No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ঋতুপর্ণর ‘উনিশে এপ্রিল’-এর জন্যই শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্তরা সিনেমাহলমুখী হয়েছিলেন

    ঋতুপর্ণর ‘উনিশে এপ্রিল’-এর জন্যই শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্তরা সিনেমাহলমুখী হয়েছিলেন

    Story image

    তুপর্ণ ঘোষ (Rituparno Ghosh) আমার বহু দিনের বন্ধু। ওর সঙ্গে আমার যখন প্রথম আলাপ হয়, তখন আমি সবে বিএ পরীক্ষা দিয়েছি আর ঋতুপর্ণ কলেজের শেষ বছরে সম্ভবত।

    আমি ছিলাম লরেটো কলেজের (Loreto College) ছাত্রী আর ঋতুপর্ণ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে (Jadavpur University) পড়ে। দুজনের জগৎ ছিল আলাদা। দেখা হয় নাটকের রিহার্সালে। আমার নাটকের পরিচালক ছিলেন তমাল রায়চৌধুরী, যাঁর বাড়ির কাছাকাছি থাকতো ঋতুপর্ণ এবং সেই সুবাদে ও তমালদার গ্রুপে সাহায্য করতে আসে। সাহায্য মানে আমাকে দিয়ে ডায়ালগ মুখস্থ করানো। আমরা তখন গ্যেটের ফাউস্ট নাটকের বাংলা ভার্সন করছি ম্যাক্স মুলার ভবনের হয়ে। বঙ্গানুবাদ করেছেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। কাব্য নাটক, তাই ডায়ালগ মুখস্থ চায়। যেহেতু আমি লরেটো কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়েছিলাম তাই অনেকেরই ধারণা ছিল আমার বাংলা খুব কাঁচা হবে এবং আমার উচ্চারণও একটু বিদেশি ধরনের হবে; ঋতুকেও সেরকমই আভাস দেওয়া হয়েছিল বোধহয়। তাই প্রথমেই ও আমাকে উচ্চারণ নিয়ে জ্ঞান দিতে শুরু করে, আর এতে আমি বেশ মনক্ষুণ্ন হই। ও কে, যে উচ্চারণ শেখাবে আমাকে? আমি গোখলে মেমোরিয়ালে পড়েছি, ক্লাস সিক্স অবধি পুরোপুরি বাংলা মিডিয়ামে, আমার উচ্চারণ কী করে বিদেশি হয়? এ নিয়ে খুব জোর তর্কাতর্কির পর আমি যখন পড়তে থাকি লাইন, ঋতু স্বীকার করে নেয় ওর ধারণাটা ভুল ছিল। ঋতুপর্ণর একটা বড়ো গুণ ছিল ভুলটা মেনে নিতে পারার ক্ষমতা। অন্তত বন্ধুদের ক্ষেত্রে।

    সেই কলেজে পড়ার পর যে যার কেরিয়ার গড়তে বেরিয়ে পড়ি নিজ নিজ ক্ষেত্রে। আমি সাংবাদিকতা শুরু করি আর ঋতুপর্ণ বিজ্ঞাপনের জগতে ঢুকে পড়ে। প্রায় বছর দশেক পরে, ৯০-এর দশকের প্রথমে আবার ঋতুপর্ণর সঙ্গে দেখা। ততদিনে আমি ‘সানন্দা’ (Sananda) পত্রিকার সহকারি সম্পাদক আর ঋতুপর্ণ তার প্রথম ছবি ‘হীরের আংটি’ (Hirer Angti) তৈরি করে ফেলেছে। ছবি মুক্তি পাচ্ছে না, তাই মনে মনে গুমরে মরছে। কিন্তু কাজ বা চিন্তাভাবনা ওর থেমে নেই। প্রথম ছবি মুক্তি পাচ্ছে না বলে বসে থাকলে চলবে? ও ততদিনে ‘উনিশে এপ্রিল’-এর (Unishe April) চিত্রনাট্য তৈরি করে ফেলেছে এবং অপর্ণা সেনকে (Aparna Sen) সেটা শুনিয়ে এতটাই মুগ্ধ করে ফেলেছে যে রীনাদি অর্থাৎ অপর্ণা সেন ও তাঁর বান্ধবী রেনু রায় এই ছবিটি প্রযোজনা করবেন বলে ঠিক করেন। অপর্ণা সেন তো অভিনয়ে ছিলেনই, সঙ্গে দেবশ্রী রায় (Debashree Roy) আর দীপঙ্কর দে-কেও দুটি চরিত্রের জন্য নেয় ঋতুপর্ণ। দেবশ্রী তখন বাণিজ্যিক ছবির এক নম্বর নায়িকা। কিন্তু ঋতুপর্ণ জানতো ওর মধ্যে অভিনয়ের ক্ষমতা রয়েছে। ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’-এ (36 Chowringhee Lane) রীনাদি-ই ওকে নিয়েছিলেন।

