No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বেলঘরিয়ার ইতিহাসে যা লেখা নেই – ৩

    বেলঘরিয়ার ইতিহাসে যা লেখা নেই – ৩

    Story image

    তখন সবে কলেজ শেষ হয়েছে। চাকরিবাকরি নেই। ঘরকুনো স্বভাবের বাইরে একমাত্র কাজ ছিল বেলঘরিয়ার অলিগলিতে হেঁটে বেড়ানো, সাইকেল নিয়ে চক্কর দেওয়া, বিভিন্ন মানুষের কাছে গিয়ে ইতিহাস নিয়ে যতটা সম্ভব তথ্য জোগাড় করা। এভাবেই, ঘুরতে-ঘুরতে একদিন কৌতূহল জাগল রাস্তার ইতিহাস নিয়েও। ততদিনে জেনেছি, একেকটা রাস্তার নামকরণের পেছনে লুকিয়ে থাকে হাজারো গল্প। এমনকি, কোনো মানুষের নামে নামাঙ্কিত রাস্তা ধরে আরও গভীরে গেলে, পৌঁছে যাওয়া যায় সেই মানুষটির কাছেও – এমন অলীক সত্যও জেনে গেছি ততদিনে।

    বেলঘরিয়ার অনেক রাস্তাই বিভিন্ন ব্যক্তির নামানুসারে। সেসব ব্যক্তি ও তাঁদের অবদান সম্পর্কে বইয়ে লিখেছি বিস্তর। এখানে আর সেসবের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছি না। বরং তিনবছর পর এই ধারাবাহিক লিখতে বসে, আমার মন টানছে সেই রাস্তাগুলোই, যাদের ইতিহাস আরও-আরও পুরোনো।

    বইয়ে একটা বিষয় নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলাম। ইতিপূর্বে আর কোথাও এ-ব্যাপারে কিছু দেখিনি। বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ পেয়ে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, বেলঘরিয়া একসময় নিমতার পরিচয়েই পরিচিত হত। পরবর্তীকালে, স্বতন্ত্র নাম পায় এবং পরিচিত হয় ‘বেলঘর’ গ্রাম হিসেবে। সে যাই হোক, আমার বাড়ি যে-রাস্তায়, সেই ‘ওল্ড নিমতা রোড’-এর নামকরণের কারণ আমাকে ভাবিয়েছিল খুব। রাস্তাটার পুরোটাই তো বেলঘরিয়ার মধ্যে, তাহলে এমন নাম কেন?

    আস্তে আস্তে জেনেছি প্রকৃত কারণ। ফিডার রোড তৈরি হওয়ার আগে, এই ওল্ড নিমতা রোডই ছিল বেলঘরিয়ার অন্যতম প্রধান রাস্তা। নিমতার সঙ্গে আড়িয়াদহের সংযোগকারী রাস্তা হিসেবে এর গুরুত্ব ছিল অসীম। নিমতা-বিরাটি তো বটেই, সুদূর মধ্যমগ্রাম-বারাসাত থেকেও লোকজন এই পথে আড়িয়াদহে যেতেন গঙ্গাস্নানের জন্য। শবদাহের জন্য আড়িয়াদহের শ্মশানে যেতে গেলেও এই রাস্তাই ছিল প্রধান অবলম্বন। আর, যেহেতু বিরাটি থেকে বেলঘরিয়া স্টেশন পর্যন্ত রাস্তাটি পরিচিত ছিল ‘নিমতা রোড’(যেটি বর্তমানে মধুসূদন ব্যানার্জি রোড) নামে, ইংরেজরা এই রাস্তাটির নামকরণ করে ‘ওল্ড নিমতা রোড’। আর, আমার অনুমান – ‘বেলঘর’ হয়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই এই রাস্তাটি ব্যবহৃত হত। তাই নামকরণের ক্ষেত্রেও ফিরে এসেছিল ‘নিমতা’ শব্দটি। 

    এমন আরেকটি প্রাচীন রাস্তা ‘ওল্ড ক্যালকাটা রোড’। যেটিকে আমরা এখন ‘নীলগঞ্জ রোড’ হিসেবেই জানি। বিটি রোড তৈরি হয় ১৮০৫ সালে। তার আগে, কলকাতায় যাতায়াতের পথ হিসেবে একমাত্র এই নীলগঞ্জ রোডই। সেসময় নীলগঞ্জ রোড ধরে, বরানগর হয়ে সোজা কলকাতায় পৌঁছনো যেত। পরে অবশ্য বিটি রোড তৈরি হয়ে যাওয়ার পর এই রাস্তা তার গুরুত্ব হারায়। অথচ, একসময় এই নীলগঞ্জ রোড ধরেই মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা আক্রমণের জন্য এসেছিলেন সিরাজদৌল্লা। তখন অবশ্য ‘নীলগঞ্জ রোড’ নাম হয়নি। এ-বিষয়ে বইয়ে বিস্তৃত আলোচনা থাকায়, এখানে আর সেসব ফিরিয়ে না আনাই ভালো। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, ভৌগোলিক অনেক অদলবদলের পরও, আজও সোদপুরের একটি রাস্তা ধরে রেখেছে ‘ওল্ড ক্যালকাটা রোড’ নাম।

    এছাড়াও, বেলঘরিয়ার এখনকার প্রধান রাস্তা ফিডার রোডের ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। ১৮৮১ সালে, বেলঘরিয়া স্টেশন থেকে সোজা আড়িয়াদহ ঘাট পর্যন্ত তৈরি করা হয় এই রাস্তাটি। জনৈক মহেশ মুখার্জি সম্পূর্ণ নিজের খরচে তৈরি করে দেন এই রাস্তা। আড়িয়াদহের ভেতরে রাস্তাটি এখনও ‘মহেশ মুখার্জি ফিডার রোড’ নামেই পরিচিত।

    যদিও এই তিনটে রাস্তার কোনোটাই আমাকে নিভৃতি দেয়নি। সেসব খুঁজতে আমাকে চলে যেতে হত জনপদের শিরা-উপশিরায়। হয়তো স্নাফ মিল স্ট্রিট, হয়তো কেপি ঘোষাল রোড, ভার্নার লেন। গলি তস্য গলি পেরিয়ে পৌঁছোতাম কলোনিতে, চুপ হতাম নন্দননগরের ঝিলপাড়ে দাঁড়িয়ে। মনে পড়ত, এখানকারই এক বন্ধুর মুখে শুনেছি – ও নাকি ঝিলে স্নান করতে নেমে পায়ের নিচে একটা রাস্তার আভাস পেয়েছে। সত্যি-মিথ্যে জানি না কিছুই। কিন্তু এসব ভাবতে ভাবতে অজানা এক সময়ে পৌঁছে যেতাম – যাকে ধরতে চাইছি, শব্দে বেঁধে ফেলতে চাইছি বইয়ে, অথচ চাওয়া আর পারার মধ্যে ফারাক থেকে যাচ্ছে প্রচুর।

    আচ্ছা, টাইমমেশিন বলে কি সত্যিই কিছু হয়? যদি হ্যাঁ, আমি তাতে চেপে পৌঁছে যেতে চাই ১৮৬২-র এক বিকেলে, যখন সদ্য চালু হয়েছে শিয়ালদহ-কুষ্টিয়া রেল চলাচল, আর প্রায়-অখ্যাত গ্রামের এককোণে দেখা যাচ্ছে স্টেশনের নাম – ‘বেলঘরিয়া’। আমি সেই সদ্যোজাত স্টেশনের কোনো গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চিনে নিতে চাই গ্রামের হৃদস্পন্দন। রেলগাড়ির হুইসল আর যাত্রীদের বিস্ময়চোখ। যদি পারি, বইয়ের পরবর্তী সংস্করণে লেখা থাকবে সেই অনুভূতিও। কথা দিলাম...

    (ক্রমশ)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @