১৮৩ বছর আগে, জনতার চাঁদায় যাত্রা শুরু করেছিল বাঁকুড়া জিলা স্কুল

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। তার ঠিক ১৮ বছর আগে অবিভক্ত বাংলার বাঁকুড়া জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাঁকুড়া জিলা স্কুল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের শিক্ষা মানচিত্রে উল্লেখযোগ্য উজ্জ্বল উপস্থিতি ‘বাঁকুড়া জিলা স্কুল’-এর।
এবার আসা যাক বাঁকুড়া জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস প্রসঙ্গে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কর্মরত সিভিল সার্জন জি. এন টিক সাহেব এবং সেই সময়কার বাঁকুড়া জেলার দায়রা জজ ফ্রান্সিস গোল্ডসবেরি এবং চার্চ মিশন সোসাইটির ধর্মযাজক রেভারেন্ড ডাব্লু. জে ওয়েট রেক্ট-এর উদ্যোগে ১৮৪০ সালে তৈরি হয় ‘Banchoorah Free School’, আজ যা বাঁকুড়া জিলা স্কুল নামে পরিচিত। এখনও বাঁকুড়া জিলা স্কুলের হল ঘরের দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে নজর পড়লে দেখা যায় এই স্কুল ভবন তৈরির সেই ইতিহাস। এই দেওয়ালে লেখা আছে, “by public subscription under the auspicious of Mr. Francis Goldsburry, C.S. the then District and Session Judge, Bankura.”
বাঁকুড়া জিলা স্কুলের ইতিহাস থেকে জানা যায়, শুরুতে এই বিদ্যালয়টির খরচ জনতার থেকে চাঁদা তুলেই বহন করা হত। ১৮৪০ সালে ‘The local committee of Public Instruction, Banchoorah’ নামে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। এই কমিটির দায়িত্ব ছিল অবৈতনিক এই স্কুলটিকে সরকারি স্কুলে রূপান্তরিত করা।
এর পর আরও বেশ কিছু বছর কেটে গেল। অবশেষে ১৮৪৬ সালে, Sepay Barrack -এর ঘরে এই স্কুলটি সরকারি স্কুল হিসাবে যাত্রা শুরু করল। আর এই সরকারি স্কুলটির প্রথম প্রধান শিক্ষক হলেন Mr. Beatson.
লটারির মাধ্যমে ছাত্র ভর্তির বিন্দুমাত্র আঁচ যে বাঁকুড়া জিলা স্কুলে লাগেনি, তা এই স্কুলের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলই বলে দেয়। এই স্কুলের নাম মেধা তালিকায় ছিল না, সাম্প্রতিক অতীতে এমন ঘটনা ঘটেনি।
স্কুলের সরস্বতী পুজোয়
এখনও বাঁকুড়া জিলা স্কুলের মূল ভবনের সঙ্গে জুড়ে আছে সেই শুরুর সময়কার অনেক কাহিনি, ঘটনা, যা আজও বাস্তবে নজরে পড়ে।
স্কুলটিতে প্রথম থেকেই স্কুল ভবনের সঙ্গে জুড়ে ছিল শিক্ষকদের বিশ্রামকক্ষ। ১৮৫১ সালে এই বিশ্রাম কক্ষ তৈরি হয়েছিল। এখনও স্কুলের পূর্বদিকের এই বিশ্রাম কক্ষের দেওয়ালে লেখা আছে, THIS ROOM IS ERECTED THROUGH THE LIBERALITY OF MOHARAJADHIRAJ RAJA MAHTAB CHUND, BAHADUR OF BURDWAN A. D. 1851. এই লেখাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, কত ইতিহাসের সাক্ষী বাঁকুড়া জিলা স্কুল।
বাঁকুড়া জিলা স্কুলে যাঁদের শিক্ষাজীবন কেটেছে, তাঁরা পরবর্তীকালে একেকজন কৃতি বঙ্গসন্তান হিসাবে নিজেদের তুলে ধরতে পেরেছিলেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন স্যর রাসবিহারী ঘোষ, দিগম্বর চ্যাটার্জি, বন্দে আলি মিঁয়া, এস এন রায়, বসন্তকুমার নিয়োগী বাহাদুর, রায় যামিনীমোহন মিত্র বাহাদুর, প্রমথনাথ চ্যাটার্জি, রায় যোগেশচন্দ্র রায়বাহাদুর বিদ্যানিধি, রাজাসাহেব ড. রামনাথ মুখার্জি, ‘প্রবাসী’ খ্যাত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, নির্মল কুমার সিদ্ধান্ত, অধ্যাপক দুর্গাগতি চট্টোরাজ প্রমুখ।
স্কুলের কৃতি ছাত্ররা
এখনও ধারাবাহিকভাবে সেই ঐতিহ্য বহন করে চলেছে বাঁকুড়া জিলা স্কুল। আজও বাঁকুড়া জিলা স্কুলের ছাত্ররা দেশে-বিদেশে স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের মাধ্যমে।
শুধু লেখাপড়াই নয়। খেলাধুলা, ক্যুইজ, বিতর্ক, আবৃত্তি, সংগীত, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য, নাট্যচর্চা, বিজ্ঞানচিন্তা প্রভৃতি বিষয়গুলি গুরুত্বের সঙ্গে বাঁকুড়া জিলা স্কুলে পড়ানোর ব্যবস্থা আজও আছে।
১৮৩ বছরে পা রাখা বাঁকুড়া জিলা স্কুলের ছাত্র সংখ্যা ৭৮১ জন। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও পশ্চিমবঙ্গ উচ্ছমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ অনুমোদিত এই স্কুলে লটারিট মাধ্যমেই ছাত্র ভর্তির ব্যবস্থা চালু রয়েছে। অনেকের ধারণা লটারির মাধ্যমে ছাত্র ভর্তির ফলে বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষার নেমে যাচ্ছে। এই মত সমর্থন করেন না বাঁকুড়া জিলা স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক বাদিরবরণ মিশ্র। তাঁর মতে, “প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে আগে যেসব বাচ্চারা সরকারি স্কুলে ভর্তি হত, তাদের মেধার সঙ্গে লটারির মাধ্যমে এখন যারা ভর্তি হচ্ছে, তাদের মেধার তেমন ফারাক থাকে না। আসল বিষয়টা হচ্ছে, স্কুল, ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে একটা সমন্বয় গড়ে তোলা। তাহলে কোনও সমস্যা হয় না। প্রথম শ্রেণিতে যারা ভর্তি হতে আসে, তাদের সবার মেধা প্রায় একই, ঊনিশ-বিশ ফারাক কখনও কখনও হয়। তাই লটারির মাধ্যমে ভর্তিতে সেই অর্থে আমাদের সমস্যা হয়নি। নাহলে, লটারি ব্যবস্থা চালুর পরেও সরকারি স্কুল থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় এতো ভালো ফল কী করে হচ্ছে?”
লটারির মাধ্যমে ছাত্র ভর্তির বিন্দুমাত্র আঁচ যে বাঁকুড়া জিলা স্কুলে লাগেনি, তা এই স্কুলের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলই বলে দেয়। এই স্কুলের নাম মেধা তালিকায় ছিল না, সাম্প্রতিক অতীতে এমন ঘটনা ঘটেনি বলেই স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, তাই আলাদা করে বাঁকুড়া জিলা স্কুলের ছাত্রদের নাম কোন কোন বছর মেধা তালিকায় ছিল, তা উল্লেখ না করলেও হয়।
(পুনঃপ্রকাশিত। প্রথম প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)
তথ্য সূত্রঃ বাঁকুড়া জিলা স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক বারিদবরণ মিশ্র ও স্কুল ম্যাগাজিন
ছবিঃ সংগৃহীত