বেলঘরিয়ার ইতিহাসে যা লেখা নেই – ৫

২০১৫ সালের শেষের দিক। বেলঘরিয়ার ইতিহাস নিয়ে লেখালিখি করছি শুনে, ছেলেবেলার এক বান্ধবী বলে বসল – ‘আমাদের নিয়েও লিখবি তো?’ আমি হতবাক। পরে বুঝতে পেরে, হেসে ফেলেছিলাম। মহাকালী গার্লস-এর কথা বলছে সে। আর আমি, খাস বেলঘরিয়া হাই স্কুলের ছাত্র। লিখব তো বটেই! বেলঘরিয়ার অতীত হোক বা বর্তমান – ওই প্রসঙ্গ নিয়ে না লিখলে হয়! যদিও ততদিনে সময় বদলে গেছে অনেকটাই। আমরা যখন স্কুল ছেড়ে বেরোচ্ছি, ২০১১-তে, তখনও এই মফঃস্বলের পুরনো চরিত্র অনেকটাই বজায় ছিল। তখনও, মহাকালী-র ইলেভেন-টুয়েলভের ছাত্রীরা গোলাপি শাড়ি পরে স্কুলে যেত। ছুটির পর, শেষ-বিকেলের রোদে তাদের শাড়িতে জমাট বাঁধত একধরণের উজ্জ্বল খিলখিল। উমেশ মুখার্জি রোড, ফিডার রোড আর ভার্নার লেনের সেই বিকেলগুলো আজও কি তেমনই আছে? ২০১২ থেকেই মহাকালী-র ইলেভেন-টুয়েলভের মেয়েদের স্কুলড্রেস বদলে যায়। চুড়িদার। আমাদের সমসাময়িক ব্যাচটাই ছিল ঐতিহ্যের শেষ উত্তরসূরি। মায়ারও বোধহয়...
এসব কথা থাক। যেমন থাক আমাদের স্কুলের চারতলার ভাঙা কমনরুম থেকে মহাকালী-র বন্ধ জানলার দিকে তাকিয়ে থাকার কথাও। সেসব বড় ব্যক্তিগত। অথবা, শুধু দুই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদেরই। বাইরের কেউ এই রূপকথার মর্ম বুঝবে না। বরং স্কুলগুলোর ইতিহাসে নজর দিই। সেখানেও মাণিক্য কিছু কম নেই কিন্তু...
বেলঘরিয়ার সবচেয়ে পুরনো স্কুল আমাদের ‘বেলঘরিয়া হাই স্কুল’ই। অন্তত, যে-স্কুলগুলো এখনও টিকে আছে, তাদের মধ্যে। ১৮৭২ সালে স্থানীয় জমিদার জগবন্ধু গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ির ঠাকুরদালানে এই স্কুল চালু হয়। সেই ঠাকুরদালান আজ ভেঙে পড়েছে। হারিয়ে গেছে সব থামও। তবু, দালানের ভিত্তি আর সিঁড়িগুলো এত বছর পেরিয়েও টিকে আছে আজও। আমি সেই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, সেই ছাদহীন ঠাকুরদালানের মেঝে ছুঁয়ে স্কুলের প্রথমদিকের দিনগুলোয়, হ্যাঁ, পৌঁছে যেতে পেরেছিলাম। এমনই জোর ইতিহাসের।
‘The school was originally established as an M.E. School in the year 1872, by Late Babu Jagabandhu Ganguli, a local Zaminder and patron of learning.’
সে-আমলে স্কুলটি পরিচিত ছিল ‘বেলঘরিয়া মিডল ইংলিশ স্কুল’ বা সংক্ষেপে ‘এম. ই. স্কুল’ নামেই। ক্লাস ফোর অবধি পড়ানো হত তখন। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে, ১৯৪১ সালে অবশেষে ‘হাই ইংলিশ স্কুল’-এ উন্নীত হয় এটি। অর্থাৎ ক্লাস এইট অব্দি। পরে, ১৯৫৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পড়াশুনা চালু হয়।
স্কুলের দ্বিতীয় যে ভবনটি ১৯৮৭ সালে তৈরি হল, সেটা ছিল ফোর্ট উইলিয়াম কর্তৃপক্ষের জমি। ১৯২৭ সালে, সরকার স্কুলকে ছাত্রদের খেলাধুলার জন্য ওই জমি দান করে। আর, ২০০৫ সালে তৃতীয় ভবন তো তৈরি হল আমাদের চোখের সামনেই! তবে, সমসাময়িক অনেকেরই স্মৃতিতে ধূসর হয়ে এসেছে আদি ভবনের চারদিক-ঘেরা গড়ন। আমাদের ক্লাস সিক্সের মাঝামাঝি সময়েই ভেঙে অর্ধেক করে ফেলা হয়। অবশ্য, আমি যেহেতু ক্লাস ওয়ান থেকেই বেলঘরিয়া প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি, স্মৃতি ততটা ঝাপসা নয় আমার কাছে। একতলায় কুমীর-ডাঙা খেলা কিংবা দোতলায় ছোঁয়াছুঁয়ি – শৈশব এত দূরের হয়ে গেল কেন?
এখনও যদি মহাকালী-র প্রসঙ্গে না আসি, নিতান্ত একচোখামি হবে। ১৯১০ সালে, স্থানীয় অনাথনাথ দাস ঘোষের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বেলঘরিয়া মহাকালী পাঠশালা’। এই স্কুলের সঙ্গে প্রথমদিকে জড়িত ছিলেন অন্নদাপ্রসাদ ঘোষাল, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, মাখনলাল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। মিঃ জে. এফ. ম্যাডান ১৯১৭ সালে কেদারনাথ দাস ঘোষের কাছ থেকে বর্তমান উমেশ মুখার্জি রোডের জমিটি কিনে নেন। এবং, ১৯১৯ সালে নতুন ভবন তৈরি হয় সেখানে আর স্কুলটি স্থানান্তরিত হয়। তখন থেকে, কেবলমাত্র শিক্ষিকারাই ছাত্রীদের পড়াশুনার ভার নেন। ১৯৪৩ সালে মিডল ইংলিশ স্কুলে আর ১৯৭৬ সালে দ্বাদশ শ্রেণীতে পরিণত হয়।তবে, বইয়েও যা লিখিনি, সেই সরস্বতীপুজোর দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। বন্ধুরা মিলে দল বেঁধে মহাকালী-তে হানা দেওয়া। ‘জ্যান্ত প্রতিমা’ দর্শনের চল আমাদের সময়ে ছিল বেশ। এখনও আছে কি? হাত পেতে প্রসাদ নেওয়ার মুহূর্তে, একবার চোখে চোখ? আমার সে-বয়স পেরিয়ে গেছে। মুশকিল হল, কোনো-কোনো স্মৃতির বয়স বাড়ে না। স্থির হয়ে থাকে, আর ইশারায় ডেকে নিতে চায় কাছে। চলে যাব? যাই?
এই দুই স্কুলের ইতিহাস যখন টানলামই, আরেকটা প্রতিষ্ঠানের কথা না-বলা অন্যায় হবে। বেলঘরিয়ায় শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকাও অসীম। ‘বেলঘরিয়া প্যারীমোহন লাইব্রেরি’। ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই লাইব্রেরিটিই কামারহাটি পৌরসভার দ্বিতীয় প্রাচীনতম লাইব্রেরি। উত্তরপাড়ার বাসিন্দা, এলাহাবাদে কর্মরত বিখ্যাত মুন্সেফ প্যারীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর, তাঁর স্ত্রী ঊষাঙ্গিনী দেবী এই লাইব্রেরি তৈরির জন্য বিভিন্ন সাহায্য করেন। তাই তাঁর ইচ্ছানুসারে, তাঁর স্বামীর নামে এটির নাম হয় ‘প্যারীমোহন মেমোরিয়াল লাইব্রেরি’। বিভিন্ন সময়ে এখানে এসেছেন সুভাষচন্দ্র বসু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতি বসু প্রমুখ।
আরও পড়ুন
বেলঘরিয়ার ইতিহাসে যা লেখা নেই – ৪
পুরো লেখাটার শেষে এসে মনে হচ্ছে, নিজের স্কুলের ইতিহাস নিয়ে কি একটু বেশিই উচ্ছ্বাস দেখিয়ে ফেললাম? হবে হয়তো! বইয়ে তো প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কেই বিস্তৃত লেখাই আছে। এই সিরিজ আমার নিজের স্মৃতিচারণ, পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার অবসর। এখানেও যদি ফর্মাল হয়ে যাই, ব্যক্তি-আমিকে তুলে আনতে না পারি, তাহলে কোনো মানেই দাঁড়ায় না লেখার।
আর, অন্তত এই পর্বে, ইতিহাসের তথ্যের থেকেও তো আমার কাছে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে স্কুলজীবনের দিনগুলো। উমেশ মুখার্জি রোড, গোলাপি শাড়ি আর বিকেল সাড়ে চারটে। সাইকেল নিয়ে এ-গলি সে-গলি হয়ে বাড়ি পৌঁছোনো। প্রত্যেকেরই এমন ব্যক্তিগত ইতিহাস আছে। বেলঘরিয়ার ইতিহাসে মিশে আছে সেসব গল্পও। শুধু, কোনোদিন গুছিয়ে লেখা হয়ে উঠবে না – এটাই যা আফশোসের...
(ছবিঋণ - তন্ময় ভট্টাচার্য, সায়ন্তন গোস্বামী)
(ক্রমশ)