No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    উৎপল দত্ত যখন চিৎপুর যাত্রাপাড়ার অন্যতম সফল সম্রাট

    উৎপল দত্ত যখন চিৎপুর যাত্রাপাড়ার অন্যতম সফল সম্রাট

    Story image

    ৯৯০-এর একদিন বেলা এগারোটা হবে। আজাদগড় পোস্ট অফিসের আগের রাস্তায় ঢুকলে ‘কল্লোল’ নামের সেই ঐতিহাসিক বাড়ি। আমি চিরকুটে এইদিন এই সময়ে আপনার কাছে কিছু প্রশ্ন করায় বাড়িতে আসতে বলেছিলেন। ঐ ভদ্রলোক ফিরে বললেন সাহেব ওপরে যেতে বলেছেন। কল্লোলে ঢোকার মুখে অবশ্য বারান্দায় তাঁর বিখ্যাত রকিং চেয়ারে বসে থাকতে দেখে ফেলেছি। ওঁর কাছে পৌঁছাতে বসতে বললেন। নানান কথার পরে সভয়ে বললাম, আপনার প্রত্যেকটা নাটক সেই সময়ের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে নিয়ে বিশেষ লেখালেখি হয় না। “আপনি কি রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ বইটির মতো উৎপল দত্ত ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ লিখতে চান নাকি?” বলে স্বভাবসুলভ জোরে হেসে উঠলেন উৎপল দত্ত (Utpal Dutt)। আমি ঘাবড়ে গিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বললাম ক্ষমতা থাকলে লিখতে চেষ্টা করতাম! এরপরেই বললাম আপনার যাত্রা নিয়ে বিশেষ আলোচনা নেই। হেসে বললেন, ছোটোলোকেদের যাত্রা নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ঘৃণা রয়েছে। তারা যাত্রার সুতীব্র আবেগ, ঘটনার ঘনঘটা গ্রহণ করতে পারেন না। দশ বিশ হাজার দর্শকের উত্তেজনা ইত্যাদি! এরপর তিনি জার্মান পরিচালক ব্রেখট বিশেষজ্ঞ ফ্রিৎস বেনেভিৎসের কলকাতায় ‘গ্যালেলেই’ নাটকের প্রসঙ্গ তুললেন। এ নাটকে শম্ভু মিত্র থেকে বাংলা নাট্যজগতের তাবড় অভিনেতারা ছিলেন। উৎপলবাবু বললেন, সে নাটকের প্রোগ্রাম পড়ে দেখি কী ভয়াবহ ভাবে বাংলার যাত্রাকে আক্রমণ করা হয়েছে! আপনার টিনের তলোয়ার নাটকের শুরুর কনসার্ট তো যাত্রার মতো। বিবেকের গান!

    উৎপল দত্ত বললেন নিশ্চয়ই, ১৯৬৮ থেকে যাত্রায় কাজ করার প্রভাব সেটা। কথা শেষ করেই জিগ্যেস করলেন আপনি কি যাত্রা দেখেছেন কখনও? আমার শীতের ছুটিতে গ্রামে দূরে দূরে এক সময় ছুটে ছুটে গেছি সে অভিজ্ঞতার কথা জানাতে মনে হল এবার অনেকটা নরম হয়েছেন। তিনি বললেন, “বাবা শ্রী গিরিজা রঞ্জন বহরমপুর জেলের জেলার ছিলেন। সে সময় আমি অনেক যাত্রা দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম।” এর পরেই মুচকি হেসে বললেন, “আপনি আমার ওপর গবেষণা করবেন ভাবছেন তো! শোভা ঠিক আপনাকে দলের কাজে লাগিয়ে দেবে দেখবেন!” বলতে বলতে শোভাদি এলেন। উৎপল বাবু, সেদিনের পরিচয়ে তো উৎপলদা বলা যায় না। “শোভা এই ছেলেটি আমার লাইব্রেরিতে পড়ার সুযোগ পায় যেন।” আমার তখন আত্মহারা আনন্দ। শোভাদি প্রথমেই বললেন, তুমি তো রেডিওতে কাজ করো, তোমার নাটকে আমি অভিনয় করেছি। আমাদের সাউন্ড করে শামিমের সঙ্গে শোগুলোতে থেকো। উৎপলদা এবার হেসে বললেন, দেখলেন আগেই আপনাকে বলেছিলাম না! সেদিন প্রায় দেড় ঘণ্টা কথা বলেছিলাম। ২৭ বছরের টগবগ তরুণ আমি হাতে চাঁদ নিয়ে কল্লোল থেকে বেরিয়ে এলাম। আমৃত্যু তাঁর সান্নিধ্য পেলেও অত কথা আর হয়নি। যে সব টুকরো টুকরো কথোপকথন তা বলার জায়গা নয়।

