বাংলার নগরজীবনকে সংস্কৃতি ও মাটির কাছাকাছি নিয়ে এসেছে হস্তশিল্প মেলা

হস্তশিল্প মেলার জন্যই বোধহয় আজ নগরজীবনের অত্যাধুনিক মডিউলার কিচেনে জায়গা করে নিচ্ছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী বেতের বোনা ধামা-কুলো, সুসজ্জিত ড্রয়িং রুমের মূল্যবান শো-পিস বা আসবাবের সঙ্গে সহাবস্থান করছে স্বল্পমূল্যের শোলার তৈরি বাহারি ফুল, বর্ধমানের ডোকরা, নদিয়ার মাটির পুতুল, পূর্ব মেদিনীপুরের পটচিত্র, পুরুলিয়ার ছৌ শিল্প, নতুনগ্রামের কাঠের পুতুল-আসবাব, মুর্শিদাবাদের গ্রামের মহিলা শিল্পীদের বানানো পাটের পুতুল, জঙ্গলমহলের বাহামনি, টুসু, টগরদের বানানো বাঁশ, বেত, ঘাস, কাঠ-সহ বিভিন্ন উপকরণ, ঝাড়গ্রামের কাটুমকুটুম, সাবাই ঘাসের সামগ্রী, বিষ্ণুপুর-বাঁকুড়ার পোড়ামাটি, উত্তর চব্বিশ পরগনার শিং দিয়ে বানানো দৈনন্দিন ব্যবহারের সামগ্রী। শহুরে কচিকাঁচাদের মনোরঞ্জন করছে তালপাতার সেপাই-ভেঁপু।
লাল মাটির দেশে মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প বলা রেলপুতুল, নয়া গ্রামের পটুয়া বসতির মেয়েদের হাতে গড়া ‘যো’ নামের ষষ্ঠী পুতুল, রায়গঞ্জের মালিক গাজির ঘোড়া – অবাক হতে হয়, হস্তশিল্প মেলায় এইসব ঐতিহ্যবাহী পুতুলগুলির দাম ৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা মাত্র। নিউটাউনের এক বাসিন্দার কথায়, বাংলায় যে এত রকমের পুতুল আছে, জানতেন না তিনি। নিজস্ব ইতিহাস আছে এসব হস্তশিল্পের। শহরের বিভিন্ন ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান এইসব পুতুল বিক্রি করেন চড়া দামে। অথচ হস্তশিল্প মেলায় সেসবই সরাসরি শিল্পীদের কাছ থেকে নায্যদামে পাওয়া যায়।
লাল মাটির দেশে মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প বলা রেলপুতুল, নয়া গ্রামের পটুয়া বসতির মেয়েদের হাতে গড়া ‘যো’ নামের ষষ্ঠী পুতুল, রায়গঞ্জের মালিক গাজির ঘোড়া – অবাক হতে হয়, হস্তশিল্প মেলায় এইসব ঐতিহ্যবাহী পুতুলগুলির দাম ৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা মাত্র।
অন্যদিকে, বাঁকুড়ার মৃৎশিল্পী সুবল পাল বলছিলেন, “আমাদের গ্রাম থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে কলকাতার এই মেলায় অংশগ্রহণ করতে আসতে হয়। ছোটো-ছোটো সূক্ষ মাটির জিনিস বয়ে আনার ঝুঁকি থাকে। তবু, এই মেলার খবর এলে যখন কলকাতা আসি, অদ্ভুত একটা আনন্দ হয়। কারণ আমি জানি, আমাদের কষ্টের এই কাজগুলো মানুষ পছন্দ করবেন এবং সঠিক মূল্য দেবেন। আর আমরাও যেন ক্রেতাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারি। তাঁদের জন্যেই তো আমাদের কাজ করে যাওয়া। এতবছর ধরে এখানে আসছি, যেখানেই বসি না কেন, ক্রেতারা ঠিক খুঁজে চলে আসেন।”
প্রতি বছরের মতো শীতের আমেজ নিয়ে নিউটাউনের ইকোপার্কে ২৪ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে হস্তশিল্প মেলা। চলবে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। মেলার আয়োজক রাজ্যের ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ এবং বস্ত্র দফতর। এবারও পশ্চিমবঙ্গের ২৩টি জেলার হস্তশিল্পীরা হাজির হয়েছেন তাঁদের সম্ভার নিয়ে। ছোটো-বড়ো মিলিয়ে প্রায় ৭,০০০ স্টল নিয়ে শুরু হয়েছে এই মেলা। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ৫০টি প্যাভিলিয়ন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটিতে রয়েছে প্রায় ৪০টি করে স্টল। এছাড়াও ইকোপার্কের গেট নম্বর ১-এর খোলা মাঠে আরও ৩,০০০ হাজার স্টল রয়েছে। দৈনন্দিন সামগ্রী থেকে ঘর সাজানোর বাহারি জিনিস ক্রেতার চোখের সামনে নিমেষেই তৈরি করে দিচ্ছেন শিল্পীরা। স্টলগুলির নাম দেওয়া হয়েছে জেলার নদী বা পাহাড়কে ভিত্তি করে। কংসাবতী-ময়ূরাক্ষী থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা-কল্লোলিনী – প্রতিটি স্টলেই উপচে পড়া মানুষের ভিড়। উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ থেকে মাটির জিনিস নিয়ে এসেছেন সুকুমার পাল। তাঁর স্টলে পাওয়া যাচ্ছে ছাঁচের দুর্গা থেকে মাটির সাইকেল, ষষ্ঠী পুতুল থেকে মাটির কলসী আরও কত কী! বঙ্গদর্শন.কম-কে তিনি বলেন, “আগে ভাবতাম শহরে এলে হারিয়ে যাব, ভয় করত। গত কয়েকবছর সে ভয়কে জয় করেছি। কারণ হস্তশিল্প মেলার ক্রেতারা আমায় ভালোবেসেছেন, আমার কাজকে সম্মান দিয়েছেন। কষ্ট হলেও তাই প্রতিবছর আমার হাতে বানানো জিনিস নিয়ে চলে আসি। মনে আশা থাকে, ফেরার সময় খালি হাতেই ফিরতে হবে।”
প্রসঙ্গত, রাজ্য সরকার পরিচালিত এই হস্তশিল্প মেলা থেকে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের বাছাই হয়। এরপর দিল্লির জাতীয় মেলায় শিল্পীরা বাংলার গৌরব শিল্পকলা তুলে ধরেন এবং জাতীয় স্তরের স্বীকৃতি অর্জন করেন বাংলার বহু শিল্পী। রাজ্য স্তরের এই মেলা শেষে বাছাই করা শিল্পীদের পরবর্তী গন্তব্য হবে দিল্লির জাতীয় হস্তশিল্প মেলা।
____
ছবি ও প্রতিবেদন: সুমন সাধু, মৌনী মণ্ডল