No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    আমার শরীর, আমার অধিকার : প্রতিবাদের ভাষা যখন নগ্নতা

    আমার শরীর, আমার অধিকার : প্রতিবাদের ভাষা যখন নগ্নতা

    Story image

    পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে কোনও পোশাকের প্রয়োজন পড়ত না মানুষের। ‘সভ্য’ হয়ে উঠবার প্রাথমিক পর্যায়ে, একজন নারী বা পুরুষ শরীরের যে যে অংশ মানুষ ঢেকে রাখার প্রয়োজন মনে করতো, সেটুকুই ঢাকতো। লজ্জা নিবারণ কিংবা শীত থেকে বাঁচতে। পরিধানের দৈর্ঘ্য বা পরার ধরন নিয়ে কোনও দাদাগিরি ছিল না। পুরোটাই ছিল প্রাকৃতিক। গাছের পাতা, ছালবাকল, পশুর লোমশ চামড়া থেকে বেরিয়ে এক সময় পোশাকের নান্দনিক দিক বা উৎপত্তিগত দিক নিয়ে ভাবতে শুরু করে মানুষ। বিপত্তি ঘটলো পোশাকের মধ্যে যখন পিতৃতন্ত্র ঢুকে পড়লো। প্রকোপ পড়লো মেয়েদের ওপর। তাদের জন্য তৈরি হলো বিভিন্ন ‘প্রোটোকল’, চাপানো হলো শালীনতা রক্ষার দায়ভার।

    মানুষের পোশাক বিবর্তনের এই ইতিহাস কম-বেশি সকলেরই জানা। কিন্তু মনে রাখে কজন? অনেক কিছুর উত্তরই এই একুশশতকীয় সভ্য সমাজের কাছে নেই। তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ মন থেকে মেনে নিতে পারে না, মেয়েদের ওপর শালীনতা রক্ষার দায়ভার জোর করে চাপানো হয়েছিল পুরুষদের কামনাকে দমন করা যাবে, এই ছুতোয়। এহেন মগজধোলাই থেকে মানবসমাজ পরিত্রাণ পায়নি আজও। আমরা এমন এক সভ্যতায় বেঁচে আছি, যেখানে ধর্ষণের মতো অমানবিক ঘটনায়, ভিক্টিমের ক্ষত ও তাঁর পোশাকের দৈর্ঘ্য নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা চলে। খাওয়া-পরা, হাঁটা-চলা, ভাবভঙ্গী নিয়মমাফিক না হলেই সে ‘বেশ্যা’! আর দেহোপজীবিনীরা তো সমাজের কাছে না-নারী, না-মানুষ। শুধুই ‘স্ল্যাং’। এভাবে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়।

    কেউ কেউ অবশ্য ঘুরে দাঁড়ায়। রক্ষণশীল পোশাক খুলে ছুড়ে মারে সমাজের মুখে। সারা পৃথিবী জুড়ে আজ তাই প্রতিবাদের অন্য এক ভাষা—নগ্নতা। যাঁরা চোখে কৌপীন পরে থাকেন, তাঁদের চোখ খুলে দিতে উলঙ্গ বুকে-পাছায় ম্যানিফেস্টো লিখে দল বেঁধে প্রতিবাদে সামিল হচ্ছে মেয়েরা। বলছে, ‘পোশাক আমরা পরেই ছিলাম, খুলতে বাধ্য করলে তোমরা’।

    সামাজিক অধিকার পেতে সমাজবিপ্লবীরা নগ্ন হয়েছেন বহু বার। কারণ যে সব সময় যৌন নির্যাতন, তা নয়। প্রতিবাদের কারণ হিসেবে কখনও জায়গা করে নিয়েছে জমির অধিকার, কখনও জলবায়ু পরিবর্তন, কখনও বা যুদ্ধ বিরোধিতা। পোশাকে পশমের ব্যবহারের প্রতিবাদ— তার জন্যও নগ্ন হয়েছেন পশু অধিকার আন্দোলনকর্মীরা। ফ্রান্সে তো বটেই গোটা বিশ্বে চলেছে সেই আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা শরীরে একটি সুতোও না রেখে পরেছিলেন শুধু পশুর মুখোশ।

    তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ মন থেকে মেনে নিতে পারে না, মেয়েদের ওপর শালীনতা রক্ষার দায়ভার জোর করে চাপানো হয়েছিল পুরুষদের কামনাকে দমন করা যাবে, এই ছুতোয়। এহেন মগজধোলাই থেকে মানবসমাজ পরিত্রাণ পায়নি আজও।

    ২০০৪ সালে মণিপুরে ১২ জন মহিলা নগ্ন হয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। ইম্ফলে কাঙ্গলা ফোর্টের সামনে প্রকাশ্যে নগ্ন হন তাঁরা। শরীর ঢাকেন একটি কাপড়ের ব্যানারে। তাতে লেখা ছিল, ‘ভারতীয় সেনা আমাদের ধর্ষণ করো।’ মণিপুরের ওই নগ্ন প্রতিবাদ ছিল অসম রাইফেলসের বিরুদ্ধে। মনোরমা নামে এক যুবতীকে জেরা করার নামে বাড়ি থেকে তুলে ধর্ষণ করে খুন করার অভিযোগ উঠেছিল অসম রাইফেলসের কয়েক জন জওয়ানের বিরুদ্ধে। নগ্ন হয়ে প্রতিবাদকারী মণিপুরের ওই ১২ জন মহিলাকে ‘মণিপুরের মা’ বলা হয়েছিল সেই সময়ে। প্রতিবাদের সময় তাঁরা বলেছিলেন, ‘‘আমরা সবাই মনোরমার মা। আমাদেরও নিয়ে যাও, ধর্ষণ করো, মেরে ফেলো।’’

    জমির অধিকার চেয়ে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ আন্দোলনে নেমেছিলেন উগান্ডার মেয়েরা। কৃষিজমি হাতছাড়া হওয়ার প্রতিবাদে উগান্ডার আমুরু জেলার মেয়েরা পোশাক খুলে পথে নামেন। ইরাকের যুদ্ধ থামাতে চেয়ে নগ্ন হয়েছেন মানুষ। ফ্লোরিডার পাম সৈকতে নগ্ন হয়ে শান্তির প্রতীক তৈরি করেছিলেন তাঁরা। পোশাক খুলে প্রতিবাদ সামিল হয়েছিলেন হাজার খানেক মানুষ।

    ২০১৬ সালের ২৯ জুন কেমব্রিজের এক শিক্ষাবিদ অর্থনীতি বিশারদদের বৈঠকে ঢুকে পড়েন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে। তাঁর শরীরে লেখা ছিল ‘ব্রেক্সিট ব্রিটেনকে নগ্ন করে দেবে’। আর্জেন্টিনার বুয়েনাস আইরেসে মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসার প্রতিবাদে পোশাক খুলে পথে নেমেছিলেন শতাধিক মহিলা।

    এক রূপান্তরকামী তাঁর অধিকার রক্ষার জন্য নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আমেরিকার টেনেসিতে। ড্রাইভিং লাইসেন্সে তাঁর লিঙ্গে পুরুষের বদলে মহিলা লেখার অনুরোধ করেছিলেন তিনি। যা মানতে চাননি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। প্রতিবাদে পোশাক খুলে ফেলেন তিনি। সে কাজের জন্য অবশ্য তাঁকে জেলেও যেতে হয়।

    অতি সংরক্ষণশীল বলে পরিচিত আরবেও হয়েছে নগ্ন প্রতিবাদ। নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার দাবিতে আরবের মহিলারাও নিজেদের নগ্ন ছবি পোস্ট করেছিলেন ইন্টারনেটে। আবার নেহাত ঊর্ধ্বাঙ্গের আবরণ থেকে মুক্ত হতে চেয়েও পোশাক খুলেছেন আন্দোলনকারীরা। তাঁদের দাবি ছিল, পুরুষদের মতো তাঁরাও বিনা বাধায় ঊর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত করতে চান। সমাজে পুরুষ নারী দু-পক্ষেরই সমানাধিকার থাকা উচিত।

    নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানানোর ঘটনা সবচেয়ে বেশি বোধহয় দেখেছে ফ্রান্সই। বছর খানেক আগে বেতন পরিকাঠামোর বদলের প্রতিবাদেও সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পথে নেমেছিলেন সরকারি কর্মচারীরা। নগ্ন হয়ে একে অন্যের কাঁধে চেপে তৈরি করেছিলেন নগ্ন মানুষের পিরামিড। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছিলেন ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক মন্ত্রী। তাঁকে ওই ‘ন্যুড পিরামিড’-এর মুখোমুখি হতে হয়।

    নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানানোর ঘটনা সবচেয়ে বেশি বোধহয় দেখেছে ফ্রান্সই। বছর খানেক আগে বেতন পরিকাঠামোর বদলের প্রতিবাদেও সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পথে নেমেছিলেন সরকারি কর্মচারীরা। নগ্ন হয়ে একে অন্যের কাঁধে চেপে তৈরি করেছিলেন নগ্ন মানুষের পিরামিড।

    বছর দুয়েক আগে, ফ্রান্সে ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের আসরে নিয়মমতো ছবির কুশীলবদের স্বাগত জানাতে পাতা হয়েছিল লাল গালিচা। কানের সেই চোখ ধাঁধানো লাল গালিচাতেই আচমকা পোশাক খুলে ফেললেন এক অতিথি। নগ্ন হয়েই গালিচার দুপাশে দাঁড়ানো ফোটোগ্রাফারদের সামনে চলে আসেন তিনি। পরনে ছিল শুধু নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাস। তাতে আঁকা ছিল রক্তের দাগ। অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে নীল হলুদ রঙের উপর লেখা ছিল— ‘আমাদের ধর্ষণ কোরো না’। ইউক্রেনের নীল হলুদ পতাকার রঙে শরীর রাঙিয়েছিলেন তরুণী। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির মহিলাদের উপর রুশ সেনার যৌন অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই কানের মতো আন্তর্জাতিক মঞ্চকে ব্যবহার করেন তিনি। গোটা দুনিয়ার সামনে আবরণ মুক্ত করেন নিজেকে।

    ২০২৪-এর ২৫ নভেম্বর ফ্রান্সে উদযাপিত হয় মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসা নির্মূল দিবস। সেই উপলক্ষে প্যারিসের রাস্তায় জড়ো হন FEMEN-এর সদস্যরা। মহিলাদের অধিকার রক্ষা এবং লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে লড়াই করে এই ফ্রেঞ্চ সংগঠন। প্যারিসের ল্যুভরে মিউজ়িয়ামের সামনে জড়ো হতে দেখা যায় শতাধিক মহিলাকে। ফরাসি, ইংরেজি এবং কুর্দিশ ভাষায় লেখা পোস্টার হাতে আন্দোলনে সামিল হন তাঁরা। তাঁদের কারও দেহের ঊর্ধ্বাঙ্গে পোশাক ছিল না। সকলের গলায় ছিল দৃপ্ত স্লোগান, ‘ফাম্মে, ভায়, লিবার্তে’। যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা।’

     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @