শশাঙ্ক কি সত্যিই ‘গৌড়াধম’ ছিলেন?

রাজা শশাঙ্ক বোধিবৃক্ষ কেটে দেন। শুধু তাই নয়, একাধিক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে রাজ্য থেকে বিতাড়িতও করেন। বৌদ্ধধর্মের একাধিক নিশানি ধ্বংস করেন। পাটলিপুত্রে ভগবান বুদ্ধের পদচিহ্ন অঙ্কিত এক খণ্ড যে পাথর ছিল, গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করেন সেটিকেও। রাজা শশাঙ্কের এহেন বৌদ্ধ বিরোধিতার কারণ কি ছিল শুধুই রাজনৈতিক, নাকি নেপথ্যে ছিল অন্য কিছু?
রাজা শশাঙ্ক সম্পর্কে জানা যায় বাণভট্টের হর্ষচরিত, হিউ-এন-সাঙের ভারত ভ্রমণবৃত্তান্ত 'সি-ইউ-কি' এবং বৌদ্ধ গ্রন্থ 'আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প' থেকে। তবে তাও খুবই সামান্য।
গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক ছিলেন কর্ণসুবর্ণের একছত্র সম্রাট। যে কর্ণসুবর্ণ এখন মুর্শিদাবাদ জেলায়। শশাঙ্ক শুধু একজন বিচক্ষণ শাসকই ছিলেন না, ছিলেন প্রাচীন বাংলা জনপদের প্রথম স্বাধীন পরাক্রান্ত নরপতি। তিনি বাংলার বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যকে একত্রিত করে 'গৌড়' নামক জনপদের প্রতিষ্ঠা করেন।
শশাঙ্ক সিংহাসনে বসেই উপাধি নেন 'গৌড়াধিপ'। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন বেশ জটিল। একদিকে গৌড়-মালব শক্তিজোট অন্যদিকে থানেশ্বর-কনৌজ মিত্রজোট। রাজনৈতিক কারণে শশাঙ্কের নেতৃত্বাধীন গৌড়-মালব মিত্রজোটের সাথে হর্ষের নেতৃত্বে থাকা থানেশ্বর-কনৌজ মিত্রজোটের সংঘর্ষ বাধে। দাদা রাজ্যবর্ধন, ভগ্নীপতি গ্রহবর্মার হত্যাকারী এবং বোন রাজ্যশ্রীকে কারাগারে নিক্ষেপকারী গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে হর্ষবর্ধন থানেশ্বর ও কনৌজকে একত্রিত করেন ও যুদ্ধ ঘোষণা করেন। রাজনৈতিক ভাবে হর্ষের প্রতিপক্ষ হয়ে যান শশাঙ্ক। সময়ের সাথে সাথে এই দুই রাজার রাজনৈতিক বিরোধিতা ধর্মীয় বিরোধিতায় পরিণত হয়।
রাজা হর্ষবর্ধন প্রথমজীবনে শৈব ছিলেন, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের একজন মহান পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। হিন্দুধর্মের জটিল সংস্কার, আড়ম্বর এসব থেকে বেরিয়ে এসে রাজা হর্ষ সহজ সরল আড়ম্বরহীন বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তিনি চিনদেশ থেকে আগত বৌদ্ধ পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙ কে সম্বর্ধনা দেন। মহাযান মতবাদ প্রচারের জন্য কনৌজে এক বিশাল সভার আহ্বান করেন। কনৌজের পর তিনি প্রয়াগেও অনুরূপ বিশাল ধর্মসভার আয়োজন করেন।
হর্ষবর্ধনের বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখে ব্রাহ্মণদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তারা বিদ্রোহ করে। ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহ অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দমন করেন রাজা হর্ষ। হর্ষবর্ধনের প্রবল ব্রাহ্মণ বিদ্বেষ ও বৌদ্ধপ্রীতি শৈব রাজা শশাঙ্ককে ব্যথিত করে। তিনি হর্ষবর্ধনের সমর্থনপুষ্ট বৌদ্ধদের পৃষ্ঠপোষকতা করার পরিবর্তে আশ্রয়হীন ব্রাহ্মণদের নিজরাজ্যে আশ্রয় দিলেন।
শশাঙ্ক প্রচার করেন, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা রাজা হর্ষকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। একথা শুনে বৌদ্ধরা শশাঙ্কের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তখন হিন্দু ব্রাহ্মণরা একত্রিত হয়ে শশাঙ্ককে সমর্থন করে ও বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে শশাঙ্ককে।
আরও পড়ুন
কখনা-মিহিরের ঢিপি
শশাঙ্কের এই তীব্র বৌদ্ধবিরোধীতা দেখে হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্ট এবং হর্ষবর্ধন আশ্রিত চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙ দুজনেই শশাঙ্ককে 'বৌদ্ধবিদ্বেষী' তকমা দিয়ে দেন। বাণভট্ট আরো কয়েকধাপ এগিয়ে গৌড়েশ্বরকে 'গৌড়ভুজঙ্গ', 'গৌড়াধম' অবধি বলে দেন। এমনকি হর্ষবর্ধন নিজে শশাঙ্ক প্রসঙ্গে এক জায়গায় লিখেন, গৌড়েশ্বরের নাম মুখে আনলে জিহ্বা পাপকার্যে লিপ্ত হয়।
কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, রাজা হর্ষের মদতপুষ্ট কবি বাণভট্ট নিজের আশ্রয়দাতা মহারাজকে নিয়ে অবশ্যয় গুণকীর্তন করবেন, তাঁর মতবাদকেই সম্মান দেবেন এটাই স্বাভাবিক। বাণভট্ট হর্ষের মহিমা নিয়েই লেখেন 'হর্ষচরিত', যেখানে শশাঙ্ককে নির্দ্বিধায় তিনি বৌদ্ধবিদ্বেষী বলেছেন। অন্যদিকে হিউ-এন-সাঙ রাজা হর্ষের কাছ থেকে সম্মান ও সম্বর্ধনা পেয়েছিলেন যেকারণে তিনিও হর্ষের গুণগান করেছেন। আর হিউ-এন-সাঙ বৌদ্ধ পরিব্রাজক ছিলেন।
শশাঙ্ককে যেভাবে বাণভট্ট এবং হিউ-এন-সাঙ বৌদ্ধবিদ্বেষী বলে বর্ণনা করেছেন শশাঙ্ক হয়ত ততটাও বৌদ্ধবিদ্বেষী ছিলেন না। কারন, সেসময় তাঁর রাজ্যে অনেকগুলি সক্রিয় বৌদ্ধবিহার ছিল। গৌড়ে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার ছাড়াও আরও প্রায় দশটির মত সমৃদ্ধশালী বৌদ্ধবিহারের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে, হিউ-এন-সাং নিজেই সে নিয়ে লিখেছেন সি-ইউ-কি গ্রন্থে ।
শশাঙ্কের বৌদ্ধবিদ্বেষ হয়ত বৃদ্ধি পেয়েছিল রাজা হর্ষবর্ধনের কারণে। রাজা হর্ষের ব্রাহ্মণদের প্রতি অবহেলা, অপমান শশাঙ্ককে বৌদ্ধবিরোধী হতে একরকম বাধ্য করেছিল। আর সেই কারণেই শশাঙ্ক কুশীনগর বৌদ্ধবিহার থেকে বৌদ্ধদের তাড়িয়ে দেন। শুধু তাই নয়, সমূলে বৌদ্ধধর্মের বিনাশ ঘটাতে উদ্যোগী হন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিদ্বেষবশত শশাঙ্ক পাটলিপুত্রে ভগবান বুদ্ধের পদচিহ্ন অঙ্কিত এক খণ্ড যে পাথর ছিল তা গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করেন। আর সব শেষে যে মারাত্মক কাজটি তিনি করেন তা হল গয়ার বোধিবৃক্ষ কেটে ফেলতে আদেশ দেন। শুধু বোধিবৃক্ষ কেটে ফেলেই তিনি শান্তি পাননি। মাটি খুঁড়ে বোধিবৃক্ষের শিকড়গুলি অবধি কেটে ফেলেন এবং বাকি যা ছিল সব আগুনে পুড়িয়ে দেন। শশাঙ্কের বোধিবৃক্ষ ছেদনের ফলে রাজা হর্ষবর্ধনই নন বৌদ্ধরাও শশাঙ্কের তীব্র বিরোধিতা করে।
বাণভট্টের বিবরণ অনুযায়ী, বোধিবৃক্ষ ছেদনের পাপেই নাকি 'গৌড়াধিপ' শশাঙ্ক কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন। এই রোগে তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পচন ধরা শুরু করে, যার ফলে মারা যান শশাঙ্ক। আবার কেউ কেউ বলেন শশাঙ্ক একাধিক বুদ্ধমূর্তি নষ্ট করেছিলেন। আর ভগবানের মূর্তি নষ্ট করার কারণে তার শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং শশাঙ্ক মারা যান।
ঋণ :
বাণভট্টের হর্ষচরিত।
হিউ-এন-সাঙের ভারত ভ্রমণবৃত্তান্ত 'সি-ইউ-কি'।
বৌদ্ধ গ্রন্থ 'আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প'।
গঞ্জামের সামন্তরাজ দ্বিতীয় মাধববর্মার তাম্রশাসন।