কালাজ্বর থেকে পঞ্চাশ লক্ষের বেশি মানুষকে বাঁচিয়েও নোবেল পাননি উপেন্দ্রনাথ

ছোটো ঘরটায় মুখ গুঁজে কাজ করেই চলেছেন একরোখা মানুষটি। এই মেধাবী বাঙালি চিকিৎসকটিকে সাহেবরাও পছন্দ করেন, শ্রদ্ধাও করেন। অংক, রসায়ন, ফিজিওলজি এবং আধুনিক ঔষধিবিদ্যা-- এই চারটি বিষয়েই তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। শুধু ডাক্তার বললেও তাই ভুল হবে তাঁকে, তিনি গবেষকও। কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলের ঐ ছোটো ঘরটাই তাঁর ল্যাবরেটরি। ঘরে গ্যাসবাতি নেই, জলের ট্যাপও নেই। গবেষণার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও অর্থেরও আকাল। তবু লড়ে যাচ্ছেন উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। তাঁর গবেষণা ভয়ঙ্কর কালাজ্বর নিয়ে। ম্যালেরিয়ার পর সবচাইতে ভয়ঙ্কর ও প্রাণঘাতী জ্বর এটাই। প্রতি বছর গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে এই জ্বরে। ম্যালেরিয়ার ওষুধ আবিষ্কার হলেও কালাজ্বরের ওষুধ এখনো অজানা। এই ভয়ঙ্কর অসুখ থেকে মুক্তির পথ বের না করে তাই থামার প্রশ্নই নেই।
গোটা বিশ্বেই কালাজ্বর তখন আতঙ্ক। অসংখ্য গবেষণার পরেও এই রোগকে জব্দ করতে পারেনি সাহেবরা। ভারতেও বেড়েই চলেছে কালাজ্বরের প্রাদুর্ভাব। ফলাফল লক্ষাধিক রোগের মৃত্যু। ব্রাজিল ও ইতালি থেকে খবর এল, পটাশিয়াম থেকে প্রস্তুত টারটার এমেটিক ব্যবহার করলে নাকি কালাজ্বর কমছে অনেকের। স্যার লিওনার্ড রজার্স কালাজ্বরে আক্রান্ত ১০ জন ভারতীয়র ওপরে সেই ওষুধ প্রয়োগ করলেন। উপকার হল না বিশেষ। উল্টে শুরু হল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। উপেন্দ্রনাথ গবেষণার শুরুতে পটাশিয়ামের বদলে সোডিয়াম ব্যবহার করলেন। সেই পথে সাফল্য এল না। তখন শুরু হল সোডিয়াম এন্টিমনি থেকে সোডিয়ামকে আলাদা করে ইউরিয়া আর এন্টিমনিকে মিলিয়ে ইউরিয়া স্টিবামিনের যৌগ তৈরির কাজ। অবশেষে, ১৯২১ সালের জুলাই মাসে ধোঁয়ায় ভর্তি ছোটো ল্যাবরেটোরিতেই তৈরি হল বহু আকাঙ্ক্ষিত ইউরিয়া স্টিবামাইন। কালাজ্বরের জীবনদায়ী ওষুধ। ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলের কালাজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের ওপর এই ওষুধের প্রয়োগ করেও ম্যাজিকের মতো ফল মিলল। উপেন্দ্রনাথ বুঝলেন লক্ষ-লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচানোর অস্ত্র তাঁর হাতে এসে গেছে।
আরো পড়ুন
পলিফ্লাওয়ার থেকে ‘ব্যানার্জিস পালং-- মানবজমিনেও সোনা ফলাতেন প্রফুল্লচন্দ্রের ছাত্র শিবপ্রসাদ
এই আবিষ্কারে হইচই পড়ে গেল দেশে-বিদেশেও। এর আগে অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় জুড়ে কালাজ্বর ছিল মৃত্যুর দূত। সুকুমার রায়ের মৃত্যুও কালাজ্বরেই। ইউরিয়া স্টিবামাইন হয়ে উঠল সেই রোগ থেকে মুক্তির অব্যর্থ দাওয়াই। দ্রুতই দেশের বড়ো বড়ো হাসপাতালে, চা বাগানে এই ওষুধ ব্যবহৃত হতে লাগল। কালাজ্বরে মৃত্যুর হার ৯০ শতাংশ থেকে নেমে এল ১০ শতাংশে। ১৯২৫-এ অসম সরকার নির্দেশ দিল, সমস্ত কালাজ্বর রোগীর চিকিৎসা যেন ইউরিয়া স্টিবামাইন দিয়েই করা হয়। অসমের গভর্নর জানিয়েছিলেন, এই ওষুধ তিন লক্ষের বেশি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। ১৯৩২ সালে আরোগ্য পাওয়া মানুষের সংখ্যাটা ৫০ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যে কালাজ্বরে মৃত্যুর হার নেমে আসে ৭ শতাংশে। ভারতের পাশাপাশি চিন, গ্রিস ও ফ্রান্সেও শুরু হয় এই ওষুধের ব্যবহার।
চাইলেই ইউরিয়া স্টিবামাইনের পেটেন্ট নিতে পারতেন উপেন্দ্রনাথ। বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার হাতছানিও ছিল। তা না করে উল্টে ভারতের প্রায় সমস্ত হাসপাতালকে বিনামূল্যে ইউরিয়া স্টিবামাইন বিলিয়েছেন উপেন্দ্রনাথ। পেটেন্ট তো নেনইনি, বরং দরিদ্র মানুষদের কথা ভেবে সরকারের কাছে ইউরিয়া স্টিবামাইন বিক্রি করেছেন এক পয়সাও লাভ না রেখে। যাতে ওষুধের দাম সকলের সাধ্যের মধ্যে থাকে। তাঁর গবেষণায় যশ, অর্থ বা খ্যাতির লোভ ছিল না। ছিল লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার জেদ। সেই আলো-জল না থাকা ছোটো ঘর, সেও তাঁর কাছে তাই তীর্থের সমান। উপেন্দ্রনাথ নিজেই লিখে গেছেন সে-কথা— "I recall with joy that memorable night in the Calcutta Campbell Hospital at Sealdah, where after a very hard day’s work I found at about 10 o’clock that the results of my experiments were up to my expectations… The room where I had to labour for months without a gas point or a water tap and where I had to remain contented with an old kerosene lamp for my work at night. To me it will ever remain a place of pilgrimage where the first light of Urea Stibamine dawned upon my mind.’’
শুধু প্রাণঘাতী কালাজ্বরের অসুখই নয়, উপেন্দ্রনাথই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন অতি দুর্লভ আর বিপজ্জনক অসুখ কুয়ারটারটান ফিভারের অস্তিত্বও। তিনিই প্রথম বলেন, এই জ্বর আসলে ম্যালেরিয়া আর কালাজ্বরের সমন্বয়। ব্ল্যাক ওয়াটার ফিভার উপশমের ওষুধও তাঁর আবিষ্কার। এছাড়া, ফাইলেরিয়া, ডায়াবেটিস, কুষ্ঠ, মেনিনজাইটিসের মতো অসুখ নিয়েও ১৫০টির বেশি গবেষণাপত্র রয়েছে তাঁর। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে সেইসব গবেষণা আদতে অমূল্য।
গোটা পৃথিবী জুড়ে পঞ্চাশ লক্ষের বেশি মানুষের প্রাণ বাঁচানো এই ডাক্তারের নোবেল পাওয়াটা কি নেহাতই অনুচিত ছিল? সাহেবরাই স্বীকার করে নিয়েছিল, ম্যালেরিয়ার পরে প্রোটোজোয়ান পরজীবী ঘটিত সবচাইতে বিপজ্জনক কালাজ্বরই। ম্যালেরিয়ার কারণ আবিষ্কার করে রোনাল্ড রস নোবেল পেলেন, কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কার করেও ব্রাত্য থেকে গেলেন উপেন্দ্রনাথ। শুধু কালাজ্বরের ওষুধই নয়, এর সঙ্গে যদি তাঁর অন্যান্য গবেষণাকেও জোড়া হয় তাহলে তো নোবেল পাওয়ার দাবি আরো উঁচু হয়। ১৯২৯-এ প্রথমবার নোবেলের জন্য মনোনয়ন পেলেন তিনি, নোবেল পাননি অবশ্য। পরে আবারও পেলেন মনোনয়ন। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে নোবেলের যোগ্য বলে মনে হয়নি নোবেল-কমিটির বিশেষজ্ঞদের। এতগুলো মানুষকে প্রাণঘাতী কালাজ্বর থেকে বাঁচানো, জীবনদায়ী ওষুধের পেটেন্ট না নেওয়া, অন্যান্য অসুখ নিয়ে মহামূল্যবান গবেষণা, চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমন অবদানের পরেও আর কী ফাঁক থাকতে পারে নোবেল-প্রাপ্তির খাতে? উত্তর নেই।
নোবেল না পেলেও সাহেবদের থেকে ‘নাইট’ উপাধি পেয়েছিলেন উপেন্দ্রনাথ। পেয়েছিলেন আরো অসংখ্য সম্মান। আর মানুষটা আজীবন চেষ্টা করে গেছেন দেশের চিকিৎসাকাঠামোকে আমূল বদলে দেওয়ার। কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে নিজের বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ব্রহ্মচারী রিসার্চ ইনস্টিটিউট’। দেশের প্রথম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় ব্লাড ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেছেন, কলকাতায় আপৎকালীন চিকিৎসা পরিষেবাকে বদলে দিয়েছেন প্রায় একার হাতে। মাথা উঁচু করেই বেঁচেছেন ভারতের এই ‘ধন্বন্তরী’ চিকিৎসক।
নোবেল না পাওয়ার গ্লানি তাঁর অস্তিত্বের উচ্চতাকে সামান্যও টলাতে পারেনি।