No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    রাজনীতির ময়দানে ভাইরাল ‘খেলা হবে’ স্লোগান এল কোথা থেকে?

    রাজনীতির ময়দানে ভাইরাল ‘খেলা হবে’ স্লোগান এল কোথা থেকে?

    Story image

    ‘স্লোগান তুমি কার?’ – ঘটনাচক্রে সাম্প্রতিক সময়ে একটি স্লোগান হয়ে গেছে সব্বার। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার – ‘খেলা হবে’। আজ থেকে অনেক বছর আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “অস্তগিরির ওই শিখরচূড়ে/ ঝড়ের মেঘের আজ ধ্বজা উড়ে/ কালবৈশাখীর হবে যে নাচন/ সাথে নাচুক তোর মরণ-বাঁচন/ হাসি কাঁদন পায়ে ঠেলবি আয়/ আজ খেলা ভাঙার খেলা খেলবি আয়।” খুবই তাৎপর্যবহ কয়েকটি লাইন। পাঠক যদি মনোযোগসহ বারবার পাঠ করেন তাহলে কয়েকটা শব্দের উপর বেশ জোর পড়বে। যেমন- ধ্বজা, কালবৈশাখী ঝড়, মরণ-বাঁচন ইত্যাদি। এবার এই শব্দগুলো বসিয়ে দিন এখনকার রাজনৈতিক কনটেক্সটে। হুবহু মিলে যাচ্ছে না? যদিও রবীন্দ্রনাথের খেলা আর ২০২১ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর খেলা’র মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে। রবীন্দ্রনাথ এই গানে ব্যবহার করেছেন গতির ভাষা, উদ্দামতার ভাষা, প্রথা ভাঙার ভাষা। বর্তমান রাজনীতির সঙ্গে যার মিল নেই। ভারতীয় রাজ্য-রাজনীতিতে স্লোগানের ইতিহাস গভীর। সেসময় ‘ভাইরাল’ শব্দের উৎপত্তি হয়নি। নেতাদের ভালোবেসে সেইসব স্লোগান মানুষের মুখে মুখে ঠিক ছড়িয়ে পড়ত। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক—

    গান্ধিজি প্রদত্ত ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে', নেতাজির ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’, নকশাল আন্দোলনের সময় বিখ্যাত হয়ে যাওয়া একটি স্লোগান ‘পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার একশো বারো’, পরবর্তীতে ‘আবকি বার মোদি সরকার’, এটাকেই আবার কাউন্টার অ্যাটাক করে কংগ্রেস বলেছিল ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’। ছাত্র রাজনীতিতে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া একটি আন্দোলনের স্লোগান ছিল ‘হোক কলরব’। সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি কথা ‘দলে থেকে কাজ করতে পারছি না’। এছাড়াও ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বা ‘আজাদি’র মতো স্লোগানের ইতিহাস তো আরও পুরোনো।

    সহজ পাঠ, প্রথম ভাগের একটি অংশ 

    বাংলার রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে এবার যুক্ত হয়েছে ‘খেলা হবে’। এ খেলা ভোটের। হারা-জেতার খেলা। কিন্তু এই স্লোগানের উৎপত্তি আসলে কোথা থেকে? শাসক দলের মতে এই স্লোগান তাঁদের। পাশাপাশি বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম-এর অনেক নেতাদেরও বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘পাল্টা খেলা হবে’। মৌখিকভাবে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যাওয়া এই ‘খেলা হবে’ স্লোগান বীরভূমের একটি সভা থেকে তুলেছিলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। খুব সম্প্রতি তৃণমূল নেতা মদন মিত্রকেও এই স্লোগান বলতে শোনা যায়। যদিও তারও আগে উত্তরবঙ্গের এক সভায় ‘খেলা হবে’র একটি দীর্ঘায়িত রূপ দিয়েছিলেন তরুণ তৃণমূল নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য।

    দেবাংশু লিখেছেন, “বাইরে থেকে বর্গি আসে, নিয়ম করে প্রতি মাসে/ আমিও আছি, তুমিও রবে, বন্ধু এবার খেলা হবে/ কন্যাশ্রী বোনটা আমার হচ্ছে যখন ইঞ্জিনিয়ার/ যুদ্ধ সে বোন জিতেই লবে, বন্ধু এবার খেলা হবে...

    দেবাংশু ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক, তৃণমূল যুব কংগ্রেস

    এখন প্রশ্ন হচ্ছে, স্লোগান তুমি কার? উত্তর দিচ্ছেন দেবাংশু নিজেই। বছর পাঁচেক আগে বাংলাদেশের প্রবীণ সাংসদ শামিম ওসমান এক জনসভায় বিরোধীদের কটাক্ষ করে বলেছিলেন, “খেলা হবে, ২৪ তারিখের পর খেলা হবে।” সেই স্লোগান ২০২১ সালে এসে পড়ল বাংলার মাটিতে। দেবাংশু জানাচ্ছেন, “বাংলাদেশের এক নেতা এই শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন বহুদিন আগে। কিন্তু এই নিয়ে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমি প্রথম এই স্লোগান লিখে, সুর দিয়ে, সকলকে নিয়ে কোরাস করে, গেয়ে পোস্ট করি গত ৭ জানুয়ারি। যার শুটিং হয়েছিল আমার কোচবিহার সফর চলাকালীন। তারপর এর ডিজে ভার্সান আসে, যেটা আমারই গলা। এটি ভাইরাল হওয়ার পর প্রত্যেক নেতা-নেত্রী এটি ব্যবহার করা শুরু করেন।”

    দেবাংশু আরও বলছেন, “আমায় যাঁরা চেনেন তাঁরা জানেন, রাজনৈতিক বিতর্কে কবিতা, গত লোকসভায় বহুল প্রচারিত ‘মমতাদি আরেকবার’ থেকে ‘দিল্লি যাবে হাওয়াই চটি’র মতো স্লোগান ইত্যাদি বিষয় নিয়ে একটু অন্য স্বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি রাজনীতির ময়দানে।”

    বছর পাঁচেক আগে বাংলাদেশের সাংসদ শামিম ওসমান বিরোধীদের কটাক্ষ করে প্রথম বলেছিলেন, “খেলা হবে”

    তরুণদের কণ্ঠস্বরে খুব স্বতঃস্ফূর্ত কিছু স্লোগান প্রতিটা সময়ের চিহ্ন হয়ে থেকে গেছে। দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওঠা স্লোগান ‘হাম ছিনকে লেঙ্গে আজাদি’ কিংবা কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হোক কলরব’ একসময় নাড়িয়ে দিয়েছিল আপামর জনসাধারণকে। কিছু মাস আগে পাকিস্তানের কবি ফায়েজ আহমেদ ফায়েজের একটি কবিতার বাংলা তর্জমা সাড়া ফেলেছিল সিএএ-এর প্রতিবাদ মিছিলে।

    যুগ পাল্টায়। দশক পাল্টায়। তার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যেতে থাকে রাজনীতির ভাষা। সেই ভাষায় চলে আসে গান-কবিতার ব্যবহার। ‘বারান্দায় রোদ্দুর’ থেকে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ কিংবা হাল আমলের ‘টুম্পা সোনা’ থেকে ‘পুটকি ভাই’ – পাড়ার পুজো, বিয়েবাড়ি সবেতেই চলেছে ও চলবে। সাম্প্রতিক ‘খেলা হবে’র ডিজে ভার্সেনও এবছর সরস্বতী পুজোয় বিভিন্ন জায়গায় শোনা গেছে, বাদ যায়নি বিয়েবাড়িও। বিজেপির রাজ্য সভাপতি যখন বলেন, “স্ট্রাইকার, ডিফেন্ডার সব আমাদের দলে। খেলব তো আমরাই।” অন্যদিকে বিজেপি সাংসদ রূপা গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “আমরা বলি দেখা হবে। আবার দেখা হবে। বারেবারে দেখা হবে।” তখন তার পাল্টা উত্তর দেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেন, “রাজনীতির খেলা। গণতন্ত্রের খেলা। দেখা যাক কে হারে কে জেতে। আপনারা থাকবেন। ব্রিগেডে এক দিকে জগাই, মাধাই আর গদাই। অন্য দিকে আমি। আমি গোলরক্ষক। দেখি ক’টা গোল আপনারা দিতে পারেন!”

    ‘খেলা হবে’র ঠিক আগেই তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ‘টুম্পা’

    রাজনীতিতে এরকম কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরি হতেই থাকবে। পাল্টা যুক্তির খেলায় মানুষ খুঁজে নেবে তার সঠিক পথ। ‘খেলা হবে’র স্লোগান পৌঁছে গেছে বাংলার আনাচে-কানাচে। সাম্প্রতিক কয়েকটি হেডলাইনের দিকে চোখ যাক।

    ১. “মশা মারার ব্যাটে লেখা, ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে মশার সাথে খেলা হবে”
    ২. “সরস্বতী পুজোয় শিক্ষাঙ্গন কাঁপাল— খেলা হবে”
    ৩. “খেলা হবে স্লোগান ঝড় তুলেছে কালনার এক দম্পতির জীবনে”
    ৪. “গণবিবাহের আসরেও ভোট— খেলা হবে তরজা”
    ৫. “পাড়ার ফুটবল ম্যাচের প্রচারে ‘খেলা হবে’ হোর্ডিং”

    এসবই গত কয়েকদিনের খবরের হেডলাইন। রসিকজনেরা আবার ফোড়ন কাটছেন, আসল খেলা তো এখনও শুরুই হয়নি। এসব বাকবিতণ্ডা, উৎপত্তির জটিলতার পরেও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে রাজনৈতিক স্লোগান যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝাই যাচ্ছে। এখন মানুষ একটু ভালো থাকার জন্য খুঁজে নেবে সঠিক গণতন্ত্র। বাকিটা তোলা রইল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @