হিটলারের জাঙ্গিয়া

গোপালের গেঞ্জি ও জাঙ্গিয়া পরুন। এমন একটি ঝকঝকে বিজ্ঞাপনের তলায় কোন এক সহৃদয় ব্যক্তি পানের দোকান থেকে চুন এনে লিখেছিলেন – তাহলে গোপাল কী পরবে?
দণ্ডিরহাট ব্যবসায়ী সমিতির মাতবর গৌরহরি সাহা এই গল্প শুনে একসময় অনেক হাসাহাসি করেছে বাজারে তার বড়সড় কাপড়ের দোকান। সেইসঙ্গে নারী-পুরুষের শর্টসও বিক্রি হয়। গল্পটা আবার মনে পড়লেও আজকের কেসটা আলাদা। সে ঠিক করেছে আজকে ব্যবসায়ী সমিতি সভায় বিষয়টা তুলবে।
পুজোর আগে ব্যবসায়ী সমিতির সভাতে বরাবরই দুটো জিনিস প্রাধান্য পায় তার একটা ‘অরুণ উদয় স্পোর্টিং ক্লাব’ আর ‘আমরা সবাই’- এই দুই শুভ-নিশুম্ভকে কত করে চাঁদা দিতে হবে দ্বিতীয় বিষয়টি হল ভিড় নিয়ন্ত্রণ। বাঁশের রেলিং যদি ফুটপাত ছেড়ে অন্তত দুহাত দূরে না হয় তাহলে দোকান খোলা আর না খোলা একই কথা।
মিটিং যখন শেষ হওয়ার মুখে তখন গৌর জানালো হিটলারের জাঙ্গিয়া নিলামে উঠেছে। জাঙ্গিয়ার বাজারে তাঁর কোন প্রভাব পড়বে কি? গৌরহরির কথাবার্তা শুনলে সবসময় মনে হয় সে না-বুঝে কিছু বলছে। কিন্তু এতকাল উঠা বসা করে সকলেই জানে গৌর কখনও মনের কথা খুলে বলে না। স্যানিটারি দোকানের মালিক শ্রাবণ ঘোষ সবসময়ই খেপে থাকে। এবং তর্ক জোড়াই তাঁর স্বভাব। দোকানের বিক্রয়যোগ্য সামগ্রীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সবাই তাঁকে শ্রাবণধারা বলেই ডাকে। শ্রাবণ উচ্চগ্রামে গলা তুলে বললো- জাঙ্গিয়া, স্যানিটারি সামগ্রী হল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। মানুষ না খেয়েও এইসব কেনে। তুই দামড়ার মত কথা বলছিস কেন?
--গেঙ্গি জাঙ্গিয়া হল ফ্যাশানের জিনিস। তার সঙ্গে তোমার প্যান, ব্রাশ এই সবের কোনও তুলনা হয়?
--দু’দিন পেট খালি না হলেই বুঝবি কোন জিনিসের কদর কতখানি।
এই তর্ক যখন হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁচেছে তখন দেখা গেল গৌর ও শ্রাবণ ছাড়া কমিটির কোন সদস্য ঘরে নেই।
গৌরহরি বাড়ি ফেরার সময় রোজ স্ত্রী সুখলতার জন্য রাবড়ি কিনে আনে। কিন্তু আজ খালি হাতে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সুখলতা খেকিয়ে উঠল, পুজোর বিক্রিবাট্টার আগে আবার ব্যরাম বাঁধালে নাকি?
-আমি চিন্তায় আছি। হিটলারের জাঙ্গিয়া নিলামে উঠেছে।
-সে কোথায় থাকে? ওরকম অলুক্ষণে জিনিস আবার নিলামে ওঠে নাকী?
সেদিন সুখলতার প্রবল নাসিকা গর্জন উপেক্ষা করে গৌর মাঝরাত পর্যন্ত খেরোর খাতায় অর্নগল হিসাব-নিকাশ করে গেল।
গৌর হাঁটে হাড়ি ভাঙলো পরের দিন দুপুরবেলা। দণ্ডিরহাট বাজের তার মাতঙ্গিনী বস্ত্রালয়ের সামনে ঢাউস ফ্লেক্স ঝুলছে। তাতে ‘গ্রেট ডিক্টেটর’ সিনেমা থেকে চ্যাপলিনের ছবি’ পাশে লেখা এবার পুজোয় শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ হিটলারের জাঙ্গিয়া। ১৯৩৮ সালের মডেলে খাটি ডোরাকাটা লিনেনের তৈরি। উদ্বোধন করবেন চিত্রতারকা ফুলটুসি মিত্র। পুরুষের অন্তর্বাস উদ্বোধন একজন রূপসীর হাতে। তামাসা দেখতে সেদিন সন্ধ্যে বেলায় মাতঙ্গিনী বস্ত্রালয়ের সমনে লোকে লোকারণ্য। গৌরহরি বুঝলো এবার পুজোয় জাঙ্গিয়া হিট করবে। সমাবেশে মহিলার সংখ্যাই বেশি। তাতেই গৌরহরি খুশি কারণ শপিং বাজেট তো তাদেরই হাতে। জাঙ্গিয়াটির দুই প্রান্ত দুই দুই চার আঙ্গুলে ধরে ফুলটুসি তিনবার চোখ মারলেন। কারণ কনট্রাকটে তেমনই শর্ত ছিল।