    ততদিনে ‘উনিশে এপ্রিল’-এর চিত্রনাট্য তৈরি করে ফেলেছে এবং অপর্ণা সেনকে সেটা শুনিয়ে এতটাই মুগ্ধ করে ফেলেছে যে রীনাদি অর্থাৎ অপর্ণা সেন ও তাঁর বান্ধবী রেনু রায় এই ছবিটি প্রযোজনা করবেন বলে ঠিক করেন।

    ‘উনিশে এপ্রিল’ শুরু হয়। খুব বাঁধা বাজেটের ছবি। রেনুদি একটি পুরোনো বাড়ি জোগাড় করেন নিউ আলিপুরে। বিভিন্ন বন্ধুদের বাড়ি থেকে আসে প্রপ ও আসবাব। বাড়িটা যেন একেবারে রুচিশীল এক নৃত্যশিল্পীর বাড়ি বলে মনে হয়। সেট নিয়ে ঋতুপর্ণর যে মাতামাতি ছিল তা এই ছবিতে আমি চাক্ষুষ করি। বাড়িটার প্রতিটা ঘর কী দারুন সাজানো, যেন আমার স্বপ্নের বাড়ি, কোথাও সেই অর্থে ফিল্মি কিছু নেই, স্বাভাবিক বাড়ির অন্দর, কিন্তু রুচিশীল।

     

     

    ‘উনিশে এপ্রিল’-এর শুটিং যখন শুরু হয়, আমি তখন ‘সানন্দা’ পত্রিকায় কাজ করছি। তাই প্রায় একপাতার লে-আউট নিয়ে ঋতুর শুটে রীনাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। শুটিংটা ছিল একটা উৎসবের মতো। অভিনেতারা এবং কলাকুশলীরা সবাই কাজ করছে না আনন্দ করছে তা বোঝা দায়! ঋতুর মুড এরকমই হতো, অন্তত আমি যে সময় পর্যন্ত কাজ করেছি সেই সময় অবধি। একদিন শুটে গিয়ে দেখি প্রচণ্ড সমস্যা চলছে, ঋতুপর্ণ দেবশ্রী রায়কে বিশাল একটা চশমা দিয়েছে, যাতে আলো পড়ে গ্লেয়ার হচ্ছে, সবকিছুর প্রতিচ্ছবি পড়ছে, আর যেহেতু ছোটো ঘরেতে শুটিং হচ্ছে তাই আলো রাখার জায়গা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, চশমার কাচে বারবার আলো পড়ছে। কী হবে? হঠাৎ ঋতুই বললো একটা কাজ করা যাক, চশমার ফ্রেমটা থেকে কাচ দুটো খুলে নাও। তা কি হয় নাকি! সবাই বুঝতে পারলে কী বলবে? ঋতু দৃঢ় কণ্ঠেই বলে, না কেউ বুঝবে না, আমি বলছি। পরিচালক যখন বলেছে তাই করা হল। প্রায় পুরো ছবিতে দেবশ্রী অভিনয় করলেন কাচ ছাড়া চশমা পরে। পরবর্তী সময় যখন ছবিটা মুক্তি পায় তখন কেউ কোনোদিন চশমার কাচ নেই, এ কথা বলেননি। অল্প বয়সে জীবনের প্রথম থেকেই ঋতুপর্ণর মধ্যে যেটা ছিল, তা হল আত্মবিশ্বাস। ও কী করবে, কী শট নেবে, কোনটা রি-টেক হবে, কোনটা হবে না সেই ব্যাপারে ওর কোনো দ্বিমত বা দোনামনা ছিল না।

    ঋতুপর্ণ দেবশ্রী রায়কে বিশাল একটা চশমা দিয়েছে, যাতে আলো পড়ে গ্লেয়ার হচ্ছে, সবকিছুর প্রতিচ্ছবি পড়ছে, আর যেহেতু ছোটো ঘরেতে শুটিং হচ্ছে তাই আলো রাখার জায়গা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, চশমার কাচে বারবার আলো পড়ছে। কী হবে?

    ‘উনিশে এপ্রিল’ শেষ হল ১৯৯৪ সালে, সেন্সরও হল। ততদিনে আমি অডিও ভিস্যুয়াল জগতে কাজ শুরু করেছি। যদিও তখন অপর্ণা সেনের সঙ্গে কাজ করি। ঋতুপর্ণ একদিন বলল ও একটা ক্লোজড ডোর শো করছে NT1-এ বন্ধুদের জন্য, আমাকে দেখতে আসতে বলল। গেলাম দেখতে ‘উনিশে এপ্রিল’। আমার পাশে বসে ছিল আমারই স্কুলের বান্ধবী মমতা শংকর। ছবি শুরু হওয়ার পর আমরা কেমন ধীরে ধীরে রীনাদি ও দেবশ্রীর মধ্যেকার সম্পর্কে ডুবে যেতে থাকি। বহু বছর পর একটা বাংলা ছবি দেখে আমরা ছবির চরিত্রদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ি। ছবি শেষ হওয়ার পর মমতা আর আমি দুজনেই লজ্জা পেয়ে যাই, কারণ দুজনের চোখে তখন জল। বেরিয়ে এসে ঋতুপর্ণকে কিছু বলতেই পারিনি- এতটাই ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। অফিসে এসেই বসে পড়ি ছবিটা নিয়ে লিখতে। লিখে যাই আমারই এক বন্ধুর কাছে, যে তখন দৈনিক পত্রিকার ফিচার বিভাগ দেখাশোনা করছে। তাকে বলি এই ছবিটা নিয়ে লিখেছি, প্লিজ তোর পাতাতে একটু জায়গা দে। তখনও ঋতুপর্ণকে কেউ চেনে না। তাই আমাকে বলা হল অপর্ণা সেন আর দেবশ্রী রায়ের সাক্ষাৎকার আগে নিয়ে এসো এই ছবিটা নিয়ে, তারপর ছাপাবো। আমি করলামও তাই।

    তারপর রোজই শুনি পরের সপ্তাহে ছাপাবে, এ সপ্তাহে জায়গা নেই। এটা হয়, কারণ আমিও তো খবরের কাগজে কাজ করেছি, সেখানে জরুরি খবরের পাশে নতুন পরিচালকের ছবির খবর ততটা জরুরি নয়। কিন্তু, এর মধ্যেই যখন ‘উনিশে এপ্রিল’ জাতীয় পুরস্কার (National Awards) পেল, স্বর্ণকমল যখন ঋতুর ঘরে এল, আর দেবশ্রী রায় সেরা অভিনেত্রীর শিরোপা পেলেন, বাক্সের তলা থেকে আমার লেখাটাই বার করে ঝেড়ে মুছে প্রকাশিত হল। তখন ঋতুপর্ণ আর অনামী বন্ধু নয়, জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী পরিচালক। তবে ‘উনিশে এপ্রিল’-এর সাফল্য শুধু জাতীয় পুরস্কারেই সীমাবদ্ধ ছিল না, যখন ছবিটি হলে মুক্তি পায়, শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্ত যারা হল বিমুখ হয়েছিলেন, সকলেই ‘উনিশে এপ্রিল’ দেখতে ফিরে আসেন। মিনার-বিজলী-ছবিঘরের সামনে গাড়ির লাইন লেগে যায়। বাঙালি আবার এমন ছবি পায় যার মধ্যে গল্প আছে, কিছু বক্তব্য আছে, ইমোশন আছে, আর এক ধরনের স্বপ্নপূরণ আছে- যা আর পাঁচটা বাণিজ্যিক ছবির থেকে আলাদা। ঋতুপর্ণই খুলে দেয় সেই দরজা, যা আবার আমাদের মতো বহু পরিচালককে ছবি করার জন্য উজ্জীবিত করে।

    ____________

    কৃতজ্ঞতা প্রকাশ:
    লেখাটি ‘আঙ্গিক’ পত্রিকার ‘ঋতুপর্ণ ঘোষ সংখ্যা’ থেকে পুনর্মুদ্রিত হল। সংখ্যাটির প্রকাশকাল সেপ্টেম্বর, ২০১৪। পরিবর্ধিত সংস্করণ ২০১৬।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @