No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ‘ছৌ’ যখন আদিবাসী যুদ্ধনৃত্য

    ‘ছৌ’ যখন আদিবাসী যুদ্ধনৃত্য

    Story image
    ভোরের আলো ফোটার আগেই বেজে উঠল ঢোল-ধামসা। একতাল ঝুমুরে শুরু হল গণেশ বন্দনা। হেলতে দুলতে শুঁড় নাড়াতে নাড়াতে, নাচের তালে পা ফেলে আসরে প্রবেশ গণেশের। এবার শুরু ছৌ, অন্ত্যজ শবর-সাঁওতালদের একমাত্র বিনোদন।

    খন রাত প্রায় শেষ। প্রভাতের কপালে সূর্য উঠছে। পাখিরা আড়মোড়া ভাঙছে। বিশাল ঢোল, ধামসা বাজিয়ে তখনও ক্লান্ত হননি শিল্পীরা। চলছে শেষ পর্বের পালা-নাচ।

    ‘সিঁদুরের বিন্দু বিন্দু মূষিক বাহন/ নমঃ নারায়ণ/ গণেশদেব হর গৌরীর নন্দন...।’
    তাক ধিন না ধিন—

    ভোরের আলো ফোটার আগেই বেজে উঠল ঢোল-ধামসা। একতাল ঝুমুরে শুরু হল গণেশ বন্দনা। হেলতে দুলতে শুঁড় নাড়াতে নাড়াতে, নাচের তালে পা ফেলে আসরে প্রবেশ গণেশের। এবার শুরু ‘ছৌ’ (Chhau)। এই নাচে ঢোল-ধামসা-সানাই-শিঙে-চড়াচড়ি-মাহুরী-করতালের যুগলবন্দিতে চারিদিক সরগরম। দর্শকরা মূলত আদিবাসী মহিলা-পুরুষ। অপুষ্টি অনাহারের ছাপ সর্বাঙ্গে। কিন্তু চোখেমুখে ঝিলিক দিচ্ছে অনাবিল সারল্যের সাতরঙা রামধনু।

    ছোটোনাগপুর মালভূমির অন্ত্যজ শবর-সাঁওতালদের একমাত্র বিনোদনই যে ছৌ। মুসলিমরা সেজেগুজে ঢোল ধামসার তালে তালে মুখোশ পরে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে মারীচ বধে উদ্যত। একতাল, ঝাঁপতাল—মারীচ বধ শেষ। ছৌ নাচে অচ্ছেদ্যভাবে কোনো গান যুক্ত নেই, তথাপি প্রত্যেকটি পালা শুরু হওয়ার আগে সেই পালার পরিচয়সূচক একটি করে গান গাওয়া হয়। একে রং বা রংঝুমুর বলে। যেমন মহাভারতের অভিমুন্য বধ পালাটি আসরে অভিনীত হলে ঝুমুর গায়ক আসরের চারধারে ঘুরে ঘুরে গান ধরেন-

    “কোথা আছ হে মামা শ্রীমধুসূদন।
    বিপদ সময়ে হরি দাও দরশন।।
    কোথা পিতা আর্যবীর কোথা রাজা যুধিষ্ঠির।
    কোথায় আছো বীর বলরাম।।”

    পালাটি যখন শুরু হয় তখন ধামসায় গুমগুম শব্দ, সঙ্গে সানাই ও ঢোলের মধ্যে দিয়ে অভিমুন্য বধের আবহ তৈরি হতে থাকে। এইভাবে সুর অনুসরণ করে হাতে অস্ত্র ও মুখে মুখোশ পরে আসরে প্রবেশ করবে অভিমুন্য। এভাবে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনি এবং পুরাণের বিভিন্ন কাহিনি পালাক্রমে ছৌ নাচের মধ্য দিয়ে টুকরো টুকরোভাবে আসরে হাজির হয়। এবার কোনো জায়গায় রাজা দশরথের অন্ত্যেষ্টি থেকে আরম্ভ করে রাবণ বধ পর্যন্ত সম্পূর্ণ রামায়ণ নিয়েও সারারাত ধরে ছৌ নাচ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

    ছৌ নাচ বা ছো নাচ বা ছ নাচ একপ্রকার ভারতীয় আদিবাসী যুদ্ধনৃত্য (Tribal Folk Dance)। এই নাচ পশ্চিমবঙ্গ,  ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশায় জনপ্রিয়। ছৌ নাচের আদি উৎপত্তিস্থল পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা (Purulia District)। উৎপত্তি ও বিকাশের স্থল অনুযায়ী ছৌ নাচের তিনটি উপবর্গ রয়েছে। যথা– পুরুলিয়া ছৌ, সরাইকেল্লা ছৌ ও ময়ূরভঞ্জ ছৌ।

    সরাইকেল্লা ছৌ-এর উৎপত্তি অধুনা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সরাইকেল্লা খরসোয়া জেলার সদর সরাইকেল্লায়। পুরুলিয়া ছৌ-এর উৎপত্তিস্থল পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা এবং ময়ূরভঞ্জ ছৌ-এর উৎপত্তিস্থল ওড়িশার ময়ুরভঞ্জ জেলা। এই তিনটি উপবর্গের মধ্যে প্রধান পার্থক্যটি দেখা যায় মুখোশের ব্যবহারে। সরাইকেল্লা ও পুরুলিয়া ছৌ-তে মুখোশ ব্যবহৃত হলেও, ময়ূরভঞ্জ ছৌ-তে হয় না।

    ছৌ নাচের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত রয়েছে। ডঃ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো ও ডঃ সুধীর করণের মতে এই নাচের নাম ছো, আবার বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত ও ডঃ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতোর মতে এই নাচের নাম ছ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র অধ্যাপক ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য সর্বপ্রথম ছ বা ছো নাচের পরিবর্তে ছৌ নামে অভিহিত করেন এবং বিদেশে এই নাচের প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার পরে এই নাচ ছৌ নাচ নামে জনপ্রিয় হয়ে পড়ে।

    ছৌ নাচের পৌরাণিক ও সামাজিক  সমস্ত চরিত্র হলো কাহিনিনির্ভর। সরল, স্বতঃস্ফূর্ত চলমান জীবনের বাস্তব জনস্বত্ত্বা নিয়ে ছৌ নাচ পরিপূর্ণ। ছৌ নাচের মূলরস মূলত বীররস অর্থাৎ যুদ্ধ। পুরুলিয়ার প্রায় প্রতিটি ছৌনাচের পালায় যুদ্ধ একটি অতি আবশ্যক অনুষঙ্গ এবং পালাগুলি যুদ্ধে চরম উত্তেজনার মধ্যে পরিসমাপ্তি লাভ করে।

    রাজেশ্বর মিত্রের মতে, তিব্বতি সংস্কৃতির ছাম নৃত্য থেকে ছৌ নাচের উদ্ভব ঘটেছে। ডঃ সুকুমার সেনের মতে শৌভিক বা মুখোশ থেকে নাচটির নামকরণ ছৌ হয়েছে। কুড়মালি ভাষায় ছুয়া বা ছেলে থেকে এই নাচের নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন, কারণ ছৌ প্রধানত ছেলেদের নাচ। ডঃ সুধীর করণের মতে ছু-অ শব্দের অর্থ ছলনা ও সং। কোনো কোনো আধুনিক গবেষক মনে করেন, ছৌ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ছায়া থেকে। কিন্তু সীতাকান্ত মহাপাত্র মনে করেন, এই শব্দটি ছাউনি থেকে এসেছে।

    ছ বা ছৌ কেন? এই নাচের বিশেষত্ব প্রতি সারিতে ছ’জন নাচিয়ে, দু’সারিতে সমাগত। ‘ছ’ জন নাচিয়ে, তাই নাচটির নাম নাকি ‘ছ’। ইংরেজিতে শহুরে কেতায় ‘ছ’ হল ছৌ। ছয়-এর গুণিতকে নাচের সদস্য-সংখ্যা বাড়তে পারে। দশ মাত্রার মেলতালে তারস্বরে বাজতে থাকে ঢোল। অতিথি অভ্যাগত মনের সুখে টান মারেন চুটিতে, দর্শক ডুবে হাঁড়িয়ায়। মহুয়ার বীজ থেকে তৈরি ‘মহুলে’ (জোরালো মদ) মজেছেন নর্তক-নর্তকীরা। রাত পেরিয়ে আলো ফুটলেও নেশার ঘোরে তাঁরা নাচতে থাকেন অবিরাম। মাথার উপর হয়তো সুয্যিদেব গা গতর পুড়িয়ে দিয়েছেন ততক্ষণে। থোড়াই কেয়ার!

    ছৌ নাচের উদ্ভবের সঙ্গে চৈত্রসংক্রান্তি অথবা শিবের গাজন অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। পুরুলিয়ার ছৌ নাচের আদিরূপের সন্ধান পাওয়া যায় চৈত্রসংক্রান্তির ভগতাপরব অর্থাৎ শিবপূজা উপলক্ষ্যে কাপঝাঁপ এর মধ্যে। অঞ্চলভেদে বা আঞ্চলিক উচ্চারণ মতে ছৌনাচের অনেক নাম দেখা যায়। অনেকে এই নাচকে ছো, ছ, ছউ, ছাউ ইত্যাদি নামে সম্বোধন করলেও সুপরিচিত নামটি আসলে ছৌ। ছৌ শব্দটির অর্থ সঙ, ছায়া অথবা ছাউনি। চৈত্র পর্বের একটি উল্লেখযোগ্য অঙ্গ হল সন্ন্যাসী ও ভক্তদের নানা ধরনের সাজে সজ্জিত হওয়া। ছৌ নাচের পৌরাণিক ও সামাজিক  সমস্ত চরিত্র হলো কাহিনিনির্ভর। সরল, স্বতঃস্ফূর্ত চলমান জীবনের বাস্তব জনস্বত্ত্বা নিয়ে ছৌ নাচ পরিপূর্ণ। ছৌ নাচের মূলরস মূলত বীররস অর্থাৎ যুদ্ধ। পুরুলিয়ার প্রায় প্রতিটি ছৌনাচের পালায় যুদ্ধ একটি অতি আবশ্যক অনুষঙ্গ এবং পালাগুলি যুদ্ধে চরম উত্তেজনার মধ্যে পরিসমাপ্তি লাভ করে।

    পুরুলিয়া জেলায় অনেক মুখোশ ব্যবহৃত হয়। জেলার বারো মাসে তেরো পার্বণ-এ লোক জমায়েত হয়ে আসর বসে। বিশেষ করে চৈত্র গাজন বা ভগতাপরব, কালীপূজা, দুর্গাপূজা অন্যান্য গ্রামীণ দেব-দেবীর পূজা উপলক্ষ্যে ছৌ নাচের আসর বসে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনি অবলম্বন করে ছৌ নাচের পালা পরিবেশিত হয়। একটি নির্দিষ্ট তাল, ছন্দ মিলিয়ে এর আসর জমে ওঠে এবং সকলেই এই পালা উপভোগ করে। পুরুলিয়া অঞ্চলের অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করে, যেমন- কুর্মি, ভূমিজ, হাড়ি, বাউরি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোকেরা। পুরুলিয়া ছৌ নাচের সৌন্দর্য ও পরিপাট্য নাচটিকে একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পুরুলিয়ার ছৌ (Purulia Chhau) নাচ প্রদর্শিত হয়।

    আদিবাসী ও উপজাতীয় শিল্পীদের শারীরিক ক্ষমতা ও নৈপুণ্যের স্বাক্ষর বহনকারী হিসেবে ছৌনাচ প্রসিদ্ধ। অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়েও গ্রামের দরিদ্র লোকেরা এই লোকনৃত্যটিকে সযত্নে লালন করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। আদিবাসী ছৌ নৃত্যশিল্পীদের জীবন এককথায় শ্রীহীন। এঁরা চেয়ে থাকেন সরকারি সাহায্যের দিকে। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। এবং গত দশ বছরে ছৌ নাচ পৌঁছে গিয়েছে আন্তর্জাতিক মঞ্চে। চাহিদা বেড়েছে। শিল্পীদের সংসার দেখেছে অর্থলাভের সুখ। আর লালমাটির রাস্তার শেষে দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের মাথা টপকে দেখা যায় অযোধ্যা পাহাড়। এখানকার শিল্পীরা এখনও আদিবাসী নৃত্যকে (Folk Dance) বাঁচিয়ে রেখেছেন, লালন করেছেন সময় উত্তীর্ণ করে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @