No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বেলঘরিয়ার ইতিহাসে যা লেখা নেই – ৮

    বেলঘরিয়ার ইতিহাসে যা লেখা নেই – ৮

    Story image

    বেশ মজার কিন্তু। একটা আস্ত রাস্তা যাঁর নামে, তাঁর সম্পর্কে প্রায় কেউই জানত না কিছু। তবে, অন্যদের থেকে তিনি যে আলাদা, বোঝা যেত। কেননা, রাস্তাটির নামের মধ্যে তাঁর পরিচয়ও লুকিয়ে আছে। ‘কবি চণ্ডীচরণ মিত্র স্ট্রিট’। কিন্তু কে এই চণ্ডীচরণ মিত্র? ওল্ড নিমতা রোড থেকে বাগদিপাড়ার মধ্যে ঢুকে গেছে যে রাস্তা, সেখানেই কি থাকতেন তিনি? আমি বাগদিপাড়ার অনেকের কাছে খোঁজ নিয়েছিলাম। কেউই বলতে পারেননি। একজন বটতলার কাছে একটা বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে বললেন – এটাই চণ্ডীচরণের। কেউ বললেন, সে-বাড়ি ভাঙা পড়েছে বহুদিন আগেই। মোদ্দা কথা, বাগদিপাড়ায় চণ্ডীচরণের চিহ্ন নেই কোনো। তা বেশ। কিন্তু বেলঘরিয়ার কোনো বিশিষ্ট মানুষ ছিলেন নিশ্চয়ই, নইলে হঠাৎ রাস্তার নাম তাঁর নামে হবে কেন! আর, হেলাফেলার কবিও হয়তো নন, তাহলে ‘কবি’ পরিচয় জ্বলজ্বল করত না। কিন্তু হঠাৎ তিনিই কেন? সে-আমলে বেলঘরিয়ায় কবি কি কম পড়িয়াছিল?

    এ-কৌতূহল শুধু বেলঘরিয়ার ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে নেমে নয়, বহুদিন আগে থেকেই ছিল। বস্তুত, কিশোরবয়সে এই এলাকার কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি ও তাঁর ইতিহাস সম্পর্কে জানার ইচ্ছে যদি জেগে থাকে – তা এই চণ্ডীচরণ মিত্রেরই। কবি তো বুঝলাম, কিন্তু তাঁর কবিতা পাব কই? প্যারীমোহন লাইব্রেরিতে গিয়ে খোঁজ করলাম। নেই। অগত্যা ওজনদার নামের সঙ্গে ওজনদার লেখার কল্পনা করেই থেমে যাওয়া।

    তবে, ভুলে যাইনি। ২০১৫-য়, যখন সবদিক দিয়ে ঘিরতে চাইছি বেলঘরিয়ার ইতিহাসকে, হাতে পেলাম দু-তিনটি প্রবন্ধ। বেলঘরিয়ারই বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও স্যুভেনিরে প্রকাশিত। লেখকরাও স্থানীয়। সার্কুলেশন বেশি ছিল না, ফলে লেখাগুলো প্রচার পায়নি সেভাবে। আমার কৌতূহল আংশিক মিটল। কেননা, চণ্ডীচরণ মিত্রের ওপর প্রবন্ধগুলি। তাঁর কবিতা পড়ে চমকে উঠলাম। কিন্তু ওই খাপছাড়া প্রবন্ধগুলি আমাকে খুশি করেনি। কেননা, লেখকরা শুকনো আলোচনা করেছেন মাত্র। গভীরতা কই!

    বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়ে, অবশেষে চিহ্নিত করলাম তাঁর বাড়ি। বাগদিপাড়া থেকে অনেকটাই দূরে। আনন্দম-এর পিছনে। তাঁর নাতি, কৌশিক মিত্র এখন থাকেন ওখানে। আগে থেকে কথাবার্তা বলে, একদিন গেলাম। কৌশিকবাবু নামিয়ে আনলেন ঠাকুরদার কবিতার খাতা, ডাইরি। চণ্ডীচরণের কোনো বই কিন্তু প্রকাশিত হয়নি কখনও। ভদ্রলোক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিজের প্রকাশিত কবিতাগুলি কেটে সেঁটে রাখতেন একটা খাতায়।

    কোন সময়ের কবি ছিলেন চণ্ডীচরণ? এ-প্রশ্নেরও সুনির্দিষ্ট জবাব পেলাম তাঁর বাড়িতে গিয়েই। জন্ম ১৮৮৩, মৃত্যু – ১৯৪১। অর্থাৎ, ৫৮ বছরের জীবন। তাঁর লেখালিখি সম্পর্কে টুকরো-টুকরো পড়েছিলাম পূর্বোক্ত প্রবন্ধগুলোতেই, কিন্তু তাঁর ডাইরি ও খাতা হাতে নিয়ে, পাতা উল্টে দেখতে দেখতে সেই সন্ধ্যায় আমার মধ্যে মূলত একটাই অনুভূতি জেগেছিল – বেলঘরিয়ায় কবিতাচর্চার নিদর্শন, প্রাক-স্বাধীনতার যুগেও, নিতান্ত দীন ছিল না।

    চণ্ডীচরণের লেখার উদ্ধৃতি বা তাঁর সাহিত্যকীর্তি বিশ্লেষণ করতে ইচ্ছে করছে না এখন। কেননা সেসব ‘বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে’ বইয়ে বিস্তৃতভাবে রয়েছে। মাঝরাতে এই ধারাবাহিক লিখতে বসে, সেসব গম্ভীর আলোচনায় ঢুকলে সুবিচার করা হবে না মোটেই। তবে, শুধু কবিতাই তো নয় – ভদ্রলোক তাঁর ডাইরিতে ভ্রমণকাহিনিও লিখে রেখেছেন পাতার পর পাতা। আর, প্রতিটি কাহিনির সঙ্গে নিজের হাতে আঁকা ছবি। গদ্যের ভাষাও চমৎকার।

    তবে, কিছু তথ্য জানিয়ে রাখি এ-প্রসঙ্গে। চব্বিশ পরগনার ছড়া প্রবচন সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। রীতিমতো শ্রমসাধ্য কাজ। গবেষক-মন ও নিষ্ঠা ছাড়া, ধারাবাহিকভাবে এ-কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার, প্রচুর চিনা প্রবচন অনুবাদ করেছেন বাংলায়। সে-আমলে, চিনা প্রবচন নিয়ে আর কেউ কাজ করেছিলেন কি? চণ্ডীচরণবাবু কোত্থেকে সেগুলি জোগাড় করে অনুবাদ করেছেন, জানি না। তবে এই উদ্যোগ বেলঘরিয়ায় বসে একজন মানুষ নিয়েছিলেন – শ্লাঘাবোধের পক্ষে এও তো অনেক!

    প্রকৃতপক্ষে, একজন সার্থক অনুবাদক ছিলেন চণ্ডীচরণ। রুমি, হাফেজ, ডিরোজিও, মৌলানা আকবর, হজরত মসিহ মউদ, খাজা মঈনউদ্দিন চিস্তি প্রমুখের কবিতার অনুবাদ করেছেন। এবং, বেশ কিছু অনুবাদে আধুনিকতার ছাপ আমায় চমকে দেয় একাধিক পাঠের পরও। মঈনউদ্দিন চিস্তির ফার্সি গজলের অনুবাদ করতে গিয়ে একটি পঙক্তি লিখছেন চণ্ডীচরণ – ‘তোমায় ঘিরে বৃত্ত আঁকার কম্পাস সে আমি।’ এই লাইনটা পড়ে বিস্ময়ে ছিটকে গিয়েছিলাম। একবার নিজের লেখালিখির দিকে, একবার ১৯৪১-এ মৃত এই কবির লেখার দিকে তাকিয়ে, আত্মগর্ব মিশে গিয়েছিল ধুলোয়।

    অবশ্য শুধু এই অনুবাদের লাইনটিই নয়। চণ্ডীচরণ লিখছেন কমবেশি ১৯১০ থেকেই। তখনকার কবিতার ভাব ও চলন তাঁর মধ্যেও প্রকট। কিন্তু এরই মধ্যে অতুলনীয় কিছু লাইন ঝলসে ওঠে, যা এই একুশ শতকে বসে লিখতে পারলে ধন্য মনে করতাম নিজেকে। ‘প্রশ্ন জাগিল মনোমাঝে সেই ক্ষণে / এই কি কবিতা? -মেয়েটি তো নির্ভীক!’ মাইরি? তিরিশের দশকে, বেলঘরিয়ায় বসে একজন কবি, যাঁর একটা কবিতার বইও প্রকাশিত হল না কোনোদিন, নিজের খাতায় লিখে রাখছেন – ‘এই কি কবিতা? –মেয়েটি তো নির্ভীক!’ আর আমরা দুটো লাইন লিখে ফেলেই ফেসবুকে আপলোড করে বাহবা পেয়ে ভাবি কাব্য-সেলিব্রিটি বনে গেলাম। আবার, ‘এই যে পায়রা ওড়ানো – একে আমি বলি / হক্‌ এবং দিই সাব্বাস!’ – এই লাইনের কাছে এসে ঘুমে জড়িয়ে-আসা চোখ নিয়েও আমি মনে করতে পারছি তিন বছর আগেকার প্রথম পাঠের ধাক্কা। বাবু চণ্ডীচরণ, এইসব পংক্তিই তো বুঝিয়ে দেয়, আপনি ফেলনা ছিলেন না মোটেই। সমসাময়িক সাহিত্যজগতে, কিংবা পরবর্তীকালেও আলোচিত হলেন না কেন তাহলে? কেন বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে গেলেন, আর আমাকে ২০১৫ সালে জীর্ণ খাতা ঘেঁটে উদ্ধার করতে হল আপনার এইসব লেখা? মধ্যিখানে যাঁরা আপনাকে নিয়ে ছোটখাটো প্রবন্ধ লিখেছেন, রচনাকালের প্রেক্ষিতে এই পংক্তিগুলোর সাহিত্যমূল্য তাঁরা বুঝতে বুঝতে পারেননি – তাও না হয় মানা গেল। কিন্তু আপনার মৃত্যুর পর, আমি নাক গলানোর আগে চুয়াত্তর বছর কেটে গেল – একজন বাঙালিও কি ছিল না, আপনার লেখাগুলো প্রকৃত পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো? নাকি আপনিই খাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে এই লেখাগুলো জনসমক্ষে নিয়ে আসতে চাননি?

    ওদিকে, চণ্ডীচরণ যখন মারা গেলেন, ১৯৪১-এ, তার দেড়-দুবছর আগেই পাটনায় জন্মে গেছে এক শিশু, যে বড় হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’ হয়ে যাবে এবং ১৯৬৩ সালে চাকরিসূত্রে এসে পড়বে কলকাতায়। তারপর, ১৯৬৭ থেকে, বেলঘরিয়ার বাসিন্দা। অবশ্য এই চার বছরের মধ্যেই ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’ হওয়া লোকটি মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে মিশে সাহিত্যজগতে ঘটিয়ে ফেলেছেন ‘হাংরি আন্দোলন’ নামের এক বিস্ফোরণ। প্রকাশিত হয়ে গেছে তাঁর লেখা বাংলার প্রথম ডি-ন্যারেটিভাইজড উপন্যাস ‘ছাতামাথা’। এবং, বেলঘরিয়ায় বসে, পরবর্তী পাঁচটি দশকে লিখেছেন ‘গেরিলা আক্রোশ’, ‘আত্মার শান্তি দুমিনিট’, ‘প্রত্নবীজ’, ‘দুরুক্ষী গলি’র মতো বই। বাংলা সাহিত্যের নতুন এক গদ্যরীতির জন্ম দিয়েছেন। গাল খেয়েছেন, উগরে দিয়েছেন থুতু। আর, এই প্রায়-আশি বয়সেও লেখা ও না-লেখার ককটেলে টলছেন। সুবিমল বসাক। চণ্ডীচরণের বে-আদব উত্তরাধিকারী?

    কিন্তু আমি তো আরেকজনকেও চিনতে পারছি, সাত বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে বেলঘরিয়ার যতীনদাস নগরে থাকতে আসা একটি ছেলেকে, যে যুবক বয়সে চাপদাড়ি রাখবে, ময়দানে পানশালায় হুল্লোড় করে বেড়াবে এবং কবিতা লিখেছে বলে মাথা নোয়াবে না কিছুতেই। সেই যুবকও আজ চুয়ান্ন বছরের। তেজ আর নাম ধরে রেখেছে আটের দশকের আবির্ভাব। ও হ্যাঁ, কবিতাও। ‘রাহুল পুরকায়স্থ প্রণীত’।

    এই সূত্রেই কি লিখেছিলাম – ‘যায় না, পাশেই থাকে / দেখা শুধু পাওয়াটি কঠিন’?

    (ক্রমশ)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @