বেলঘরিয়ার ইতিহাসে যা লেখা নেই – ২

ঝুর... ঝুর... ঝুর... খসে পড়ছে ইটের টুকরো, চুন, সুরকি। দেখতে দেখতে ছাদের বেশ খানিকটা অংশ ভাঙা হয়ে গেল। আকাশ থেকে বেলা তিনটের আলো ঢুকে পড়ছে বারান্দায়। দেখা যাচ্ছে লোহার খাঁচা। মিস্তিরিদের ঘামে-ভেজা মুখ। আর আমি হতবাক, দাঁড়িয়ে দেখছি প্রাচীনত্বের ছাপ লেগে-থাকা একটা বাড়ির শেষ হতে চলা।
কাজের শুরুর দিনগুলোতেই এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হব, ভাবিনি। বাড়িটার ইতিহাস-বর্তমান কিছুই জানি না। তবু মনে হচ্ছে, যেন জরুরি কিছু খোওয়া গেল। আসলে তখন ভেবেছিলাম, বেলঘরিয়ার প্রতিটা পুরনো বাড়িতেই যাব, ঘুরে-ঘুরে জোগাড় করব সে-পরিবারের ইতিহাস। এভাবে অন্তত আগেকার দিনগুলো সম্পর্কে অনেক তথ্য আসবে হাতে। অথচ আমার কাজ শুরু হতে-না-হতেই একটা নিদর্শন হারিয়ে যেতে বসল।
চৌধুরীপাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে, একটা গলির মধ্যে হঠাৎই পেয়েছিলাম সে-বাড়ি। ভাঙা হচ্ছে দেখে, মনখারাপ নিয়েই ঢুকে পড়েছিলাম। মিস্তিরিদের থেকেই জানলাম, দেড়শো বছরের পুরনো। কাদের বাড়ি, অজানা। মালিকও ধারেকাছে নেই যে জিজ্ঞেস করব। ভেঙে ফ্ল্যাট উঠবে। আমি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় পৌঁছে গেলাম। তখনও বসতির চিহ্ন স্পষ্ট। বারান্দায় খড়খড়ি। দেওয়ালে মোমরং দিয়ে ছোট ছেলের আঁকা ছবি। রান্নাঘরে টিনের কৌটো, ভাঙা কাপ। এরই মধ্যে, হাতুড়ির শব্দ। ভেঙে পড়ছে ছাদ। আস্তে-আস্তে ভাঙা হবে দেওয়ালও। পুরো শরীর গুঁড়িয়ে দিয়ে, তৈরি হবে নতুন করে।
একটা আফশোস আমায় কুরে খায় এখনও। বইটা লেখার জন্য তখন ঘোরাঘুরি করেছি বিস্তর। এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, পুরনো দিনের বাড়িগুলো বেশিরভাগই ফ্ল্যাট হয়ে গেছে। যাচ্ছে। শরিকরা নিজেরাই প্রোমোটারকে দিয়ে দিচ্ছেন মোটা টাকার বিনিময়ে। শুধু সাধারণ গৃহস্থবাড়ি নয়, জমিদারবাড়িগুলির অবস্থাও একই। আমি যখন কোনো জমিদার পরিবারের বংশধরের সঙ্গে কথা বলতে গেছি, তাঁর ফ্ল্যাটে, হাসতে-হাসতে বলছেন – ‘এখানেই বিশাল বাড়ি ছিল আমাদের।’
এসব শুনতে-শুনতে আমার রাগ হত তাঁদের ওপর, যাঁরা এর আগে বেলঘরিয়ার ইতিহাস নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন, গত শতাব্দীতে। শুধুমাত্র আউটলাইন দিয়েই কাজ সেরেছেন তাঁরা। আরও ডিটেইলে যদি কাজ করতেন, তুলে আনতেন এই প্রাচীন পরিবারগুলির গল্প, ছবি - এত অসহায় লাগত না আমার। তবে, আগেকার দিনে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্যামেরার চল অত বেশি না থাকায়, শুধু তথ্য জোগাড় করেই ক্ষান্ত হয়েছেন তাঁরা। সেখানে আমি প্রয়োজনমতো ছবি ও ভিডিও তুলে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব। যখন ২০১৫-তে শুরু করেছি, তখনই প্রায় পঁচাত্তর শতাংশ বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে। অবশিষ্ট যেটুকু ছিল, কাজে লেগেছে। কিন্তু এটাই যদি ২০১৫-র বদলে ২০৩০-এ করত অন্য কেউ, বিশেষ কিছুই পেত না। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা করেছি, যাঁদের জন্ম ১৯২৫-১৯৪০এর মধ্যে। যথেষ্ট সাহায্য করেছেন তাঁরা। কিন্তু আজ থেকে দশ-পনেরো বছর পর তাঁদের জীবিত থাকার সম্ভাবনা এতই ক্ষীণ যে, এখন না করলে আর কোনোদিনই এত ভালোভাবে করা যাবে না – এই চিন্তা আমায় বাড়তি তাগিদ দিয়েছিল।
আরও পড়ুন
বেলঘরিয়ার ইতিহাসে যা লেখা নেই – ১
বেলঘরিয়ার ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে, বহু তিক্ত অভিজ্ঞতারও মুখোমুখি হতে হয়েছে। তেমনই একটা ঘটনা বলি। যে বাড়িটা ভাঙা হচ্ছে, সেখান থেকে বেরিয়ে কাছেরই আরেকটা পুরনো বাড়িতে গিয়ে কলিংবেল বাজালাম। বিশাল বাড়ি, গলির প্রায় পুরোটা জুড়েই। আমার সঙ্গে সেদিন ছিল এক বন্ধু, সায়ন্তন। আমরা দুজনেই বেলঘরিয়া হাইস্কুলের ২০১১ ব্যাচের ছাত্র, পরবর্তীকালে আলাদা-আলাদা কলেজ থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিটেক করেছি। যাইহোক, সেই বাড়িতে গিয়ে ডাকাডাকি করতে দোতলার জানলা খুলে এক ভদ্রমহিলা উঁকি দিলেন। অত্যন্ত অমার্জিতভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন – ‘কী চাই?’ – ‘আমরা বেলঘরিয়ার ইতিহাস নিয়ে কাজ করছি। এই বাড়িটার পরিচয়, ইতিহাস জানতে চাই। কেউ কি বলতে পারবেন?’ আরও কঠিন গলায় জবাব দিলেন তিনি – ‘বেলঘরিয়ার ইতিহাস জানতে চাও তো ইন্টারনেট দ্যাখো গে। এখানে কী?’ আমরা তাতেও মেজাজ ধরে রেখেছিলাম। শান্ত হয়েই বলেছিলাম – ‘ইন্টারনেট, বইপত্রে বিশেষ কিছুই নেই। সব খুঁজে দেখেছি।’ ‘চিনি না-জানি না, হঠাৎ আস্কারা দেব কেন? তোমাদের আইডেন্টিটিটি কী?’ – ‘আমরা বেলঘরিয়াতেই থাকি, এখানকার ইতিহাস নিয়ে একটা বই লিখব বলে ফিল্ড ওয়ার্ক করছি। আমরা দুজনেই ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র।’ এরপরই, অপমান করলেন ভদ্রমহিলা – ‘ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র হয়ে ইতিহাস খুঁজতে এসেছ কেন? ইতিহাস দিয়ে কী হবে তোমাদের? আমি কোনো সাহায্য করতে পারব না।’ সায়ন্তন আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারল না। ‘আপনার অমূল্য সময় আমাদের দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ’ বলে আমাকে নিয়ে সরে গেল সেখান থেকে। মাথা নিচু করে হাঁটছি। তখন আমাদের বয়স কুড়ি-একুশের আশেপাশে। বড় আঘাত পেয়েছিলাম অমন প্রতিক্রিয়ায়।
এরপরেও, বিভিন্নজনের থেকে শুনেছি – ‘কোন ইউনিভার্সিটির ছাত্র তুমি? প্রোজেক্ট বুঝি? নইলে হঠাৎ ইতিহাস নিয়ে মাতলে কেন?’ কেউ-কেউ বিশ্বাসই করতে পারেননি, শুধুমাত্র বেলঘরিয়াকে ভালোবেসে কেউ এমন একটা কাজ করতে পারে।
তবু, উৎসাহ কি পাইনি! প্রচুর মানুষ নিজে থেকে এগিয়ে এসে সাহায্য করেছেন, ভালোবেসেছেন। তাঁদের নইলে সামলাতেই পারতাম না কিছু। তেমনই একজন দুর্গা চক্রবর্তী। যখন ভুবনমোহন ব্যানার্জির জমিদারবাড়িতে গিয়ে ইতিউতি উঁকি দিচ্ছি, বেরিয়ে এসেছিলেন আশি বছরের এই বৃদ্ধা। সামনে বসিয়ে গল্প করেছিলেন – এখানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এসে গান গেয়েছেন, এই এখানে নেচে গিয়েছেন স্বয়ং উদয়শঙ্কর।
আর আমি, সেই বৃদ্ধার চোখের দিকে তাকিয়ে একমনে ভাবছি – এই চোখই যদি ইতিহাস না হয়, তাহলে বৃথাই এই উৎসাহ আমার, বৃথাই এত স্বপ্ন দেখা...
(ক্রমশ...)