আজকাল বারোয়ারি পুজো কলেরার মত মহামারির চেহারা নিয়েছে। সেইকারণে পাবলিক টয়লেটের জন্য স্যানিটারি বানিজ্যেরও প্রসার ঘটেছে। ফলে শ্রাবণ ঘোষের দোকানেও যথেষ্ট ভিড়। কিন্তু গৌর হিটলার জাঙ্গিয়া দিয়ে বাজারে মাত করে ফেলেছে। মিটিং-এর দিন শ্রাবণের সঙ্গে গৌরের হাতাহাতি না হওয়ায় শ্রাবণ কিছুটা ক্ষুদ্ধ। গৌরের বউ সুখলতা তার পাড়ার মেয়ে। কিন্তু সুখলতার এক বিধবা পিসি তার পাহারায় থাকায় শ্রাবণ সেই ডিফেন্স কোন দিন ভাঙতে পারেনি। গায়ের ঝাল মেটানোর জন্য পুজোর হিরিকের মধ্যেই সে লতাকে ফোন করে বললঃ তোর সোয়ামি তো ফুলটুসির সঙ্গে নাচছে।
-চিন্তা করো না দাদা। আজ ওরই একদিন কি আমারই।
বাড়ি ফিরে দরজা খুলতেই গৌর স্তম্ভিত। সামনে বটিহাতে মহিলা। তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে না আছে সুখ না আছে লতা। অথচ গৌরের হাতে এক কেজি রাবড়ি।
পরের দিন হিটলারের জাঙ্গিয়ার বিক্রি দেখে কে? কিন্তু খটকা লাগলো দ্বিতীয় দিন বেশ কিছু ক্রেতা জাঙ্গিয়া ফিরত দিতে এসে অভিযোগ করল যে এই গুলো সঠিক হিটলারের জাঙ্গিয়া হয়নি।
-জাঙ্গিয়া তো জাঙ্গিয়ার মতই হবে।
বিক্ষুব্ধ ক্রেতারা পালটা বলে চলেছে হিটলারের জাঙ্গিয়ার অন্য বৈশিষ্ট আছে। আমরা সেই আশা নিয়েই কিনতে এসেছিলাম।
গৌরহরি পুজোর ভিড়ের মধ্যে এই নতুন উৎপাতে যখেষ্ট উদবিগ্ন। বিক্ষুব্ধরা বলে চলেছে। এই জাঙ্গিয়া তো বাজারেই পাওয়া যায়। সেটা কিনে একটা দিক সেলাই করে আমাদের পড়তে হয়। আর কতদিন আমরা এমন তাপ্পি দেওয়া জাঙ্গিয়া পড়ব। গৌর যেন ক্রমশ গভীর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। বিক্ষুব্ধ ক্রেতাদের কাছে আরও ব্যাখ্যা চাইতে তার কেমন যেন লজ্জাবতী লতার মত গুটিয়ে যাচ্ছে। গৌরের মনে রহস্য আরও ঘনীভুত হল। একজন ক্রেতা জানালো, আপনার দোকানে তো মহিলাদের হাট বসেছে এখানে সব কথা খুলে বলা যায় না।
গৌর তিনজন কে নিয়ে অ্যান্টি চেম্বারে বসল। তারা প্রথমেই জানতে চাইল গৌর হিটলারে জীবনী পড়েছে কিনা? তাঁর শরীর বৃত্তান্ত জানে কিনা? গৌর তখন ঘোর বিপদের আশঙ্কায় রয়ালটির মামলায় ফেঁসে যাওয়ার কথা ভাবছে।
ইতিহাসের মাস্টারের মত একজন ভারি গলায় জানালো, জন্ম থেকেই হিটলার একশিরা। তার জাঙ্গিয়া বিশেষ দর্জি দিয়ে বানানো হত। আমরা জাঙ্গিয়ার টাকা ফিরত চাই।
পাশ থেকে আরেকজন জানালো, সারা ভারত একশিরা সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখা বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে জালি জাঙ্গিয়া হইতে সাবধান।
ঘুঘু ব্যবসায়ি গৌরহরি সাহা পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে তৈরি হল, আপনাদের শরীরেও কি হিটলার মত সমস্যা?
-সেই জন্যই তো অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম। এখন আমরা টাকা ফিরত চাই।
-কিন্তু তার আগে আপনাদের মেডিক্যাল রিপোর্ট দিতে হবে।
-তা দেব।
-আপনাদের জাঙ্গিয়ার একটা দিক কি আপনাদের বউরাই এতকাল সেলাই করত?
-কি বলছেন। একেইই অঙ্গহানির জন্য বাপান্তর করছে। তারপর আবার জাঙ্গিয়া সেলাই?
-তার মানে এই দোষ না জানিয়েই বড়শিতে মাছ তুলেছেন?
-কিন্তু আর সব কিছুই তো ঠিক আছে।
-বউকে তথ্য গোপন করেছে। নারী স্বাধীনতার ফেরে পড়বেন।
-তাহলে উপায়?
-পাড়ার দর্জি দিয়ে একধার সেলাই করে নিন। তাহলে পরজন্মে দুটোই পাবেন।
এমন সময় সামনের ফ্লেক্স থেকে চার্লি চ্যাপলিন চেঁচিয়ে উঠলেন, এবার পুজোয় সেরা আকর্ষণ হিটলারের জাঙ্গিয়া, খাটি লিনেনের তৈরি। ডোরাকাটা।