    সায়াটা প্রায় গলা পর্যন্ত তুলে একটা গামছা গায়ে জড়িয়ে বসলেন এক সময়ের বাংলা কাঁপিয়ে বেড়ানো বীণা ঘোষ। উৎপলদার নামে কপালে দু-হাত জড়ো করে প্রণাম করলেন। অনেক কথার মাঝে মোদ্দা কথা হলো তাঁর মতো শিক্ষক পাননি কখনও।

    যাত্রা জগতের বিখ্যাত অভিনেত্রী-শিষ্যা বর্ণালী ব্যানার্জির সঙ্গে গুরু উৎপল দত্ত

    ১৯৯৩-এ তাঁর মৃত্যুর পরে এপিক থিয়েটার উৎপল দত্ত স্মারক সংখ্যার জন্য কিছু সাক্ষাৎকার নেওয়ার দায়িত্ব পেয়ে যাত্রার বিশিষ্ট শিল্পী বীণা ঘোষের কাছে যাই। কুমোরটুলি পার্কের উল্টো দিকে বারো ঘর এক উঠোন এক বাড়ির ভগ্নপ্রায় সিঁড়ি বেয়ে উঠে দেখি অতি সংকীর্ণ একটা ঘরে মাদুরের ওপর উদলা পিঠে এক ভারি চেহারার মহিলা শুয়ে আছেন। একটি ছেলে হাত টিপে দিচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখলেন। খানিক বিব্রত! আমি বললাম, শোভাদি পাঠিয়েছেন। শুনেই সায়াটা প্রায় গলা পর্যন্ত তুলে একটা গামছা গায়ে জড়িয়ে বসলেন এক সময়ের বাংলা কাঁপিয়ে বেড়ানো বীণা ঘোষ। উৎপলদার নামে কপালে দু-হাত জড়ো করে প্রণাম করলেন। অনেক কথার মাঝে মোদ্দা কথা হলো তাঁর মতো শিক্ষক পাননি কখনও। এক বর্ণ ইংরেজি না জেনে কী গড়গড় করে ইংরেজি সংলাপ বলিয়ে নিয়েছেন সাহেব!

    একই কথা বর্ণালী ব্যানার্জি বলছেন সন্ন্যাসীর তরবারি, ঝড় বৈশাখী মেঘ, সীমান্ত, তুরুপের তাস, মুক্তিদীক্ষা পালার কথা। অনাদি চক্রবর্তী বলছেন, চিৎপুর যাত্রা, সমাজের সফলতম রাজনৈতিক যাত্রা পালাকার পরিচালক উৎপল দত্ত। তাঁর সঙ্গে যাঁরাই কাজ করেছেন সেরা শিক্ষক এবং গুরু প্রতিম মেনেছেন। ১৯৯৩ সালে উৎপল দত্তের মৃত্যু। সে বছর শেষের দিকে বাংলা যাত্রার সুদক্ষ অভিনেতা, উৎপল দত্তের অত্যন্ত প্রিয় অভিনেতা বিশিষ্ট যাত্রা  পরিচালক শেখর গাঙ্গুলির সঙ্গে আলাপ হল। আমি উৎপলদার সঙ্গে কিছুদিন কাছাকাছি ছিলাম শুনে মাঝে মাঝেই রেডিওতে চলে আসতেন। তাঁর কাছেই শোনা চিৎপুরে উৎপলদা যাওয়ার আগে যাত্রায় স্টার সিস্টেম ছিল। তাঁদের খেয়াল মতো দল পরিচালনা হত। অভিনীত চরিত্রের সংলাপের মাপ মতো মাছের সাইজের ভেদাভেদ। অভিনেত্রীদের প্রাপ্য সম্মান তিনিই দলের মালিকদের সঙ্গে যুক্তিতর্কে প্রতিষ্ঠা করার ফলে তাঁর বাইশটা পালার (১৯৬৮-৮৮) প্রত্যেকেই তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ! চুক্তি মতো ১৫ দিন অহর্নিশি মহলা হবে। এর মধ্যেই পালা প্রস্তুত। চিৎপুর যাত্রাপাড়ায় পরিচালকের উত্থান এবং তাঁর নেতৃত্ব একটি ঐক্যবদ্ধ শিল্পী সমাবেশ!

    যাত্রাশিল্পের শক্তিশালী অভিনেতা শেখর গাঙ্গুলির সঙ্গে উৎপল দত্ত

    শেক্সপিয়ারের সময়ের প্রযোজনা, উৎপল দত্তের নাটক আর যাত্রা প্রকৃত পক্ষে একই, এ উপলব্ধি তাঁর ছিল। তিনি যাত্রার ফ্ল্যাট মঞ্চে প্রথম লেভেল এবং রস্ট্রাম ব্যবহার করেছিলেন। এক এক লেভেলে বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ চরিত্র অভিনয় করবে। আলোর পরিমিত ব্যবহার তাঁর অবদান।

    মহান নট পঞ্চু সেনের উদ্যোগে তিনি যাত্রার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁকে গুরু মেনেছিলেন। পঞ্চুবাবুর প্রস্তাবে প্রাথমিক ভাবনার রাইফেল পালা ছেড়ে সাত দিনে নতুন রাইফেল পালা লিখেছেন। যাত্রায় জড়ানোর আগে তিনি ব্রজেন দে ভৈরব গাঙ্গুলি শম্ভু বাগের সব যাত্রা পড়ে ফেললেন। জয়নগরে গিয়ে ব্রজেন দে-র অন্যতম সেরা পালা বাঙালি-তে পঞ্চু সেনের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন, “টপ ভল্যুমে কথা বলছেন, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন ফিসফিস করে কথা বলছেন।” তিনি বলছেন, বাংলার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যাত্রাতেই আছে। শ্রেষ্ঠ টালেন্ট। অ্যামেচারিজমের স্থান নেই। টপ টু বটম প্রফেশনাল। আমার যাত্রাপালার প্রম্পটে অভ্যস্ত। তিনদিন মন দিয়ে শুনলো তারপর তাঁদের বিস্ময়কর অভিনয়! কত সহজে চরিত্র বুঝে নিতে পারতেন। আমরা মনে করে নিই তাঁর বাইশটা পালার একমাত্র ‘ভুলি নাই প্রিয়া’, ‘রোমিও জুলিয়েট’ আশ্রিত যাত্রা। বাকি সব বিদ্রোহের আখ্যান। তিনি বলছেন, দিনের শেষে ক্লান্ত শরীর, দরিদ্র কয়লা খনি কি চা বাগানের শ্রমিক বা চাষাভুষো মানুষ শ্রমার্জিত টাকায় টিকিট কাটে। তাঁদের কাছে এটা প্রায় ধর্মীয় রিচ্যুয়াল। তারা ট্র্যালজেডি পছন্দ করে। তার আগে বিদূষকের ভাঁড়ামিতে মজা পায়। তবু্ও ট্র্যা জেডি চাই। আবার গণনাট্য সংঘের ‘বিসর্জন’ দর্শকেরা প্রত্যাখ্যান করছে। ক্ষুব্ধ হচ্ছে। কালী প্রতিমার অবমাননা, দর্শকের চেতনায় অন্তর্লীন ধর্মীয় সংস্কার। উৎপল দত্তের যাত্রা লিখনে তাও সম্মানিত। তাঁর প্রত্যেকটা পালায় যাত্রার পুরোনো ধারা এবং প্রবীণ অভিজ্ঞ অভিনেতাদের উপদেশ মেনে বিদ্রোহ, সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়েই লেখা। সাফল্য পেয়েছিলেন অবশ্যই, না হলে চিৎপুর তাঁকে বাইশটা পালায় ব্যবহার করতো না।

    প্রখ্যাত যাত্রাভিনেতা মুকুন্দ দাসের সঙ্গে একটি অন্তরঙ্গ মুহূর্তে উৎপল দত্ত

    শেক্সপিয়ারিয়ান থিয়েটার প্রাথমিক চর্চা ও দীক্ষা পরবর্তী কালে বিশেষজ্ঞ, ভারতীয় গণনাট্য সংঘে আট মাসের নাট্যযাপনে তিনি বলছেন ঘুম ভেঙে গেলো, প্রসেনিয়ামের সামনে কিছু দর্শক আর হাজার হাজার মানুষের সামনে নাটক তাঁর জীবনে অত্যন্ত গভীর প্রভাব ফেলেছিল। শেক্সপিয়ারের সময়ের প্রযোজনা, উৎপল দত্তের নাটক আর যাত্রা প্রকৃত পক্ষে একই, এ উপলব্ধি তাঁর ছিল। তিনি যাত্রার ফ্ল্যাট মঞ্চে প্রথম লেভেল এবং রস্ট্রাম ব্যবহার করেছিলেন। এক এক লেভেলে বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ চরিত্র অভিনয় করবে। আলোর পরিমিত ব্যবহার তাঁর অবদান। এবং প্রশান্ত ভট্টাচার্যের মতো সংগীতকার। মার্গ সংগীত, পাশ্চাত্য সংগীত এবং লোকসংগীতে অভিজ্ঞ এই শিল্পীকে বাংলার যাত্রা জগতে তিনিই প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। টিনের তলোয়ার নাটকের অডিও যা পাওয়া যায় পাঠক প্রশান্তবাবুর সুর সৌকর্যের স্বাদ পেতে পারেন।

    বাংলা যাত্রা শিল্পে রাজনৈতিক যাত্রা পালার অভ্যুদয় ঘটে উৎপল দত্তের হাতে। যাত্রার ইতিহাসে উৎপল দত্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়!
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @