No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বিশ্বের দ্বিতীয় ব্ল্যাড ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি

    বিশ্বের দ্বিতীয় ব্ল্যাড ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি

    Story image

    বিশ্বের দ্বিতীয় ব্লাড ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠাতাকে আমরা একেবারেই অন্যভাবে চিনি,  উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। যিনি কালাজ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। কলকাতায় তার হাত ধরেই জরুরি চিকিৎসা সেবায় অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছিল।  শুধু তাই নয়, তৎকালীন ভারতীয় রেড ক্রস সোসাইটির প্রশাসনিক দপ্তরের প্রশাসক হিসেবে তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয়।

    ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুল। আজকের নীল রতন সরকার মেডিকেল কলেজ, সেখানকার একটি ছোট্ট কক্ষে নিজের গবেষণা শুরু করেছিলেন উপেন্দ্রনাথ।

    এক সময় আর্সেনিক, পারদ, কুইনাইন আর সোডিয়াম অ্যান্টিমনি টারটারেটের একটি মিশ্রণকে কালাজ্বরের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হত। কিন্তু তা কোনোভাবেই কালাজ্বর রোধে সম্পূর্ণ কার্যকরী ছিল না। 

    উপেন্দ্রনাথ গবেষণার সোডিয়াম এন্টিমনি থেকে সোডিয়ামকে পৃথক করে ইউরিয়া আর এন্টিমনির সংযোগে ইউরিয়া স্টিবামাইন এর যৌগ তৈরি করতে সক্ষম হলেন।

    রাত দশটা। গবেষণাগার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলের সেই ছোট্ট ঘরটির মধ্যে বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ  সেদিন যা আবিষ্কার করলেন তিনি জানতেন না যে তার সেই আবিষ্কার একদিন লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচাবে।

    গবেষণার ফলাফল দেখতে তিনি প্রথমে যৌগটিকে খরগোশের শরীরে প্রয়োগ করলেন। তিনি অবাক হয়ে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলেন, তাঁর গবেষণালব্ধ ইউরিয়া স্টিবামাইন যৌগটি কালাজ্বরের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ কার্যকর। সাড়া পড়ে গেল চারিদিকে। 

    উপেন্দ্রনাথের আবিষ্কারের কথা প্রথম প্রকাশিত হয় 'ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চে'। যেখানে আটজন কালাজ্বর রোগীকে সুস্থ করার বিবরণ প্রকাশিত হয়। উপেন্দ্রনাথ  তাঁর গবেষণাপত্রে ওষুধটি কতটা বিষাক্ত সে সম্পর্কেও আলোচনা করেন।

    পরে "ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেটে" ইউরিয়া স্টিবামাইন সম্পর্কে উপেন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ করে। এরপর উপেন্দ্রনাথ আরো কিছু তথ্য প্রকাশ করেন "ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেটে"। কালাজ্বর ছাড়াও উপেন্দ্রনাথ ফাইলেরিয়া, ডায়াবেটিস, কুষ্ঠ, মেনিনজাইটিস প্রভৃতি রোগ নিয়েও গবেষণা করেছিলেন। 

    চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং-এর পেনিসিলিন আবিষ্কারের অনেক আগেই এই বাংলার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী এন্টিমাইক্রোব্যাক্টেরিয়াল ড্রাগ হিসেবে ইউরিয়া স্টিবামাইনের আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে ছিল এক মাইলফলক।

    প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং পরে কলকাতা মেডিকেল কলেজর ছাত্র ছিলেন উপেন্দ্রনাথ। সেখান থেকে মেডিসিন ও সার্জারিতে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। পড়াশোনায় বরাবরের মেধাবী ছাত্র উপেন্দ্রনাথ 'গুডিভ' ও 'ম্যাকলাউড' পদক লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি এম.ডি ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। উপেন্দ্রনাথের গবেষণার মূল বিষয় ছিল 'লোহিত কণিকার ভাঙন'।

    দীর্ঘদিন গবেষণার কাজে নিযুক্ত থাকার পর, উপেন্দ্রনাথ সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। তিনি গবেষণা কার্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার কথা অনেকদিন ধরেই ভাবছিলেন। সেই ভাবানা থেকেই কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে নিজ বাসভবনে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্রহ্মচারী রিসার্চ ইনস্টিটিউট’। যেখানে বহু তরুণ বিজ্ঞানীর হাতেখড়ি হয়েছিল।

    ননী বালা দেবীর সাথে উপেন্দ্রনাথ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। উপেন্দ্রনাথ ছিলেন  দুই সন্তানের জনক। 

    চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্বন্ধে তাঁর রচনাবলীর মধ্যে 'ট্রিটিজ অন কালাজ্বর' বিখ্যাত। ইংল্যান্ডের র‌য়্যাল সোসাইটি অফ মেডিসিনের সভ্য ছিলেন তিনি। ইন্দোরে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি মনোনীত হন উপেন্দ্রনাথ। একাধিক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি।

    ডাঃ উপেন্দ্রনাথ 'রায়বাহাদুর' ও 'নাইট' উপাধি পান। কালাজ্বরের ওপর তাঁর কাজের জন্যে কলকাতা স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন এন্ড হাইজিন তাকে মিন্টো পদকে ভূষিত করে।এছাড়া 'এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল' তাঁকে 'স্যার উইলিয়াম জোন্স' পদকে সম্মানিত করে। এছাড়াও তিনি 'কাইজার-ই-হিন্দ' স্বর্ণপদকও লাভ করেন। 

    চিকিৎসাশাস্ত্রে যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য উপেন্দ্রনাথ নোবেল পদকের জন্যে মনোনয়ন পেয়েছিলেন কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর নাম বাদ পড়ে যায়, যার কারণ জানা যায় না। রয়াল সোসাইটি অব লন্ডন বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথকে বিশেষ সম্মান প্রদান করে। ভারতীয় বিজ্ঞান একাডেমি কর্তৃকও সম্মানিত হন উপেন্দ্রনাথ। 

    একাধিক সম্মান ও উপাধিপ্রাপক উপেন্দ্রনাথ ছিলেন একেবারে প্রচারবিমুখ এক ব্যক্তিত্ব। সিধাসাধা আত্মভোলা গোছের এই মানুষটি একজন পণ্ডিত গবেষকই ছিলেন না, ছিলেন একজন সচেতন নাগরিক। সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা সারাজীবন মনে রেখেছিলেন উপেন্দ্রনাথ। যে কারণে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র মারা গেলে সাহিত্য পরিষদের শোকসভায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, খগেন্দ্রনাথ মিত্রের পাশাপাশি  আমন্ত্রিত ছিলেন ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ছিলেন সেদিনের অনুষ্ঠানের সভাপতি। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, "মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র অদ্বিতীয় দানবীর ও দেশের সর্বববিধ হিতকর কার্য্যের একমাত্র উৎসাহদাতা ছিলেন।"

    ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ছিলেন বিভিন্ন বিষয়ের পথ প্রদর্শক। এই গুণী মানুষটি বাহাত্তর বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

    ঋণ :
    Dictionary of Medical Biography Vol. 1 A-B, Edited by W. F. Bynum and Helen Bynum, Greenwood Press 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @