বেলঘরিয়ার ইতিহাসে যা লেখা নেই – ১০

শেষ জেনেও, মনে হয় – আরেকটু থাকুক। সেই ‘আরেকটু’-র মায়া বেড়ে চলে দিনকেদিন। মনে-মনে সমাপ্তি স্বীকার করা সম্ভব হয় না কিছুতেই। দীর্ঘকাল পর, সবল একটা দীর্ঘশ্বাস বুঝিয়ে দেয় – হ্যাঁ, সত্যিই শেষ। আর আশা করতে নেই। নিজেকে ভুলিয়ে রাখার এই খেলা বেশ মজাদার। বাস্তব অস্বীকার করার মজা। রুক্ষতা আর একাকিত্বের মুখোমুখি কেই বা হতে চায়!
ধারাবাহিকের শেষ পর্বে এসে, কেন জানি মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে এইসব কথাই। এই ধারাবাহিক আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল প্রায়-একুশ বয়সের দিনগুলোয়। স্মৃতি খুঁড়ে সে-সময়কার রোমাঞ্চকর সব অভিজ্ঞতা তুলে আনার জার্নি একদিন যে ফুরোবেই, জানতাম। প্রস্তুতও ছিলাম মনে-মনে। কিন্তু যখন সত্যিই মুখোমুখি হলাম, হারিয়ে ফেলার ব্যথা যেন। মানতে হয়। মেনে নিতে হয়। ধাক্কা খেয়ে সরে যাওয়ার আগে, নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার এটুকু আত্মগর্বই তো সাহস!
বেলঘরিয়ার ইতিহাস নিয়ে অনুসন্ধান ব্যক্তিগতভাবে আমাকে কী দিয়েছে, তার সবকিছু প্রকাশ্যে আনা অনুচিত। এতই সূক্ষ্ম সেসব পাওয়া, যেন লিখতে গেলে ম্লান হয়ে যাবে। তবে এটুকু জানি, বিভিন্ন বয়সের অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি এই একটা কাজ করে। তাঁদের আশীর্বাদ, স্নেহ আমায় ভরিয়ে রেখেছে এখনও। সমালোচনাও পেয়েছি। শিখেছি। কাকে ধন্যবাদ জানাব? বেলঘরিয়াকে? মানুষকে? না আমার ভাগ্যকে?
আরও পড়ুন
বেলঘরিয়ার ইতিহাসে যা লেখা নেই – ৯
যেহেতু ‘বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে’ বইটায় কমবেশি ১৯৫০ সাল পর্যন্ত লিখেছিলাম, অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন পরবর্তী অংশ নিয়ে কাজ করার জন্য। ১৯৫১-১৯৮০ বা আরেকটু এগিয়ে। সত্যি বলতে, প্রচ্ছন্নে প্রস্তুতি নিতেও শুরু করেছিলাম। কিন্তু ভেতর থেকে তাগিদ পাইনি কোনোদিনই। আসলে আমি যে-সময়ের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছি, তা এখনই করে না ফেললে হয়তো অনেককিছু হারিয়ে যেত। কিন্তু ১৯৫০-পরবর্তী সময় নিয়ে কাজ করতে চাইলে, অন্তত দশ-পনেরো বছর এখনও আছে হাতে। আমি আর করব না, নিশ্চিত। অন্য কেউ করুক। নতুন উদ্যমে।
আসলে, কবিতা ছাড়া কোনোকিছুর প্রতিই বিশ্বস্ত হতে পারিনি তেমন। কবিতার প্রতিও পেরেছি কি? জানি না। কিন্তু এই ইতিহাস খোঁজার কাজ আমার কাছে যেন কবিতা হয়েই ধরা দিয়েছিল – ধাপে-ধাপে নতুনত্বের মুখোমুখি হওয়া, রহস্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে অজানাকে তোলপাড় করা – এই রোমাঞ্চ না থাকলে শুধু ইতিহাস কেন, কিছুই উপভোগ করতে পারি না আমি। বইয়ের ব্যাক কভারেও, একটা কবিতার দুটো প্যারাগ্রাফ ছিল। হয়তো অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু কবিতা না-ছুঁলে বইটার উত্তরণ হত না যেন।
এসবই মনে পড়ছে আজ। শেষ পর্বে। এই মনে পড়ার সূত্র ধরে কমে আসছে বলার মতো কথা। সামান্যই কিছু শব্দ আর। তারপর পড়ে থাকবে অনন্ত শূন্যতা। এক্ষেত্রে, শূন্যতার রং সাদা। রেখে গেলাম। পাঠক, নিজের কথা দিয়ে ভরিয়ে নিন। আমন্ত্রণ রইল...
আর রইল একটা জনপদ; স্মৃতির প্রলেপ আছে বলে হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও একাকী হব না কিছুতেই।
(সমাপ্ত)