ইংরেজদের উচ্চারণে ব্রহ্মপুর হয়ে গেল বহরমপুর

১৬০৮ থেকে ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীরের শাসনকালে উইলিয়াম ক্লিঞ্চ ভারতের উত্তর পূর্ব ভারতে পরিভ্রমণে এসে তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে প্রথম বহরমপুরের নাম উল্লেখ করেন। যদিও তখন এই শহরের নাম বহরমপুর ছিল না। এর নাম ছিল ব্রহ্মপুর। ১৭০৪ সালে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদের পত্তনের সময় বহরমপুর ছিল নয় কিলোমিটার দক্ষিণের একটি গ্রাম, যার নাম সাতপুকুরিয়া ব্রহ্মপুর। গ্রামে প্রায় সাতশো পরিবার ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তাই এই গ্রামের নাম হয়েছিল ব্রহ্মপুর। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করার পর ইংরেজ সরকার বহরমপুরে সেনানিবাস বানিয়ে এই শহরের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি ঘটান। ইংরেজদের দ্বারা উচ্চারিত ব্রহ্মপুর বর্তমানে বহরমপুরের মতো শোনানোর জন্য শহরের নাম হয় বহরমপুর। তারও প্রায় একশো বছর পর ১৮৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম আগুন জ্বলে ওঠে ব্যারাকস্কোয়ার ময়দানে। ইংরেজদের উচ্চারণে ব্রহ্মপুর হয়ে যায় বহরমপুর।
র্যা ডক্লিফের মানচিত্রে মুর্শিদাবাদ কিন্তু ভারতের ভাগে ছিল না। ১৯৪৭-এর ১৫ অগাস্ট ভাগ-বাঁটোয়ারায় মুর্শিদাবাদ পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে। আর অধুনা বাংলাদেশের খুলনা পড়ল এপারের ভাগে। ১৫ অগাস্ট সকালে বহরমপুরের ব্যারাকস্কোয়ার মাঠে উত্তোলিত হল পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা। পতাকা তুললেন মুর্শিদাবাদের তৎকালীন আইসিএস অফিসার আই আর খান। কিন্তু পরিস্থিতি যথেষ্ট অস্থির। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেওয়া হল মুর্শিদাবাদ থাকবে ভারতেই। খুলনা যাবে পাকিস্তানে। স্বাধীনতার তিনদিনের মধ্যে ফের বদলালো বাংলা-সহ দুই দেশের মানচিত্র। ১৮ অগাস্ট সরকারিভাবে মুর্শিদাবাদ অন্তর্ভুক্ত হল ভারতের মানচিত্রে। এই টানাপড়েনের মধ্যেই ১৮ অগাস্ট ব্যারাকস্কোয়ারের মাঠেই উড়ল ভারতের পতাকা।
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর ও পৌরসভা এলাকা। কলকাতা থেকে বহরমপুরের দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার। কলকাতা, আসানসোল, শিলিগুড়ি, বর্ধমান এবং ইংরেজবাজারের পর পশ্চিমবঙ্গের ষষ্ঠ বৃহত্তম শহর বহরমপুর। ২০১১ সালে, বহরমপুর একটি পৌর নিগমে পরিণত হওয়ার জন্য মনোনীত হয়।
বিগত আড়াইশো বছর ধরে বহরমপুর আমাদের উপহার দিয়েছে মহাশ্বেতা দেবী, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের মতো লেখককে। দিয়েছে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ইতিহাসবিদকে। কাঁসা শিল্প থেকে শোলা শিল্প, তাঁত শিল্প থেকে সিল্ক- বহরমপুর এসবের জন্য বিখ্যাত। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতেও সমানভাবে এগিয়ে প্রাচীন এই শহর। শহরে বিক্ষিপ্তভাবে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাসের পাঁজর। যেখান থেকে ধুলো উড়ে আসে। সমস্ত ঐতিহ্যের গায়ে জড়িয়ে আছে আড়াইশো বছরের মায়া। সাতপুকুরিয়া ব্রহ্মপুর কিংবা বহরমপুর, শহর এভাবেই হয়তো কথা বলে।