No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    আমার পিঠে শপাং শপাং শব্দে আলপনা এঁকে দিল দাদা

    আমার পিঠে শপাং শপাং শব্দে আলপনা এঁকে দিল দাদা

    Story image

    প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট পুব দিকে এগিয়ে গুলতির কাঠের মতো দু’দিকে বেঁকে গেছে। ডান দিকের রাস্তাটা গিয়ে পড়েছে বৌবাজার স্ট্রিটে। আর বাঁদিকের রাস্তাটা সোজা আমহার্স্ট স্ট্রিটে মিশেছে। ওই তিন রাস্তার মোড়ে ছিল একটা শিবমন্দির, একটা চায়ের দোকান আর মিনি কচুরির দোকান। বাতাসের চেয়ে সামান্য বড় সাইজের কচুরি, সঙ্গে শালপাতার ঠোঙায় হালুয়া। আর তার পাশেই ছিল তেলেভাজার দোকান, পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান। সে দোকানগুলোতে সবুজ রঙের সোডা ওয়াটারের বোতল। বোতলগুলোর মুখে ভিতর দিকে একটা মার্বেল আটকে থাকত। সেই মার্বেলে চাপ দিলেই ভস করে গ্যাস বেরিয়ে আসে।

    সেই মোড়েই সেজেগুজে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত কতগুলো মেয়ে। মোড়ে ভিড় জমানো লোকজনেরা ওই সোডা গ্যাস গলায় ঢালত। কিংবা কিনে নিয়ে ঐ সেজে-গুজে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের মধ্যে কোনও একজনের হাত ধরে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যেত। নানা বয়সের মেয়েদের ভিড় দেখতে পেতাম। এমনকি, ছোটদির চেয়ে সামান্য বড় মেয়েরাও স্নো পাউডার মেখে, ঠোঁটে রং লাগিয়ে দরজায় দরজায় দাঁড়িয়ে থাকত। চোখের ইশারায় একে-ওকে ডাকত। সকালবেলা দাদা প্রায়ই আমার হাতে পয়সা দিয়ে মুড়ি কিনে আনতে পাঠাত চা খাওয়ার আগে। তখন রাস্তায় বেরিয়ে দেখতাম, সেই মেয়েগুলো কেউ দরজায় বসে আড্ডা মারছে, কেউ তামাক দিয়ে দাঁত মাজছে আর ঠোঁটের কষ বেয়ে লাল লালা গড়িয়ে পড়ছে। কাউকে কাউকে আবার সিগারেট টানতেও দেখেছি। মেয়েগুলোর কাউকেই আমার সুন্দরী বলে মনে হত না তখন। অথচ, বিকেল হতে না হতেই এরা স্নো পাউডার আর ঠোঁটে রং মেখে সুন্দরী হয়ে দরজায় কীসের অপেক্ষায় যেন হা-পিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে থাকত, আমি ভেবেই পেতাম না।

    আর, মাঝে মাঝেই দেখতাম খাকি হাফপ্যান্ট আর লাল পাগড়ি মাথায় পুলিশ এসে সন্ধেবেলা ওদের ঘরে হানা দিত। মেয়েগুলোকে ঘর থেকে টেনে বের করে ধরে নিয়ে যেত পুলিশ। সঙ্গে দেখতাম কিছু পুরুষমানুষকেও ওদের সঙ্গে ধরে নিয়ে যেতে। ওইসব পুরুষমানুষগুলোকে কেমন চোর চোর মনে হত। ওরা কি মেয়েগুলোর ঘরে চুরি করতে ঢুকেছিল? তাহলে মেয়েগুলোকেও ওভাবে নিয়ে যাচ্ছে কেন? কিছুই বুঝতাম না, কিন্তু, মেয়েগুলোকে ওভাবে ধরে নিয়ে যেতে দেখলে আমার খুব কষ্ট হত!

    একদিন বিকেলে গীতার মা বৌদির চুল বেঁধে দিতে দিতে বলল, ‘রাস্তার ধারে এই মেয়েছেলেগুলোর জন্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে রাস্তায় হাঁটা দায় হয়ে পড়েছে।’ বৌদি গীতার মাকে জিজ্ঞেস করে—‘ এরা কারা? কী করতে অ্যামন কইর‍্যা দাঁড়াইয়্যা থাকে রাস্তায়?’ গীতার মা চোখ বড় বড় করে বলে- ‘ও মা! তুমি কিছুই জানো না দেখছি।’ তারপর বৌদির কানে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘বেশ্যা’। এমনই সে ফিসফিসানি যে, আমিও স্পষ্ট শুনতে পাই। বৌদির চোখদুটো গোল গোল হয়ে ওঠে সেই কথা শুনে। গীতার মা হাসে আর বৌদির চুলের গোড়ায় শক্ত করে বাঁধন দেয়।

