মৎস্যজীবীদের আধুনিক প্রযুক্তি শেখাতে পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য দপ্তরের ‘অন্যরকম’ প্রয়াস

মৎস্যজীবীদের প্রায়ই দূরের জেলা থেকে মাছ নিয়ে আসতে হয়। রাস্তাতেই যানবাহনে কিছু মাছ মারা যায় অনেক সময়। আবার নতুন জায়গায় আসার পর অনেক মাছ পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। ফলে তারাও মারা যায়। মৎস্যজীবীরা চিন্তায় পড়েন। মুশকিল আসান করতে এবার অন্যরকম এক প্রয়াস শুরু করল রাজ্য মৎস্য দপ্তর। যৌথ উদ্যোগে তাদের সঙ্গে রয়েছে কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর অধীন মহিলা মৎস্যজীবীদের নিয়ে প্রশিক্ষণ পর্ব শুরু হয়েছে। রাজ্য মৎস্য দপ্তরের উত্তরবঙ্গের অতিরিক্ত অধিকর্তা ডঃ প্রশান্ত কুমার জানা বললেন, “প্রথমে জলপাইগুড়ি জেলার রামশাই কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রে ২ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রশিক্ষণ হলেও পরবর্তীতে অন্য জেলাগুলোতেও প্রশিক্ষণ হবে।”
আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের প্রশিক্ষণ
জলপাইগুড়ি জেলার রামশাই কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রে সাতটি ব্লকের ১২টি মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ২৪ জন মহিলাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তিতে কীভাবে মাছ চাষ করা যায়। ছোটো চারাপোনা মাছ কীভাবে তৈরি হয়, ধানিপোনা মাছ কীভাবে উৎপাদন হয়, তার লালনপালন কীভাবে হয় ইত্যাদি। জলপাইগুড়ি জেলার মৎস্য দপ্তরের পদস্থ আধিকারিক সুমন সাহা বললেন, মাছ চাষে তাঁরা জৈব সারের ওপরই জোর দিচ্ছেন। বিশেষ করে কেঁচো সার। এই জৈব কেঁচো সার পুকুরে প্রয়োগ করা হয়। কিছু মাছ পুকুরে সার থেকে উদ্ভিজ্জ কণা, কিছু মাছ প্রাণীজ কণা গ্রহণ করে। যেমন মাতৃদুগ্ধ পানেই শিশুর পুষ্টি-বৃদ্ধি ভালো হয়, ঠিক তেমনি, এইসব উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ কণা পুকুরে যত ভালো থাকবে, মাছের বৃদ্ধি ততই ভালো হবে।
তত্ত্বগত দিক ছাড়াও ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়
কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র, রামশাই এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা কীভাবে মাছ চাষ ভালো মতো করা যায়, তার গবেষণা করছেন প্রতিনিয়ত। তাঁদের উদ্ভাবনের অনেক বাস্তব প্রয়োগ হচ্ছে। যার একটি হল, ক্ষুদ্র প্রান্তিক মৎস্যচাষীদের আধুনিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদনের প্রশিক্ষণ দেওয়া। মৎস্য বিজ্ঞানী ইন্দ্রনীল ঘোষ এজন্য বিশেষভাবে কাজ করছেন। ইন্দ্রনীলবাবু জানান, “জলপাইগুড়ি জেলায় মাছের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মাছের বৃদ্ধি ঠিকমতো হয় না। একটি কারণ, উপযুক্ত মানের উন্নত চারাপোনা পাওয়া যায় না। বহু চাষি সঠিক বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চাষবাস করেন না। তাই মাছ চাষে তত্ত্বগত দিক ছাড়াও ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পুকুরে ধানিপোনা, চারাপোনার চাষবাসের কাজ শুরু হয়েছে। যাতে আগামী বর্ষার আগেই গুণগত মানে ভালো মাছের উৎপাদন বেশি করে পাওয়া যায়।”
উত্তরবঙ্গের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলা মৎস্যজীবীদের নিয়ে প্রশিক্ষণ পর্ব শুরু হয়েছে জলপাইগুড়ি জেলার কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রে
পুকুরে এই মাছ চাষে নব্বই দিন সময় লাগে। প্রথমে মৎস্য দপ্তরের সহায়তায় কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র, রামশাইয়ের উদ্যোগে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলা মৎস্যজীবীদের প্রশিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে। জলপাইগুড়ি জেলার অনুমোদিত হ্যাচারিগুলো এজন্য মাছের চারাপোনা সরবরাহ করছে। আবার মাছ উৎপাদন হলে রাজ্য সরকারই স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মৎস্যজীবীদের থেকে সব মাছ কিনে নেবে। যে পুকুরে মাছ চাষ হবে তার পাশের জায়গায় মাচা তৈরি করে সবজি চাষেরও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে পশু বিজ্ঞানী মানস কুমার দাস সেখানে শেখান, যে পুকুরে চাষ হবে তার পাশে মাচা বানিয়ে, সবজির সঙ্গে খাঁচা তৈরি করে হাঁস ও মুরগি প্রতিপালন হবে। নিচে হাঁস, ওপরে মুরগি। সেই অনুযায়ীও কাজ হচ্ছে। প্লাস্টিকের চৌবাচ্চার মধ্যে কেঁচো সার তৈরির পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। ফেলে দেওয়া সামগ্রী থেকে সার তৈরি, গোবর সার – সবেরই কথা বলা হয়।
মাছের চারাপোনা সরবরাহ করছেন জলপাইগুড়ি জেলার কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের দত্তক নেওয়া মৎস্যজীবীরা
অতিরিক্ত মৎস্য অধিকর্তা ডঃ প্রশান্ত কুমার জানা বললেন, “এইভাবে মাছ চাষ হলে শরীরে প্রোটিনের চাহিদা মিটবে অনেকটা। পুকুর পরিবেশের ভালো হবে। পুকুরগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগবে। মৎস্যজীবীদের কিছু আর্থিক সুরাহাও হবে। চাষিরা প্রয়োজন অনুযায়ী কিষান ক্রেডিট কার্ড থেকেও ঋণ নিতে পারেন।”