বিদ্যাসাগর ও তাঁর ‘তালতলার চটি’ রাজনীতি

বিদ্যাসাগরের ছবি ধুতি-চাদর ছাড়া যেমন ভাবা যায় না, ঠিক তেমনই তালতলার চটি বাদ দিয়েও তাঁকে কল্পনা করা দুষ্কর। এমন নয় যে বিলিতি জিনিস বর্জনের নেশায় তালতলার চটি বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই ফ্যাশন স্টেটমেন্টের ভিতর রয়েছে গূঢ় ‘রাজনৈতিক’ অভিপ্রায়। এখানে ‘রাজনীতি’ শব্দটি অবশ্যই ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করছি। কতকগুলো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাঁর ‘তালতলার চটি’ তত্ত্বটিকে বোঝার চেষ্টা করব।
১৮৭৪-এর ২৮ জানুয়ারি। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য বিদ্যাসাগর। সেই উপলক্ষেই সোসাইটিতে যাচ্ছেন। কিন্তু বাধা দিল দ্বাররক্ষী। চটি পরে ভিতরে যাওয়া যাবে না। বুট পরলে অবশ্য অসুবিধা ছিল না, কিন্তু চটি ফটফটিয়ে সোসাইটির ভিতর, নট অ্যালাও। হয় চটি বাইরে খুলে যান, নাহলে খালি পায়, হাতে চটি নিয়েও যেতে পারেন। স্বভাবতই অপমানিত স্বাভিমানী বিদ্যাসাগর। দরজা থেকেই ফিরে গেলেন। শোনা যায় ফিরে যাওয়ার সময় তাৎক্ষণিক একটি শ্লোক বানিয়ে আওড়াতে আওড়াতে বেরিয়ে আসেন সেখান থেকে। শ্লোকটি হল, ‘বিদ্বত্বঞ্চ জুতত্বঞ্চ নৈব তুল্যং কদাচন।/ স্বদেশে পুজ্যতে বিদ্যা, জুতা সর্বত্র পুজ্যতে’। অর্থাৎ বিদ্রূপাত্মক এই শ্লোকটি বলছে, বিদ্বান আর জুতোর কোনও তুলনা হয় না। বিদ্যার কদর কেবল স্বদেশে আর জুতোর জয়জয়কার সর্বত্র।
আর ফিরেই কড়া করে চিঠি লিখলেন কর্তৃপক্ষকে। ইংরাজি সেই চিঠি বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায় খানিকটা এই রকম। ‘ ইংরেজি প্যাটার্নের শু পরে দিব্য ঢোকা যাচ্ছে, আর দেশীয় চটিতে নয়!’ বিদ্যাসাগরের প্রশ্ন অতি ‘নিরীহ’। ‘জীবনে একই পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি একই পরিস্থিতে সোসাইটিতে ঢুকতে বাধা পাচ্ছেন, কেবল মাত্র দেশীয় পাদুকা পরিধানের জন্য। আমি এর কোনও কারণ দেখতে পাচ্ছি না’। একবার ভাবুন পাঠক, সেই কোন বিদ্যাসাগরের কালে পরিধান দিয়ে ব্যক্তিকে মাপার বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। তাঁর জেহাদ ছিল ইংরেজ কর্তৃপক্ষর বিরুদ্ধে। আজও দেশীয় পরিধান দেখে শপিং মল, ক্লাব বা রেস্তোরায় আমাদের ঢুকতে বাধা দেয় আমাদেরই স্বজাতীয় ভারতীয়। কলোনিয়ালিজমের কিছু প্রোথিত অভ্যাস যে ভারতীয় মানবাত্মাকে কলুষিত করতে চলেছে, এমনকি সুদূর ভবিষ্যতেও, তা কি এই মহামানব সেই ১৮৭৪-এই বুঝতে পেরেছিলেন?

তালতলার চটি পরার জন্য তাঁর এশিয়াটিক সোসাইটিতে না ঢুকতে পারার খবর আজকের ভাষায় ‘ভাইরাল’ হয়ে গেল। ইংরেজি কাগজগুলিতে সবিস্তার ঘটনা সমেত বিদ্যাসাগরকে সমর্থন করা হল। আর ‘সাধারণী’ পত্রিকায় অক্ষয়চন্দ্র সরকার ‘তালতলার চটি’ শীর্ষক ব্যাঙ্গাত্মক প্রতিবেদনে লিখলেন, ‘রে তালতলার চটি ইংরাজের আমলে কেবল তোরই অদৃষ্ট ফিরিল না!...ইংরাজের চক্ষে উচ্চ নীচ নাই, কেবল রে চর্ম্মচটি! তোরই প্রতি তাঁহাদের সমদৃষ্টি হইল না। ইংরাজ বাহাদুর বস্ত্রপরিস্কারককে অস্ত্রচিকিৎসক করিয়াছেন, ধীবর মৎস্যজীবীকে ধীমান বিচারপতির কার্য্যে নিযুক্ত করিয়াছেন...কিন্তু হতভাগ্য তালতলার চটি, এত উন্নতিতে তোর কিছুমাত্র উন্নতি হইল না...তালতলা-সম্ভূতা অপকৃষ্ট জুতা, বিদ্যাসাগর- পদাশ্রিতা! তোর কেন এ স্পর্ধা!!! দূরীভব!’
এখানেই তালতলার চটির অবমাননার কাহিনি ফুরোচ্ছে না। বর্ধমানের রাজা বিদ্যাসাগরের গুণমুগ্ধ। তিনি একবার বিদ্যাসাগরের সাক্ষাৎ চাইলেন। বিদ্যাসাগর দেখা করতে গিয়ে প্রবেশদ্বারে বাধা পেলেন। চটি পরে ভিতরে যাওয়া যাবে না। রক্ষী বিদ্যাসাগরের পরিচয় জানেন না। বিদ্যাসগর চটি রেখে খালি পায়ে প্রবেশ করলেন। রাজা সাদর সম্মানে বিদ্যাসাগরকে বরণ করলেন। এমনকী বিদায়ের সময় নিজে এলেন দরজার সামনে। রক্ষী নিজের অজ্ঞতা বুঝে হাতজোড় করে বিদ্যাসাগরের কাছে ক্ষমা চাইলেন। বললেন, আমি চিনতে পারিনি, ক্ষমা করুন। বিদ্যাসাগর বললেন, তোমার আর দোষ কী? তুমিতো মনিবের হুকুম তামিল করেছো মাত্র। কথাটা রাজার কানে পৌঁছতেই ওই রক্ষীকে বরখাস্ত করা হল। ওই দারোয়ান বিদ্যাসাগরের দ্বারস্থ হলে, বিদ্যাসাগরের চিঠিতেই তাঁকে পুনর্বহাল করেন বর্ধমানের রাজা।
আরও পড়ুন
‘ভুয়ো’ ডাক্তার বিদ্যাসাগর?
এই বর্ধমানের রাজাই একবার বিদ্যাসাগরকে একটা তালুক দিতে চেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর সে প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, আমার নিজের রোজগারে ভালোই চলে যাচ্ছে, আর তালুক সেদিনই নেব, যেদিন তালুকের সব প্রজাদের খাজনা আমি নিজে দিতে পারব।
তখন বাংলার ছোটলাট হ্যালিডে সাহেব। স্ত্রী-শিক্ষা নিয়ে তাঁর সঙ্গে প্রায়ই আলোচনা হত বিদ্যাসাগরের। আর তাঁর অনুরোধেই ধুতি চাদর ছেড়ে অনেকবারই পেন্টলুন পরতে হয়েছে তাঁকে। এইসব পোষাকে অপ্রস্তুত বিদ্যাসাগর একদিন হ্যালিডেকে জানালেন এই পোষাকে তাঁর পক্ষে আসা সম্ভব নয়। বিদ্যাসাগরের ইন্টেলেকচ্যুয়াল সঙ্গর মায়া ত্যাগ না করতে পেরে তিনি বললেন, তুমি তোমার নিজের পোষাকেই এসো পণ্ডিত।
সিস্টার নিবেদিতার লেখা থেকে জানতে পারি, এমন এক দিনের কথা, যে দিন লাটের দরবারে ডাক পরেছে বিদ্যাসাগরের। বিদ্যাসাগর দেখলেন, একজন মোগলাই পোষাক পরা মানুষের কাছে তাঁর চাকর উদগ্রীব ও আশঙ্কা নিয়ে বলছে, মহাশয় আপনার বাড়িতে আগুন লেগেছে, আপনি তাড়াতাড়ি চলুন। বারবার তাড়া দেওয়ায় তিনি বললেন, ‘ ঘরের কয়েকখানা বাঁশ- বাখারি পুড়ে যাচ্ছে বলে কি আমি বাপ-দাদার চাল-চলন ছেড়ে দিয়ে ছুটব?’
এই দৃশ্য দেখে নিজের তালতলার চটির সম্পর্কে আরও কনফিডেণ্ট হয়েছিলেন তিনি। নিজের দেশীয় চালচলন সম্পর্কে অনেক বেশি প্রত্যয়ী। সত্যেন দত্ত তাঁর তালতলার চটি নিয়ে পদ্য বাঁধলেন। বললেন,
‘সেই যে চটি- দেশী চটি –বুটের বাড়া ধন
খুঁজব তারে, আনব তারে, এই আমাদের পণ;
সোনার পিঁড়েয় রাখব তারে, থাকব প্রতীক্ষায়
আনন্দহীন বঙ্গভূমির বিপুল নন্দীগাঁয়’
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বিদ্যাসাগরের চটি-প্রীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘চটি জুতার প্রতি তাঁহার আত্যন্তিক আসক্তি ছিল বলিয়াই তিনি যে চটিজুতা ভিন্ন অন্য জুতা পায়ে দিতেন না, এমন নহে। আমরা যে স্বদেশের প্রাচীন চটি ত্যাগ করিয়া বুট ধরিয়াছি, ঠিক তাহা দেখিয়াই যেন বিদ্যাসাগরের চটির প্রতি অনুরাগ বাড়িয়া গিয়াছিল। বাস্তবিকই এই চটিজুতাকে উপলক্ষ মাত্র করিয়া একটা অভিমান, একটা দর্প তাঁহার অভ্যন্তর হইতে প্রকাশ পাইত’।
আরও পড়ুন
‘ভূষণহীন সারল্যই তাঁহার রাজভূষণ ছিল’- রবীন্দ্রনাথ
‘ডিয়ার বিদ্যাসাগর, এক বোতল শেরি আনিয়ে রেখ’
আর বিদ্যাসাগর কলোনিয়াল মানসিকতার বিরুদ্ধে একটা চরম স্টেটমেন্ট করেছিলেন। সেটা শিবনাথ শাস্ত্রীর কাছে। শিবনাথ লিখছেন,‘তিনি আমাকে একদিন বলিয়াছিলেন, ভারতবর্ষে এমন রাজা নাই, যাহার নাকে চটিজুতা শুদ্ধ পাখানা তুলিয়া টক করিয়া লাথি মারিতে না পারি’। শিবনাথ শাস্ত্রীর কথায়, আমাদের ভারতবর্ষে এমন রাজা নাই যাঁহার অপেক্ষা ঐ দরিদ্রের সন্তান বিদ্যাসাগর বড় লোক নহেন। যে স্বকর্তব্য সাধনে সাহসী সেই মানবকূলে রাজা। আমাদের বিদ্যাসাগর মহাশয় এই হিসেবে একজন বড় রাজা’।
ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বাধীনতার লড়াই সে যুগেই শুরু হয়েছিল। সেই শুরুর সময়ই বিদ্যাসাগরের আনুকূল্যে ‘তালতলার চটি’ স্বদেশীয় এক ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। সেই প্রতীক আমরাও উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করছি।
অলঙ্করণ- পার্থ দাশগুপ্ত