দেবগ্রাম প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে অবহেলিত কেন

সমাজ বিবর্তন ও পুরাতত্ত্বের আলোকে নদীয়া জেলার এক বিস্মৃত ও বিলুপ্ত জনপদ- দেবল রাজার গড় বা দেবগ্রাম।
একটি অদ্ভুত এবং অত্যন্ত অবহেলিত ঐতিহাসিক জায়গা হচ্ছে দেবগ্রাম বা দেবলা- যাকে স্বচ্ছন্দে একটি জীবন্ত প্রত্নক্ষেত্র বলা যায়। রানাঘাট বা চাকদহ থেকে সমদূরত্বে অবস্থিত দেবলায় পৌঁছনোর কোনোই অসুবিধে নেই। তবুও দেবগ্রাম কেন সংবাদপত্রে উল্লেখিত হয় না জানি না!
এখানে ধানজমিতে চাষ করতে গেলে, লাঙলের ডগায় উঠে আসে কোন সেই সুদূর অতীতের পালযুগের মূর্তি বা জলপ্রদীপ, সেনযুগের ঘর গেরস্থালির হাঁড়ি কুঁড়ি অথবা সুলতানি যুগের হুঁকো, সুরাপাত্র, কলসি ইত্যাদি। নলপুকুর, পন্ডে পাড়া, বিলে পাড়া ইত্যাদি অঞ্চলে মাটির নিচেই চারটি যুগের সভ্যতার স্তরীভূত নিদর্শন পাওয়া যায়। এমন অদ্ভুত দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস হবে না। বিশেষ করে বর্ষার জলে চাষের জমির মাটি ধুয়ে গেলে এই অসংখ্য মৃৎপাত্রের টুকরোগুলি এমন ভাবে বেরিয়ে আসে আজও।

এই দেবগ্রাম প্রত্নক্ষেত্র নিয়ে প্রথম লিখিত প্রমাণ পাই 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকার- ২৬শে ডিসেম্বর ১৮১৮/১২২৫ বঙ্গাব্দ সংখ্যায়। লেখা হয়েছে "চক্রদহ( চাকদাহ) উত্তর পূর্ব অনুমান চারি ক্রোশ অন্তর দেবগ্রাম নামক একটি গঞ্জ আছে। সেখানে একটি বৃহৎ বাটি আছে। তাহার আয়তন অতি বড় প্রায় এক ক্রোশ এবং তাহার চারি কোনে চারটি পর্বত আকারে মৃত্তিকা গুরুজ আছে। বাটির মধ্যে দুটি বৃহৎ পুষ্করিণী আছে। এবং স্থান দুটিতে মৃত্তিকার মধ্যে ইস্টক ও প্রস্তর আছে।"

অর্থাৎ আমরা জানছি যে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ ২০০ বছর আগেই এই প্রাসাদটি লুপ্তপ্রায় হয়েছিল। লুপ্তপ্রায় হলেও, সুখের বিষয় এখনও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়নি। গ্রামবাসীরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখিয়েছেন। অনুমিত যে এই বৃহৎ বাটিকাই ঐতিহাসিক দেবল রাজার গড়, যার চতুর্দিকে ১৫/২০ ফিট মাটির পাঁচিল এবং ৩০/৪০ ফিট চওড়া পরিখা এখনও অনেক জায়গায় বিদ্যমান। একটি মাত্র মাটির গম্বুজ এখনও দাঁড়িয়ে আছে, যার ধ্বংসস্তূপের উচ্চতা কমপক্ষে ৫০/৬০ ফুট। প্রাচীন গ্রামবাসীরা অনেকেই তাঁদের ছোটবেলায় এই গম্বুজে উঠতেন এবং তাঁদের কথায়, প্রায় ৫ মাইল অবধি চতুর্দিক দেখতে পেতেন। দেবলপুকুরের পাশে 'ইস্টক' নির্মিত পাঁচিল এবং ইঁটের মাপগুলি দেখুন।
এর পর লিখিত প্রমাণ হিসাবে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত "List of Ancient Monuments in Bengal" এর ১১৮ নম্বর পাতায় পাচ্ছি- "Outside the fort are the ruins of several large temples which appear to be of great interest and of some antiquity, as evidenced by the size of bricks. They are the only undoubtedly pre-Muhammadan ruins seen or heart in the district.
অনুরোধ করছি বিশাল বিশাল মাকরা পাথরের ব্লক এবং নদীর সাদা বালি ও প্রাকৃতিক চুন মেশানো অত্যন্ত শক্ত স্ট্যাকর ব্লক গুলি দেখুন। এরকম অসংখ্য ব্লক এখানকার গ্রামবাসীদের ঘরে ঘরে পড়ে আছে।
দেবলগড়ের প্রত্নক্ষেত্র প্রধানত দুটি জায়গা জুড়ে অবস্থিত। মুখ্য অংশটি গাংনাপুর বনবিভাগের অধীন এবং বাকি অংশগুলি চতুর্দিকের ব্যক্তি মালিকানাধীন। সর্বত্র মাটির নিচে চারটি সভ্যতার স্তরায়নের প্রমাণ খুব ভালো করে বোঝা যায়। সর্বনিম্ন স্তর পাল পূর্ববর্তী এবং পাল যুগের, এর উপরে সেন যুগের, তার উপরে সুলতানি যুগের, এবং সবার উপরে কোম্পানির যুগের। এই সবই ঢাকা পড়ে গেছিল এক অরণ্য বাস্তুতন্ত্রের দ্বারা, অর্থাৎ যখন এই পরিত্যক্ত জায়গা ঢেকে গেল ঘন জঙ্গলে, যেখানে বিচরণ করতো বাঘ, হরিণ ইত্যাদি।
আগেই বলেছি সর্বনিম্ন স্তরটি সম্ভবত পাল পূর্ববর্তী এবং পাল যুগের নিদর্শন। আনুমানিক সময়কাল ৮০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দ।
দেবগ্রামের চাষীরা, জনমজুররা, সাধারণ মানুষরা বুঝে উঠতে পারছেন না, এই যে জিনিসগুলি চাষ করা, মাছ ধরার সময় মাটি/পুকুর থেকে উঠে আসছে, সেগুলি নিয়ে তাঁরা কী করবেন।
শুনলে আশ্চর্য হবেন, গ্রামের মানুষেরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে একটি আস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা বানিয়ে ফেলেছে। রিটায়ার্ড ডাককর্মী শ্রী চিত্ত বিশ্বাস দান করে দিয়েছেন তাঁর বাড়ি, নার্সারির মালিক শ্রী অশেষ হালদার মশাই দিয়েছেন ফার্নিচার, ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম ইত্যাদি। এঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন এক ঝাঁক উজ্জ্বল তরুণ ডা: বিশ্বজিৎ দাস, সঞ্জয় ভৌমিক, অনির্বাণ বোস, দেবজিৎ বিশ্বাস প্রমুখ। সমগ্র দেবগ্রামবাসীরা উৎসাহ, উদ্দীপনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এই ঐতিহাসিক সম্পদগুলি বাঁচাতে। এই সংগ্রহশালার নাম "দেবলগর দেবল রাজা পুরাতত্ত্ব ও লোক সংস্কৃতি পরিষদ, দেবগ্রাম, গাংনাপুর, নদীয়া।"
কিন্তু পুরাতাত্ত্বিক কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষজ্ঞরা এগিয়ে না এলে এভাবে কি বাঁচানো সম্ভব?

পাল যুগের নকশা করা মৃৎপাত্রের অংশ, জল প্রদীপ এবং ধুপদানি দেখুন। এই জলপ্রদীপের বিশেষত্ব হচ্ছে এটি ঠিক হাতের তালুর মাপে হত, প্রদীপের নীচে আরেকটি ছোট প্রকোষ্ঠ হত এবং তাতে একটি ছোট ছিদ্র থাকত। এই ছিদ্র দিয়ে প্রকোষ্ঠটি জলপূর্ণ করে, প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ হাতে বুদ্ধের আরতি হত। এগুলি সাধারণত পালযুগে বজ্রযানি মতাদর্শে দেখা যেত।
পালযুগের প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুর মধ্যে চাকদহ থানার বনমালিপাড়ায় পাওয়া গেছে প্রস্তর নির্মিত একটি অনিন্দ্য সুন্দর বজ্রযানি তারা মূর্তি যেটি বর্তমানে হিন্দু দেবী হিসেবে পূজিত হচ্ছে। এত চমৎকার তারা মূর্তি থেকে চোখ ফেরানো যায় না। দেবলায় পাওয়া গেছে ক্ষুদ্র ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মূর্তি।
এখানে পৌঁছাতে গেলে রানাঘাট বা চাকদহ নেমে গাংনাপুর যাবার বাস পাবেন।ডা: বিশ্বজিৎ রায় ব্যক্তিগত ভাবে দেবগ্রাম নিয়ে অবহিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আশায় রইলাম একদিন দেবগ্রামেও চন্দ্রকেতুগড়ের মতন কর্মকাণ্ড শুরু হবে।