    আমি জানলার কাছে বসে রাস্তায় গ্যাস বাতি জ্বালতে আসা মই কাঁধে লোকটাকে দেখতে দেখতে বৌদিদের কথা শুনছিলাম। আমার দিকে হঠাৎ নজর পড়তেই বৌদি ধমকে বলে ওঠে- ‘আঁক কইর‍্যা কী শুনস? যা এইখান থিক্যা।’

    আমি বারান্দার দিকে চলে যাই। কিন্তু গীতার মা ও বৌদির কথাবার্তা থেকে আমার মগজের ডিকশনারিতে ‘বেশ্যা’ শব্দটা একটা রহস্যজনক এন্ট্রি পেয়ে যায়। রং মেখে সাজগোজ করা ও মেয়েদের বেশ্যা বলে।

    সেবার ছোটদির স্কুলে ফাংশান। আমার আনন্দ আর দেখে কে! কখন সেখানে যাব! মঞ্চের পিছনে একটা লোক অনুষ্ঠানের আগে মেয়েদের মুখে রং মাখিয়ে, গোঁফ-দাড়ি লাগিয়ে কী আশ্চর্য অন্য মানুষ বানিয়ে দেয়, তা দেখার জন্য আমার দারুণ কৌতূহল। এর আগে কতবার এই সাজিয়ে-কাকুর ছেঁটে ফেলা গোঁফ দাড়ির টুকরো লুকিয়ে নিয়ে এসে তা দিয়ে গোঁফ বানিয়ে নিজের ঠোঁটের ওপর লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছি। নিজেকে মনে হত রাজকুমার!

    কিন্তু, আমি ছোটদির স্কুলে যাওয়ার জন্য অস্থির হলে কী হবে, ছোটদির কোনও তাগিদ নেই। গীতাদি ছোটোদিকে চুলের বেণী বেঁধে, স্নো পাউডার দিয়ে সাজাতে লেগে পড়েছে। আমার দেখে খুব রাগ হয়।

    এ বাসায় আসার পর প্রথম প্রথম আমি গীতাদির বেশ ন্যাওটাই ছিলাম। পিছনে ঘুরঘুর করতাম। গীতাদিও কারণে-অকারণে আমার গাল টিপে দিত। কিন্তু একটা ঘটনা আমায় গীতাদি-বিদ্বেষী করে তোলে।

    আমার হাতের লেখা ছিল খুব খারাপ। কিন্তু গীতাদির হাতের লেখা ছিল ততটাই সুন্দর। দাদার ভাষায়- ‘এক্কেবারে মুক্তার মত গোট গোট লেখা।’একদিন পড়াতে বসে আমার হাতের লেখা উদ্ধার করতে না পেরে দাদা তো রেগে কাঁই! বললে- ‘একদিন তোরে গীতার ‘গু’ খাওয়্যা দিমু। তবে, যদি তোর হাতের লেখা বদলায়!’ সেদিন থেকেই গীতাদির ওপর আমার খুব রাগ।

    সেদিনও মনে হচ্ছিল, গীতাদি ছোটদিকে সাজাতে গিয়ে অহেতুক দেরি করছে। মনে মনে আমি ফুঁসছিলাম। একসময় গীতাদির সাজানো শেষ হল। ছোটদি আমার সামনে দাঁড়িয়ে জাজ্ঞেস করল—‘দ্যাখ তো ভাই। সুন্দর লাগে?’

    ছোটদিকে দেখে আমার রাগ গলে জল। কী সুন্দর লাগছে ছোটদিকে! আমি মুগ্ধ হয়ে বললাম, ‘দারুণ! তোমাকে এক্কেবারে বেশ্যাগুলার মত লাগছে!’


    কথাটায় কী দোষ আমি বুঝিইনি। ওই ‘বেশ্যাদের’ আমার ভালোই লাগত। কী সুন্দর সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকে ওরা। দিদিকেও সুন্দর লাগছিল বলে...

    কিন্তু গীতাদি আমার মন্তব্য শুনে অবাক। ‘এই অসভ্য কথা কোথা থেকে শিখলি তুই?’

    গীতাদি বৌদিকে গিয়ে তৎক্ষণাৎ আমার নামে রিপোর্ট করে এল। রাতে দাদা ফিরতেই বৌদি সেই রিপোর্ট পাস করে দিল দাদাকে। আমাকে ঘুম থেকে টেনে হিঁচড়ে তুলে বেতখানা দিয়ে আমার পিঠে শপাং শপাং শব্দে আলপনা এঁকে দিল দাদা। ছোটোদি আমাকে জড়িয়ে বলতে থাকলো- ‘ও দাদা, আর মাইরো না। ভাই মইর‍্যা যাইবো!’

    দাদার বেত মারা একসময় থেমেছিল। আমার পিঠের দাগ মেলাতে সময় লেগেছিল অনেকদিন।

    এখনও যদি কোনওদিন প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে যাই, এদিক ওদিক তাকালেই দাদা যেন আমার পিঠে বেত মারতে থাকে। ভয়ানক চুলকোতে থাকে পিঠটা।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @