এবার সব স্কুলে বাধ্যতামূলক হবে বাংলা ভাষা, সিদ্ধান্ত রাজ্যের

“মোদের গরব মোদের আশা/ আ মরি বাংলা ভাষা”
বাংলা ভাষা-র অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রাম- মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকা, বরাক, কাছাড়, মানভূমের ইতিহাসের জমিতে লেগে আছে বাংলা ভাষা শহিদদের রক্ত- বরকত, জব্বার, সালাম, কানাইলাল নিয়োগী, হিতেশ বিশ্বাস। বিশাল তালিকার মধ্যে এই কয়েকটি নাম ‘কোটিতে গুটি’ মাত্র। এশিয়ার প্রথম নোবেল প্রাপক হলেন বাংলা ভাষার অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠ লেখক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বিপুল বৈচিত্র্যময় দেশ ভারতের জাতীয় সংগীত বাংলা ভাষাতেই রচিত। বাংলাদেশ- ভাষাই এই দেশ সৃষ্টির অন্যতম মূল ভিত্তি। সারা বিশ্বেই বাংলার এমন অজস্র মণিমুক্তো ছড়ানো। কিন্তু অনেকের মতেই, বর্তমান সময়ে নিজভূমে পরবাসী বাংলা ভাষা। স্কুল-কলেজ, বিশেষত বেসরকারি ইংরেজি বা হিন্দি মাধ্যম স্কুলে ব্রাত্যই থাকে বাংলা ভাষা। দ্বিতীয় শ্রেণির ভাষার সান্ত্বনা পেয়ে পড়ে থাকে এককোণে। বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রেই বাংলার বদলে ইংরেজি আর হিন্দির ব্যবহার চোখে পড়ে খাস বঙ্গভূমেই। এবার সেই অবস্থা কিছুটা বদলালেও বদলাতে পারে। সৌজন্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি সিদ্ধান্ত। যেখানে বলা আছে, রাজ্যের যে কোনও স্কুলে বাধ্যতামূলক হবে বাংলা ভাষা। সরকারি, বেসরকারি, আধা-সরকারি, ইংরেজি, বাংলা বা অন্য মাধ্যমের স্কুল, সে যাই হোক না কেন। সম্প্রতি রাজ্য মন্ত্রীসভায় গৃহীত এবং অনুমোদিত হয়েছে এই সিদ্ধান্তটি। শিক্ষা দপ্তর সূত্রে জানা গেছে এমনই একটি খবর।
জানা গেছে এই নীতি কার্যকর করার জন্য আইনও আনবে রাজ্য সরকার। গঠন করা হবে কমিশনও। এছাড়া, রাজ্যের যেই অংশে যে যে লোকায়ত ভাষার প্রচলন বেশি, সেই অঞ্চলে পড়ানো যাবে সেই ভাষাও। এর ফলে চালু হতে পারে পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তরীয় ভাষানীতি। বাংলা, ইংরেজি এবং অঞ্চলভেদে হিন্দি বা আঞ্চলিক ভাষা।
বাংলা ভাষাকে নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক চড়াই-উতরাই শুধু আজকের কাহিনি নয়। দেশভাগের অন্যতম বলি ছিলেন বাংলা ভাষাভাষী মানুষই। হিন্দি আগ্রাসন আর প্রাদেশিকতার দ্বন্দ্ব পিছু ছাড়েনি এই ভাষার। বিধান রায়ের আমলে বাংলা আর বিহার সংযুক্তিকরণের প্রস্তাবে যেমন টালমাটাল হয়ে পড়েছিলো বাঙালি আর বাংলা ভাষার শ্রেণিগত এবং সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান, তেমনই কলোনিয়াল হ্যাংওভার-এর চাপে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে বাংলার ভাষাগত কাঠামো। বিধানচন্দ্র রায় রাজনৈতিক কারণে প্রস্তাব ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু কলোনিয়াল হ্যাংওভারের সামাজিক অভিঘাত আজও বহমান। আজকের মুক্ত অর্থনীতির বাজারে যখন বিশ্ব এসে বিশ্বে মেলায়, দেশ মেলায় দেশে, তখন ভাষার শুদ্ধতা বাঁচানো খানিক ইউটোপিয়াও বটে। আর ভাষাতত্ত্ববিদরা বলেন, এক ভাষা, অন্য ভাষার থেকে শব্দ বা তত্ত্ব আহরণ করেই বাঁচে। বাংলাও তেমনই আত্মস্থ করেছে অনেক ভাষাকে। হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, পর্তুগিজ, ফরাসি, সংস্কৃত, অন্যান্য দেশীয় লোকায়ত ভাষার শব্দ হয়ে পড়েছে বাংলা শব্দ (যেমন- ‘শ্রদ্ধা’, ‘পিতা’, ‘মাতা’- সংস্কৃত; ‘আইন’, ‘আদালত’- আরবি; ‘চশমা, চাকরি’- ফারসি; ‘খাদি’, ‘চরকা’- গুজরাতি, ‘বর্গি’, ‘পেশোয়া’- মারাঠি ইত্যাদি)। অন্যপক্ষের মতামত, আত্মস্থ করা আর নিজের বৈশিষ্ট্য ভুলে অন্য ভাষা চাপিয়ে নেওয়া বা চাপিয়ে দেওয়া এক নয়। তার উদাহরণ ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে, বিভিন্ন সংস্থার দপ্তরে, রেলস্টেশন, বা বাস টার্মিনাসে- যেখানে হিন্দি বা অন্য ভাষা থেকে সরাসরি নকল করে বসানো হয় বাংলা শব্দ, বলা ভালো দৃষ্টিকটু ও শ্রুতিকটু শব্দ আমদানি করা হয়, সেই মূল শব্দের একাধিক বাংলা প্রতিশব্দ থাকা সত্ত্বেও। ‘কিউ কি’ থেকে ‘কেন কি’ (সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ হলো ‘কারণ’), ‘আচ্ছে লাগর্যাহে হো’ থেকে ‘ভাল্লাগছিস’ (সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ- ভালো লাগছে) ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রে হিন্দি আর ইংরেজিতে নির্দেশিকা বা নাম লেখা থাকলেও বাংলাতে লেখা থাকে না কিছুই। শুধু ভাষাতত্ত্বই নয়, এটি নাগরিক সুবিধা-অসুবিধার প্রশ্নও। যাঁরা শুধু বাংলা ভাষাই পড়তে জানেন, তাঁদের ক্ষেত্রে রাস্তাঘাটে অসুবিধার সৃষ্টি করে এমন হোর্ডিং বা প্ল্যাকার্ড।
ভাষার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো বানান বিধি এবং ব্যাকরণ। ভাষা ভাবপ্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু ভাষার গুরুত্ব শুধু ভাব প্রকাশেই সীমাবদ্ধ নয়। ভাষা জ্ঞানচর্চার মাধ্যম। সংস্কৃতির মাধ্যম। ভাষা জাতির গল্প বলে। ভাষার ভাঙাগড়ায় জড়িয়ে থাকে জাতির, অঞ্চলের ইতিহাস, লোকাচার, সামাজিক অভ্যাস। বাংলা ভাষার অন্তর্দ্বন্দ্বও কম নয়। খাস কলকাত্তাইয়া বাংলা হিসাবে যা বহুল প্রচলিত, তার মূলগত ভিত্তি নদিয়া জেলার শান্তিপুর। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ মানে তো শুধু কলকাতা নয়। পশ্চিমবঙ্গ মানে বাংলার আঞ্চলিক ভাষা-ও। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ‘খাবুনি’, ‘যাবুনি’, পূর্ব মেদিনীপুরের ‘হইঢ়ক্যা পইড়ালুনি’, বাঁকুড়ার ‘ঝুনক্যাঁ ভোর’ (অর্থ- কাকভোর), ইত্যাদি। আর আছে বাঙাল-ঘটির চিরকালীন দ্বন্দ্ব। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, ইলিশ-চিংড়ির মতো তা বিস্তৃত ভাষাতেও। অথবা বলা চলে, ভাষা থেকেই তা ছড়িয়ে গেছে অন্যত্র। কলকাতা বা সংলগ্ন অঞ্চলে আসা মানুষ তাঁদের ভাষাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন, কিন্তু কতটা ব্যবহার করতে পারেন, তা তর্কযোগ্য। তাঁরা শিখে নেন কলকাতার বাংলা ভাষা। রাজ্যের এই সিদ্ধান্ত তাঁদের জন্য খানিক স্বস্তি তো বটেই। বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায় থাকা আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদেরও এতোদিন পড়তে হতো কলকাত্তাইয়া ভাষায় লেখা পাঠ্যবই। এখন থেকে তাঁরা নিজেদের ভাষাও পড়তে পারবেন স্কুলে।
বাংলা বিনোদন বা সাহিত্যের জগতেও লোকায়ত বাংলার ব্যবহার কদাচিৎই চোখে পড়ে। আবার সেখানেও বাংলার থেকে বেশি ব্যবহৃত হয় বাংলা-হিন্দি-ইংরেজির অদ্ভুত জগাখিচুড়ি ভাষা। শিক্ষাক্ষেত্রে কলা বিভাগের উচ্চশিক্ষায় যদি বা বাংলা ভাষায় লেখা বইয়ের দেখা মেলে, বিজ্ঞান বিভাগে সেই উদাহরণ বিরল। প্রতিযুক্তি হিসাবে বলা যায়, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিশেষ তত্ত্ব বা শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ জোর করে উদ্ভাবন করতে হবে, নয় তত্ত্বটি হয়ে পড়বে অহেতুক জটিল। আজকের প্রজন্ম কথোপকথনেও বাংলার থেকে হিন্দি বা ইংরেজিতেই বেশি সক্রিয়। তাঁদের সামনে পড়ে অহেতুক গুটিয়ে থাকেন বা হীনমন্যতায় ভোগেন বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করা বা বাংলার অন্য জেলাগুলি থেকে আসা মানুষটি। স্পষ্ট হয়ে যায় আর্থ-সামাজিক শ্রেণিভেদ। বাংলা ভাষা বা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার পর কাজ বা চাকরির সুযোগের অপ্রতুলতাও বাংলা ভাষার থেকে অনেকের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণ। রাজ্য সরকারি স্কুলে বাধ্যতামূলক ভাষা হিসাবে বাংলা থাকলেও, তা রক্ষিত হয় না অনেক বেসরকারি স্কুলেই, বিশেষত ইংরেজি আর হিন্দি মাধ্যমের স্কুলগুলিতে। সাম্প্রতিককালে লোরেটো কলেজের একটি ভর্তির বিজ্ঞাপনে বাংলা আর অন্যান্য আঞ্চলিক মাধ্যমের পড়ুয়াদের ব্রাত্য করায় বিপুল বিতর্ক তৈরি হয়েছিলো। আবার অনেকের অভিযোগ, কর্মসূত্রে ভিন রাজ্য থেকে আসা অনেক মানুষ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করা মানুষ সেই অঞ্চলেই ক্রমশ কোনঠাসা করে ফেলছেন বাংলা ভাষাকে। সেসব অঞ্চলে গেলে না কি লোকের মুখের ভাষা শুনে বোঝাই দায়, সেটি আসলে পশ্চিমবঙ্গের অংশ, যে রাজ্যের মুখ্যভাষা বাংলা। প্রতিযুক্তি হিসাবে অনেকেই বলেন, আসলে সেই অঞ্চল থেকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা কমে আসাই এর প্রধান কারণ। যাইহোক, শুধু ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার জন্য ভিন্ন প্রদেশের মানুষের ওপর সব দায় চাপানো ঠিক নয়। বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর দায়িত্ব বাঙালির। দায়িত্ব সেই বিজ্ঞাপন লেখকের, যিনি ইংরেজি বা হিন্দি শব্দ বাংলা ফন্টে লিখে দিচ্ছেন, সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ না খুঁজে। দায় সেই লেখকের, যিনি ভুল বানানে দিনের পর দিন লিখে চলেছেন, এবং প্রকাশকের, যিনি সেই বানান ঠিক করে দিচ্ছেন না ছাপানোর আগে। দায় সিনেমা-থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত মানুষের, যাঁরা জগাখিচুড়ি ভাষায় সংলাপ লিখছেন এবং প্রয়োগ করছেন। দায়িত্ব পাঠকের, দর্শকের, শ্রোতার, দায় এই প্রতিবেদকেরও, যার বাংলা লেখা উপরোক্ত ত্রুটিগুলি থেকে মুক্ত নয়। দায়িত্ব সব্বার। আন্তর্দ্বন্দ্ব আর অন্তর্দ্বন্দ্বেই সমৃদ্ধ হয় ভাষা, সমাজ। আশা করা যায়, স্কুলে বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক করার নতুন এই নীতি আবার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাংলা ভাষার দিকে প্রেরিত করবে, বাংলা ভাষার রথ ছুটে চলবে আরও দীর্ঘ পথ। আর কোনও কবিকে লিখতে হবে না এমন পংক্তি- “আমার ছেলে খুব পজেটিভ, অলীক স্বপ্নে ভাসে না/ জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না”।