হল, তারা ভাবল, লাল পাগড়িতে দেশের লোক ভয়ানক ভীত। সুতরাং আগে লাল পাগড়ি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।” তৎকালীন দেশ-রাজ্য তথা কলকাতার পটপরিবর্তনের নানান ছবি ধরা পড়বে এইসব লেখালেখিতে। বইটির শেষে রয়েছে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা মজার ঘটনা। কোনোটার বাস্তবভিত্তি আছে, কোনোটা কাল্পনিক। সাধারণ লাইনটানা খাতা। তাতে কত মণিমুক্তো। সেই আঠারোটি আশ্চর্য হীরকখণ্ড দিয়ে শেষ হয়েছে এই অসামান্য বই। তার দুটি উদাহরণ এখানে রইল।


    একজন কলকাতা থেকে পশ্চিমে তার দেশে যাচ্ছিল। হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়ার পর দেখা গেল, যে স্টেশনেই গাড়ি থামে সে দৌড়ে ভেতরে যায় আবার ছাড়ার আগে দৌড়ে এসে ওঠে। এভাবে কয়েকটি স্টেশন লক্ষ্য করার পর এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি যে স্টেশনে গাড়ি থামছে, সেখানেই দৌড়ে নামছেন আর উঠছেন কেন?’ তখন তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি কলকাতায় একজন হার্ট স্পেশালিস্টকে দেখিয়েছি। তিনি বললেন, আমি বাড়ি ফেরার পথেই মারা যেতে পারি, তাই প্রত্যেক স্টেশনে টিকিট কাটছি। বোঝেন তো, শুধু শুধু বেশি পয়সা দিতে যাব কেন?’


    সম্পাদক: এই কবিতা কি আপনি নিজে লিখেছেন?
    আগন্তুক: নিশ্চয়। প্রতিটি লাইনই আমার লেখা।
    সম্পাদক: আরে বসুন, বসুন। তোমরা যে যেখানে আছ কাজ রেখে এখানে এস। আমাদের অফিসে আজ জীবনানন্দ দাশ এসেছেন। ছিঃ ছিঃ আমি ভেবেছিলাম আপনি অনেকদিন আগে মারা গেছেন!

    মৃত্যুর সাতদিন আগে, রোগশয্যায় বসন্ত চৌধুরীর সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

    ‘আমাদের সংস্কৃতি কোন পথে’ তা নিয়ে মাথা ঘামাতে ক’জন শিল্পীকে দেখতে পাওয়া যায়! কতজন শিল্পীর মধ্যে দেখা যায় পূর্বসূরির প্রতি সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা! সমসাময়িকদের প্রতি অমন দ্বিধাহীন ঈর্ষাশূন্য স্বীকৃতি! মানুষ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিনয় তথা কৌতুক রসের বিস্তার সম্পর্কেও তাঁর পরিশীলিত মনের চিন্তা এই লেখাগুলির মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

    __________

    তথ্য ও ছবিঃ
    লেখালেখি/ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়/ আজকাল পাবলিশার্স প্রা.লি./ প্রথম প্রকাশ বইমেলা ১৯৯১/ তৃতীয় সংস্করণ জানুয়ারি ২০১৮

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @