No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    শ্রমজীবী নারী কে? শ্রমজীবী নারী কে নন?

    শ্রমজীবী নারী কে? শ্রমজীবী নারী কে নন?

    Story image

    ফি বছর নারীদিবসের আগে একটা তরজা বাধে৷ একদলের দাবি, রাষ্ট্রসংঘ যাকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস বলে ডাকে, তাকে তাঁরা সে নামেই ডাকবেন। আরেক দলের দাবি, উঁহু, আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদিবস বলতে হবে; অন্য নামে যাঁরা ডাকেন, তাঁরা ধনতান্ত্রিক মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের শিকার। নারীদিবস মানে কারও কাছে যদি গুচ্ছের কেনাকাটি হল্লাহাটি হয়, তবে সে বাজারের সুতোর টানে নাচছে বটে। এ কথা সত্য যে ধনতন্ত্রের সবকিছুকে ‘অ্যাপ্রোপ্রিয়েট’ করার প্রবণতা আছে ও আমাদের সে সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। এ-কথাও সত্য যে ইতিহাস বলছে, এ দিনের সূচনা হয়েছিল কারখানার শ্রমজীবী মেয়েদের হাত ধরে। ব্যক্তিগত ভাবে ‘শ্রমিক’ বা ‘শ্রমজীবী’ কথাটি আমার কাছে সম্মানের। আমি যখন পড়াই, তখন আমি শিক্ষাশ্রমিক। আমি যখন লিখি, তখন আমি বুদ্ধিশ্রমিক (সেইটে অনেকে বুঝতে চান না বলেই লেখার পারিশ্রমিক না দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন)। কিন্তু আমাদের আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ধনতান্ত্রিক সমাজে ‘শ্রমিক’ শব্দের সঙ্গে লেগে থাকে অপমান। সেই অপমান গায়ে মাখতে চান না বলে সহজে কেউ নিজেকে ‘শ্রমিক’ দাগান না। যদি সারাজীবন অবৈতনিক শ্রম দিয়ে যাওয়া গৃহবধূকে বলি, ‘তুমিও শ্রমিক’, তাহলে তিনি হয়ত ভাববেন, তাঁকে অপমান করা হল। কিন্তু শ্রমকে শ্রম বলে স্বীকার না করে, সেবা যে ভাবলেন আজীবন, তাতে সম্মান পেলেন কি? 

    গৃহবধূ অজ্ঞ হতে পারেন, কিন্তু শ্রম নিয়ে, মজুরি নিয়ে, অর্থনীতি নিয়ে যাঁরা বিস্তর মাথা ঘামাচ্ছেন, তাঁরা কী ভাবেন এ সম্পর্কে? এই যে তাঁরা দাবি করেন, ‘শ্রমজীবী নারীদিবস বলতে হবে,’ এই ‘শ্রমজীবী’ নারী বলতে তাঁরা কাদের বোঝেন? তা বোঝার আগে আমরা জেনে নেব, যে ইতিহাসের রেফারেন্স তাঁরা টানেন, কী সেই ইতিহাস? 

    শিল্প বিপ্লবের সময় শুধু পুরুষ শ্রমিকরা আন্দোলন করেননি শ্রমিক অধিকার নিয়ে। ১৮৫৭ সালে মজুরি বৈষম্য, অনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, কাজের অমানবিক পরিবেশ— এ-সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। ১৯০৮ সালে আমেরিকার বস্ত্রশিল্পের মোট শ্রমশক্তির ৭০% ছিলেন পরিযায়ী মহিলা শ্রমিক। বাড়ির কাজ সামলে সপ্তাহে পঁচাত্তর ঘণ্টা অবধি কাজ করতে হত তাঁদের। কিন্তু, পেতেন পুরুষ বস্ত্রশ্রমিকদের পাওয়া সামান্য মজুরির চেয়েও কম মজুরি। অতঃপর সঙ্ঘবদ্ধ হতে শুরু করেন মেয়ে শ্রমিকরা। ওই বছর ৮ মার্চ পনেরো হাজারেরও বেশি নারী শ্রমিক নিউ ইয়র্কের লোয়ার ইস্ট সাইট থেকে ইউনিয়ন স্কোয়ার অবধি মিছিল করেন। ভোটদানের অধিকার, মাইনে বৃদ্ধি এবং শ্রমকাল হ্রাস দাবি করেন। এহেন পরিস্থিতিতে ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের আয়োজনে, জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। মেয়েদের আন্দোলন দিন দিন বাড়তে লাগল। যেমন, ১৯০৯ সালের ২২ নভেম্বর, ক্লারা লেমলিক নামের এক পরিযায়ী নারী ইহুদি শ্রমিক ডাক দেন জেনেরেল স্ট্রাইকের। এই সফল ধর্মঘট চলে ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি অবধি। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনের সোস্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালে একটি নির্দিষ্ট দিনকে আন্তজার্তিক শ্রমজীবী নারী দিবস হিসাবে ঘোষণার প্রস্তাব দেন ক্লারা জেটকিন। সর্বসম্মতিক্রমে সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়। যদিও নির্দিষ্ট কোনও দিন ঠিক হয়নি সেই সমাবেশে।

    যদি সারাজীবন অবৈতনিক শ্রম দিয়ে যাওয়া গৃহবধূকে বলি, ‘তুমিও শ্রমিক’, তাহলে তিনি হয়ত ভাববেন, তাঁকে অপমান করা হল। কিন্তু শ্রমকে শ্রম বলে স্বীকার না করে, সেবা যে ভাবলেন আজীবন, তাতে সম্মান পেলেন কি?

    ১৯১১ সালে ১৯ মার্চ প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস উদযাপিত হয় জার্মানি, সুইৎজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়ায়। দুঃখের বিষয়, এক সপ্তাহের মাথায় নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে আগুনে পুড়ে মারা যান একশ ছেচল্লিশ জন নারী শ্রমিক। কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার প্রশ্নটি নতুন করে উসকে দেয় এই ঘটনা। ১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রবিবার প্রথমবার রাশিয়ার মেয়েরা আন্তজার্তিক শ্রমজীবী নারী দিবস পালন করেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে। সে বছর ৮ মার্চ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশ্বশান্তির পক্ষে মিছিল করেন মেয়েরা। ১৯১৭ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপে, রাশিয়ার মেয়েরা ফেব্রুয়ারির শেষ রবিবার (পশ্চিমি বা জর্জিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৮ মার্চ) রুটি এবং শান্তি-র দাবিতে ফের পথে নামেন। এর বহু বছর পর ১৯৭৫ সালটিকে যখন ইউনাইটেড নেশন ‘আন্তর্জাতিক নারী বছর’ হিসাবে ঘোষণা করে, তখন ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এসব ইতিহাস মনে রেখেই।

    তাহলে, ধারণা করা যায়, ‘শ্রমজীবী নারী’ বলতে মূলত কারখানা শ্রমিক মেয়েদের কেন বুঝেছিলেন প্রথম যুগের মার্ক্সবাদীরা? আজ আমরা খেতমজুর বা চা-বাগানের মেয়েকেও নিশ্চয় ‘শ্রমিক’ বলব। ইটভাটায় কাজ করা মেয়ে, বিড়ি বাঁধা মেয়ে—শ্রমিক তারাও। ‘শ্রমিক’ নামক ধারণার বিবর্তন ঘটে, ঘটা স্বাভাবিক। ক্রমে আমরা বুঝি, প্রাথমিক, দ্বিতীয় ও তৃতীয় —নানা ধরনের কাজের ‘সেক্টর’/পরিসর হতে পারে (এসব অর্থনীতিতে বহুল আলোচিত)। সব সেক্টরেই শ্রম যাঁরা দেন, তাঁরা শ্রমজীবী৷ চাষী বা খনি শ্রমিক প্রথম ঘরানায় পড়েন। আবার প্রথম সেক্টরের উৎপাদিত বস্তুকে কাজে লাগিয়ে দ্বিতীয় সেক্টর কিছু উৎপন্ন করতে পারে, যেমন কল-কারখানায় হয়। আর তৃতীয় পরিসরটি হল আসলে সার্ভিস সেক্টর: পরিবহণ, চিকিৎসা, শিক্ষা, যোগাযোগ ইত্যাদি। রাষ্ট্র যখন বুঝেছে যে কাজের নানা পরিসর রয়েছে, তখন শ্রমশক্তি নিয়ে যারা কাজ করেন, শ্রমিকের ধারণাও বদলানো তাঁদের উচিত। এমনকি, হতেই পারে সে হোয়াইট কলার শ্রমিক, তবু আসলে সে যে শ্রমিক, এইটে রাষ্ট্র চেপে যাওয়ার চেষ্টা করলেও, শ্রমিক রাজনীতির কি তা করা উচিত? তাই ক্রমাগত আন্দোলনের চাপে আজ আশাকর্মী থেকে গিগ ওয়ার্কার অনেককেই লেবার কোডের আওতায় আনতে সরকার বাধ্য হয়েছেন। বেসরকারি ক্ষেত্রে কারচুপি করে শ্রমিক অধিকার কেড়ে নেওয়া আরও সহজ। কনট্রাকচুয়াল শ্রমিক রেখে বলতেই পারি, ও আসলে শ্রমিক নয়, ‘কনস্যাল্ট্যান্ট’ বা ‘অ্যাডভাইজার’ বা ‘সহায়ক’ বা সেবক’। কিন্তু সরকারি ক্ষেত্রেও এমন কারচুপি বিরল নয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মিডডে মিল কর্মী মেয়েদের কথা। এঁদের স্বয়ং সরকারই শ্রমিক বলেন না, বলেন ‘স্বেচ্ছাসেবী’। কেন বলেন? এইবার নিশ্চয় অনুমান করতে বেগ পেতে হচ্ছে না যে শ্রমিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতেই এদের শ্রমিক বলেন না সরকার, ঠিক বেসরকারি কায়দায়। যে রান্নার কাজ তাঁরা করেন, সমাজে প্রচলিত লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজনের নীল নকশা অনুযায়ী সেই কাজগুলি মেয়েলি। কাজে নেওয়াও হয় মেয়েদের। এতে সরকারের সুবিধে হল, মেয়েদের শ্রম কম মজুরিতে তিনি পান। একই মাটি কেটে, অর্থাৎ পুরুষালি কাজ করেও যদি মেয়ে শ্রমিক পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পেতে পারেন, তাহলে মেয়েলি কাজ করে মেয়েরা আর কী আশা করবেন? অতএব শ্রম না বলে কাজগুলিকে ‘সেবা’ বলে অভিহিত করা, শ্রমিক না বলে স্বেচ্ছাসেবিকা নামে ডাকা, সবই সুপরিকল্পিত।

    মাটি কেটে, অর্থাৎ পুরুষালি কাজ করেও যদি মেয়ে শ্রমিক পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পেতে পারেন, তাহলে মেয়েলি কাজ করে মেয়েরা আর কী আশা করবেন?

    এই জায়গায়, আমরা দেখছি, শ্রমবিশেষজ্ঞ বা আন্দোলনকারীরা সরকারের চালাকিটা কম-বেশি ধরতে পেরেছেন। তাঁরা মিডডে মিল কর্মীকে শ্রমিক মানেন। এঁরা কিন্তু পরিষেবা কর্মী বা তৃতীয় সেক্টরের কর্মী। শ্রমিক মানেন এমন কি গৃহকর্ম সহায়িকাকেও। এঁদের সবাইকেই বামপন্থীরা শ্রমিক মানেন, এটা ধরে নিচ্ছি, কারণ এঁদের সবার মধ্যেই তাঁরা সংগঠন গড়ার চেষ্টা করছেন। তাঁরা বলেন, ওঁদেরও চাই ন্যুনতম মজুরি অর্থাৎ একুশ হাজার টাকা। ইঙ্গিত স্পষ্ট। তাঁরা বলতে চাইছেন, শ্রমজীবী এঁরাও। ‘কেয়ার ইকোনমি’ এখন অর্থনীতির নতুন ভাবে আলোচ্য শাখা। অন্যদিকে সরকারী কর্মী, শিক্ষক, ডাক্তাররা, নার্স ইত্যাদিরা সরকারি কর্মীদের চাকরি সংক্রান্ত অন্য বিধির আওতায় এসে যাবেন, যা তাঁদের পেশাগত অধিকারকে সুনিশ্চিত করে৷ মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটেটিভ থেকে কর্পোরেট ওয়ার্কার থেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার— তাঁরাও লিঙ্গ নির্বিশেষে নিজেদের সংগঠন গড়ছেন, কারণ তাঁরাও কর্মী।

    তাহলে আমাদের আশেপাশে যে শিক্ষক, ডাক্তার, নার্স, আশাকর্মী, মিড ডে মিল কর্মী, চা-বাগানের কর্মী, খেতমজুর, কর্পোরেট কর্মী, গিগ কর্মী, সরকারি কর্মী, বেসরকারি কর্মী মেয়েরা আছেন, রাষ্ট্র তাঁদের কারও শ্রমজীবন মেনেছেন, কারও মানেননি। কিন্তু সবাই আসলে শ্রম দেন, সকলেই কর্মী, নৈতিকভাবে বামপন্থীরা তা মানেন। একবিংশ শতকে এসে, ৮ মার্চ তাহলে এঁদের সবার দিবস। এঁদের সবার কর্মজীবনের বঞ্চনা, শোষণ, কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা, বেতন আলোচনায় আসবে এই দিনে।

    যৌনকার্যকে শ্রমের আরেক রূপভেদ ধরে যৌনকর্মী কথাটিও দীর্ঘদিন চালু হয়েছে। এই যৌন শ্রমও গৃহবধূ দিয়ে থাকেন অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষত যাঁদের ক্ষেত্রে নির্ধারিত বিবাহিত ব্যক্তিটির সঙ্গে পারস্পরিক যৌনক্রিয়া সুখকর নয়।

    আর যে মেয়েরা আয় করেন না? ইচ্ছে করেই বললাম, ‘আয় করেন না।’ ‘কাজ করেন না’ বলিনি কিন্তু! উদয়াস্ত খাটেন তাঁরা। কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট নয়৷ কর্মপরিবেশ সর্বদা সুখকর নয়। পান থেকে চুন খসলে মানসিক নির্যাতন আছেই, কিন্তু তাকে ‘নির্যাতন’ বলে ডাকা বারণ। শারীরিক নির্যাতনও চলে৷ আর প্রাপ্য? বেতন নেই। বোনাস দূরস্থান। পাওয়া যায় শুধু খাদ্য, পরিধেয় আর বাসস্থান— সামন্তযুগের ভূমিদাস বা সার্ফরা যেমন পেতেন। একবারই ক্রীত হতেন তাঁরা, বাকি জীবন পরিষেবা পাওয়া যেত বিনামূল্যে। আশা করি বলে দিতে হবে না, এখন আমরা বাড়ির চার দেওয়ালে থাকা তথাকথিত ‘বেকার’ বা ‘কর্মহীন’ মেয়েদের কথা বলছি৷

    মার্ক্সিস্টরা কি গৃহশ্রম নিয়ে আলোচনা করেছেন? নিশ্চয় করেছেন, বিশেষত মেয়ে শ্রমিকদের গৃহশ্রমের কথা তাঁরা বলেছেন। ক্রুপ্সকায়ার বিখ্যাত প্যামফ্লেট ছিল ‘নারী শ্রমিকদের দুরাবস্থা।’ সেখানে আলবাৎ বলা ছিল, একদিকে বাড়ির কাজের চাপ, অন্যদিকে কারখানার অমানবিক কাজের চাপের সাঁড়াশি আক্রমণের কথা। অর্থাৎ এই বোধ ছিল যে, বহির্বিশ্বে একই কাজে নিযুক্ত নারী শ্রমিকের কাজের পরিমাণ আসলে পুরুষ শ্রমিকের দ্বিগুণ। এ সমস্যার সমাধান করার জন্য আলেক্সান্দ্রা কোলোন্তাই গৃহকাজের সমবায়ীকরণের ব্যবস্থা করেন সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পর। কমিউনিটি কিচেন, কমিউনিটি লন্ড্রি, কমিউনিটি সুইপারের ব্যবস্থা করতে তিনি চেয়েছিলেন। সফল হয়েছিলেন বড়োজোর দু-তিন বছরের জন্য। তারপর কিন্তু রাষ্ট্র এসব বাড়তি খরচ বরদাস্ত করেনি৷ এ ব্যবস্থা, বলা বাহুল্য, কোনো গৃহবধূর কথা ভেবে তিনি করেননি। করেছিলেন বহির্বিশ্বের ‘প্রোডাকশন’-এ বা উৎপাদনে অংশগ্রহণকারী নারীর সুবিধার জন্য। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, নারীকে গৃহকর্ম থেকে মুক্তি দিলে বাড়বে ‘প্রোডাকশন’। স্তালিন অবশ্য উলটো ভেবেছিলেন৷ তিনি হয়ত ভেবেছিলেন, নারীরা ঘরে ফিরে গৃহকে মনোরম রাখলে পুরুষকর্মী সুস্থভাবে কাজে আসতে পারবেন এবং গৃহাভ্যন্তরে নারী আরও বেশি সন্তান (=ভবিষ্যৎ শ্রমিক) উৎপন্ন করতে পারবে, কারণ তাঁর প্রণীত নীতিগুলি নারীকে ঘরে ফিরতেই উৎসাহ দেয়৷

    কিন্তু বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত কোনো মার্ক্সিস্ট তাত্ত্বিক বা প্রায়োগিক ক্ষেত্রে যা করেননি, তা হল, গৃহকর্ম বিষয়টাকেই শ্রমের তত্ত্বের আওতায় আনা। তা ঘিরে মার্ক্সিস্ট আলোকে বিস্তারিত তত্ত্বায়ন খাড়া করা। এইটে করা হলে কিন্তু, ধরে নিতেই হবে, গৃহবধূরাও শ্রমিক! বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এসে সে কাজও হল। তাত্ত্বিকভাবে। কিন্তু প্রয়োগ হল না।

    বেশি নেমড্রপিং-এর কচকচানিতে না গিয়ে বলা যায়, মার্ক্সিস্ট ফেমিনিস্টরা বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এনেছিলেন সোশ্যাল রিপ্রোডাকশন থিওরি৷ তাঁরা বলেছিলেন, প্রোডাক্টিভ লেবারই একমাত্র লেবার নয়। সন্তানপালন, সন্তানধারণ, গৃহকর্ম —সবই শ্রমসাধ্য। এগুলির নাম হোক রিপ্রোডাক্টিভ লেবার। লক্ষ্যণীয়, লেবার, অর্থাৎ ‘শ্রম’ কথাটির সঙ্গে এধরনের কাজকে যুক্ত করার অধিকার তাঁরা দাবি করছিলেন। প্রশ্ন উঠল, এতে ‘মোড অফ প্রোডাকশন’ কী? তারা বিস্তারে বোঝালেন। প্রশ্ন উঠল, কীই বা এক্ষেত্রে ‘প্রোডাক্ট?’ অর্থাৎ, কী উৎপন্ন হচ্ছে? রাঁধা ভাত? তকতকে উঠোন? তার সঙ্গে বাজারের কী সম্পর্ক? তাঁরা বললেন— বস্তুত, মার্গারেট বেনসন, ডায়েন এলসনরা বলেন— আছে প্রডাক্ট, যা বাজারের সঙ্গে অবশ্যই সম্পৃক্ত। প্রোডাক্টের নাম হল ‘লেবার পাওয়ার’। শ্রমক্ষমতা। আজ থেকে বাড়িতে রাঁধাবাড়া, কাপড় কাচা, ঘর নিকোনো বন্ধ হলে পুরুষ শ্রমিক কাজ করতে পারবেন তো? তাঁর কর্মক্ষমতা থাকবে তো?

    যৌনকার্যকে শ্রমের আরেক রূপভেদ ধরে যৌনকর্মী কথাটিও দীর্ঘদিন চালু হয়েছে। এই যৌন শ্রমও গৃহবধূ দিয়ে থাকেন অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষত যাঁদের ক্ষেত্রে নির্ধারিত বিবাহিত ব্যক্তিটির সঙ্গে পারস্পরিক যৌনক্রিয়া সুখকর নয়। সে শ্রমের প্রশ্নে আর গেলাম না৷ আপাতত পেশাগত ‘যৌনকর্মী’ শব্দটি ঘিরেও নানা বামপন্থীর নানা মত। অনেকে মনে করেন, এতে নারীর অবজেক্টিফিকেশনে মদত দেওয়া হয়। অবশ্য পুং যৌনকর্মীও আছেন শুনেছি। কিন্তু মোদ্দা কথা হল, নারীর অবমাননার কথা ভেবে যৌনপেশা উঠিয়ে দিতে তাঁরা পারেননি। যতদিন না পারবেন, ততদিন বেশ্যাপাড়ার মেয়েরাও হাড়ভাঙা খাটেন, এ-কথা মেনে নিতে আপত্তি কোথায়? সেক্ষেত্রে তাঁদেরও কিছু অধিকার আদায়ের দাবির পাশে দাঁড়ানো যায়৷ নাহলে, হয়ত বঞ্চনাতেই মদত দেওয়া হয়। রাষ্ট্রও কি সেটাই চায় না?

    ফিরি আবারও গৃহবধূদের প্রশ্নে। তাদের ‘হাউসওয়াইফ’ না বলে ‘হোমমেকার’ বলেই হাত ধুয়ে ফেলা যায় কি? ধরা যাক, একজন সরকারি কর্মীর স্ত্রী বাড়িতে রাঁধেন বাড়েন। সন্তান পালন করেন। তিনি নিজেকে ‘শ্রমিক’ মনে করেন না। ভাবেন, এ তাঁর মেয়েলি সাংসারিক দায়িত্ব৷ কিন্তু সাংসারিক সম্পদে তার অধিকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমান নয়। তাঁকে বরের কাছে হাত পাততে হয় খুঁটিনাটি প্রতিটি চাহিদার জন্য। এ নাকি তাঁরই সংসার, অথচ, কোনো কিছুই তাঁর হকের নয়। পুজোর শাড়িটি কাজের মেয়েও অধিকার ভেবে নেয়। কিন্তু তাঁকে শোনানো হতে পারে, ‘আমার টাকায় খাচ্ছ-পরছ…!’ তিনি মেনে নেন, কারণ তিনি জানেন না, তিনি আসলে ‘শ্রম’ দেন এবং শ্রমের একটা মূল্য আছে বাজারি দুনিয়ায়। হয়ত ভাল হত, দুনিয়া অর্থসর্বস্ব না হলে। কিন্তু স্নেহের মূল্য একমাত্র স্নেহ দিয়ে দেওয়া যাবে, ভালোবাসার মূল্য ভালোবাসায়, যত্নের মূল্য যত্ন দিয়ে, এমন কোনো নিয়ম করা সম্ভব নয় যখন, তখন আকাশকুসুম ভেবে লাভ কী? ভুলে গেলে চলবে না, ক্যাপিটালিজম এবং মার্ক্সিজম, পরস্পরবিরোধী দুটি তত্ত্বের একটিতেও তথাকথিত ‘ভাববাদী’ এসব অনুভূতির জায়গা নেই। উভয়ই অর্থনীতি-নির্ভর তত্ত্ব। পৃথিবীটা এরকমই থাকবে অদূর ভবিষ্যতেও, এমন মনে হয়। সোজাসাপ্টা শ্রম, মজুরি, হক, দাবির ভাষাই বাজার বোঝে। শুধু গৃহে মেয়েদের শ্রম চুরির সময় বস্তুবাদীও ‘ভাববাদী’ হয়ে পড়েন।

    অথবা, এখনও জিজ্ঞাসা করেন সেই একই থোড়বড়িখাড়া প্রশ্ন, এক্ষেত্রে প্রোডাক্ট কী, মোড অফ প্রোডাকশন কী? বেনসন, এলসন — ওই স্বল্প যে কজনের নাম করতে বাধ্য হলাম, নেমড্রপিং করব না ভেবেও— তাঁদের পড়েও দেখেন না৷ এগুলোর উত্তর তো পঞ্চাশ বছর আগে দেওয়া হয়ে গেছে! বারবার কেন বলতে হবে? আরও প্রশ্ন করেন, কে দেবে এদের টাকা? যে উৎপাদিত বস্তু (এক্ষেত্রে লেবার পাওয়ার) থেকে লাভ করছে! অর্থাৎ রাষ্ট্র। যদি সে টাকা কর্মী পুরুষের টাকাও হয়, তবে সরকার নিজে সেই অংশ কেটে তারপর কর্মীর হাতে দেবে। কোনো ব্যক্তি ‘স্বামী’-র হাত থেকে দয়ার দান হিসেবে সে টাকা কেউ নেবে না। এ-ও আমার কথা নয়, উক্ত তাত্ত্বিকদেরই ভাবনা।

    আন্তর্জাতিক ‘নারীদিবস’ বা ‘শ্রমজীবী নারীদিবস’ গৃহহিংসায় জর্জরিত সেই নারীরও হোক, যিনি পেশা বিসর্জন দিয়ে গৃহকর্ম করতে গিয়েছিলেন বলেই, স্বাবলম্বনের অভাবে আজ আর হিংসার পরিবেশ থেকে বেরোতে পারছেন না।

    তর্ক উঠতে পারে, এতে কি মেয়েদের ঘরে আরওই বেঁধে ফেলা হবে না? ‘ঘরেই তোমার কাজ, এখন তো তার জন্য মজুরিও পাচ্ছ, মজুরি পাচ্ছ যখন আরও মনোযোগ দিয়ে সেই কাজই করো’— এই দাবি উঠবে না? এখানে বুঝতে হবে, গৃহকর্মকে শ্রমের আওতায় এনে তত্ত্বায়নের সপক্ষে আমাদের মত, সে কর্ম পুরুষ যদি করেন, তিনিও যেন সে মজুরি পান! আবার মাইনে করা সহায়ক বা সহায়িকা পেলেও তো আপত্তি কিছু নেই। মার্ক্সিস্টরা হয়ত গৃহশ্রমের সমবায়ীকরণে ফিরে যেতে বলবেন। উত্তরে আমরা বলতে পারি, ফিরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত, অর্থাৎ ‘মহান বিপ্লবের’ আগে পর্যন্ত, যাঁরা সিসিফাসের পাথর ঠেলছে, তারা ঠেলুক, ঠেলুক, ঠেলতেই থাকুক, এ আবার কাজীর কেমন বিচার? তাছাড়া, এ কথাও ভুললে চলবে না, যেমন আগে বলা হয়েছে, সোভিয়েত দেশেও গৃহকর্মের সমবায়িকরণ হয়ে তারপর হয়েছিল ‘পুনর্মূষিক ভব।’

    এই এত্তগুলো কথা বলা গেল, কারণ আমরা চাই, আন্তর্জাতিক ‘নারীদিবস’ বা ‘শ্রমজীবী নারীদিবস’ গৃহহিংসায় জর্জরিত সেই নারীরও হোক, যিনি পেশা বিসর্জন দিয়ে গৃহকর্ম করতে গিয়েছিলেন বলেই, স্বাবলম্বনের অভাবে আজ আর হিংসার পরিবেশ থেকে বেরোতে পারছেন না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের বহির্বিশ্বে কাজের জগতে যোগ না দেওয়ার দায় তো তার একার নয়!

    বিত্তবতীর ‘নারী দিবস’ উপলক্ষে শাড়ি-গয়নার ঢল যেমন অন্তর্ভুক্ত করার বদলে বিযুক্ত করে অনেক নারীকে, তেমনই ‘শ্রমজীবী’ কথাটির পরিধি না বাড়ালে, তাও খুব একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় না! আর অন্তর্ভুক্তি না হলে, ‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি’ কেবল কথার কথা!

    _____

    *মতামত লেখকের নিজস্ব

     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @