No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    চাঁদের হাটে ভবতোষ সুতারের জীবন, দর্শন ও নিয়ম ভাঙার ‘উদযাপন’

    চাঁদের হাটে ভবতোষ সুতারের জীবন, দর্শন ও নিয়ম ভাঙার ‘উদযাপন’

    Story image

    মাদের তথাকথিত শিল্প (Art) বা চিত্র/ভাস্কর্য শিক্ষায় একটা মডেল বা আদর্শ চিরকাল পিছু নিয়েছে, বা বলা যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার কারণও ছিল, কোনও বিকল্প ছিল না। যার শুরুয়াত উনিশ শতকের মধ্যভাগে। ব্রিটিশ রাজত্ব। ভারত দখল করেছে। স্থানীয় রাজা-সম্রাটদের নিজস্ব কলহের সুযোগ নিয়ে তারা দেশ দখল ও লুটপাট চালায়। দীর্ঘ সময় সেই লুট চলে। আর্থিক লুট। তার সঙ্গে সাংস্কৃতিক লুটও চলে। অর্থাৎ আমাদের যা কিছু দেশজ, এ দেশের জল-আবহাওয়ায় জন্ম নেওয়া ভাবনা, দর্শন, অভ্যাস ও প্রয়োগ তার বিরুদ্ধে, তাকে বাতিল করে একটা ভিনদেশি দেখা, অভ্যাস ও প্রয়োগ, তাকে জনপ্রিয় করা, চালু করা। মূল মাধ্যম শিল্প-বিদ্যালয় (Art School)। বিস্তারে যাব না। কিন্তু এর রেশ আজও কাটেনি। কী সেই আদর্শ, কেমন হবে শিল্পীর অভ্যাস ও জীবনযাপন? শিল্পী হয়ে ওঠার জন্য তার প্রয়োজনীয় রসদ? তারপর তার জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। ইউরোপ থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ও ভিন্ন এদেশের প্রদর্শনী, নিলামঘর, সংগ্রহ, এই তিন যাদুস্পর্শ। এবার প্রশ্ন হচ্ছে এই মডেল-এর নিজস্ব গতিপথ, তার থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। আমরা সবাই, শিল্পীরা তার দ্বারা আক্রান্ত বা ‘ভিকটিম’ হয়ে গেলাম। বেরুবার রাস্তা নেই!

    কলকাতার এক প্রান্তে চাঁদের হাট (Chander haat) নামক এক শিল্পী-আস্তানার অন্যতম প্রধান শিল্পী ভবতোষ সুতার (Bhabatosh Sutar), তার ঘনিষ্ঠ,  শিক্ষক, তরুণদের প্ররোচনায়, উস্কানিতে এক অপূর্ব ও ছক-ভাঙা প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল মাত্র দশদিনের জন্য, মার্চ ২৭ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত। যে সমস্ত প্রদর্শন কক্ষ এ শহরে তৈরি করা আছে বা হচ্ছে, সেসব ওই মডেলের শেষ ফলশ্রুতি, অর্থাৎ যাকে বলা যায় ইউরোপীয় ঘরানার প্রদর্শন কক্ষ, তার ধরন, রং, আলো সবই তাকে মান্যতা দিয়ে। কোনও অপরাধ নেই তাতে। যে শিক্ষা যেভাবে শুরু হলো তার পরিণতিও সেই শিক্ষার ফল হিসেবেই আমরা আশা করবো, এতে কোনও ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু আমার ভাবনার উৎস, সূত্র যদি ভিন্ন হয়, নিজেকে প্রকাশ করতে চায়, তখনই সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমরা যেহেতু একটা বিশেষ ঘরানার প্রত্যক্ষ ফল, তাই বিষয়টা স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু আমি যদি আমার পারিপার্শ্ব-কে মান্যতা দিয়ে অন্য স্বরে কথা বলতে চাই, তখনই তা আর আগের মতো স্বাভাবিক থাকে না। তার মধ্যে আপাত অ-স্বাভাবিকতা প্রকাশ পেতে থাকে।

    এটা মডেল বা ছক ভেঙে, নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানো। চৌষট্টিটা প্রতিকৃতি, এই প্রদর্শনীর অন্যতম সম্পদ। পোড়া মাটিতে প্রমাণ মাপের এই যে প্রতিকৃতি, এরা কারা?

    ভবতোষ সুতার, যার সাধারণ পরিচয় একটা বিশেষ উৎসবকে রূপ দেওয়ার এবং তাকে বিশিষ্ট করে তোলার জন্য, সোজা কথায় মাঠে-ঘাটের শিল্প, পুজোর আধার বা প্যান্ডেল বানানো। সে পরিচিতির পাশাপাশি, পারিপার্শ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা, জনমানসের একজন হয়ে ওঠা, জনপ্রিয় ও একই সঙ্গে শৈল্পিক হওয়া বেশ কঠিন প্রস্তাব। ভব তার এই ‘উদযাপন’ একক প্রদর্শনীতে সেই চেষ্টাই করেছে। এটা আত্মজৈবনিক। নিজের ব্যক্তিগত-কে ব্যক্তিগত না ভেবে, সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দেওয়া দ্বিধাহীন ভাবে, দীর্ঘ সেই যাত্রা, সংক্ষেপে কিছু পরিচয় ঘটাবো।

    এটা মডেল বা ছক ভেঙে, নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানো। চৌষট্টিটা প্রতিকৃতি, এই প্রদর্শনীর অন্যতম সম্পদ। পোড়া মাটিতে প্রমাণ মাপের এই যে প্রতিকৃতি, এরা কারা? এরা ভব-র জীবনের অঙ্গ। স্ত্রী মল্লিকা যেমন আছে তেমনই শিক্ষক তরুণ দে-ও আছে, ওর প্রতিবেশীরা আছে, বন্ধুরা আছে, সহকারীরা আছে। তালিকা দীর্ঘ। কেন পোড়া মাটি? প্রথমে কাঁচা মাটির মূর্তি বানিয়ে তারপর তার থেকে ছাঁচ তুলে বিশেষ পোড়ামাটির মাটি দিয়ে সম্পূর্ণ ফাঁপা একটি প্রতিকৃতি বানানো হলো, পোড়ানো হলো, এর মধ্যে গোপনে রেখে দেওয়া হলো তার টেপবন্দী কণ্ঠস্বর প্রযুক্তির সাহায্যে, একটু কান পাতলেই তা শোনা যায়। চারপাশে কেমন একটা গুনগুন শোনা যেতে লাগলো। অপূর্ব সেই স্বর। সেই দেখা, লাল পোড়া মাটির মূর্তিগুলো যেন এক একজন অভিনেতা, নিজের জীবন অভিনয় করে চলেছে।

    ভব নিজেকে, নিজের ব্যক্তি পরিচয়কে বারবার ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছে। এগুলো বিতর্কিত প্রয়াস। একটা জায়গায় দেখা গেল দুটো আত্মপ্রতিকৃতি পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। ফলে, একটি পোড়ামাটির আত্মপ্রকৃতি ভেঙে গড়িয়ে পড়ে, মেঝেতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। পরে দেখা যাচ্ছে ওই ভগ্নাংশগুলো জোড়া না লাগিয়ে, বিভিন্ন আকারের খোপে খোপে সযত্নে রাখা আছে। সেখানে ভব নেই, কিন্তু আবার আছে। অর্থাৎ, আমাদের শরীরের সমস্ত ভগ্নাংশই একটি পূর্ণ মূর্তি। যে নিজস্ব ব্যক্তিত্বকে ভেঙে ফেলতে চাইছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভগ্নাংশও থেকে যাচ্ছে পূর্ণ হিসেবে। আমার স্ত্রী অনীতা, সেও শিল্পী। এই ভাঙা টুকরো অংশগুলো দেখে মোহিত হয়ে যায়। তার কথায়, সমস্ত কাজের মধ্যে একটা প্রতিবাদী স্বর পাওয়া যাচ্ছে। যেভাবে বহমানতা অর্থাৎ ‘কাইনেটিক’, প্রযুক্তি ও যন্ত্রের সাহায্যে ভব প্রয়োগ করেছে। একটা অন্ধকার ঘরে, বিশাল শুকনো ডালের মুকুট, মুখোশ, যেন জীবনকে সামনা-সামনি দেখা, সামলানো, প্রতিবাদী হয়ে ওঠা, বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা। ও নানা জায়গায় নিয়ম ভেঙেছে। কোথাও দেওয়ালে মনের কথা লিখে রেখেছে ভুলে যাওয়ার বিপরীতে। একটা ছাদ বানিয়েছে, যা ক্রমাগত নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছিলো।  শৈশব, কৈশোর, যৌবন নানা ভাবে ফিরে ফিরে এসেছে কোথাও ভাতের থালায়, কোথাও ব্যক্তিগত ট্রাঙ্কের ঢাকনায়, কোথাও লোহার ঠেলাগাড়িতে, কোথাও হকারের মতো কাঁধে আলমারি বয়ে নিয়ে যাওয়ার স্মৃতিতে। সন্ধের আলো-আঁধারিতে এই প্রদর্শনী, একটা ভিন্ন জগতে আমাদের নিয়ে যায়।  

     

    আরও একটা ছক ভাঙা কাণ্ড ভব ঘটায়, আপাত ভাবে তার প্রয়োজন হয়তো ছিল না। কারণ আমরা স্বভাব দোষে পারিপার্শ্বকে বিরক্ত করতে চাই না। কোথাও কোনও ঢেউ তুলতে চাই না, জলটা শান্ত আছে, মনে হয় তেমনই থাক, ভব সেই বিদ্যালয়ে পাঠ নেয়নি।

    ও একটা সমান্তরাল রেখার জন্ম দেয়, যে রেখা আড়াআড়িভাবে বাড়ি, রাস্তা, লোহার দরজা, গাছপালা, প্রতিবেশীর বাড়ির দেওয়াল সবই ভেদ করে যাবে। যেন পারিপার্শ্বের সঙ্গে মনের পাশে, দৈহিক, শারীরিকভাবে ঢুকে পড়া ফোকর দিয়ে চলে গেল সেই মূর্তির মিছিল, তারা তখন আর স্থির মূর্তি রইলো না। চলমান হলো। কোনও বাধাই তাদের সামনে বাধা রইলো না, দেওয়াল ভেদ করে চলে গেল। এই কাজটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, উল্লেখযোগ্য এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আশ্চর্য এক কাণ্ড। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

    বহু কাজ না-বলা থেকে গেল, কিছু না বলাও থাক। বলা, না-বলার মধ্য দিয়ে জীবন বয়ে চলে। ভবর জীবনও বয়ে চলবে। ও আমার প্রেরণা হয়ে থেকে যাবে। কয়েকটা সন্ধে কাটালাম ভব, তরুণ, মল্লিকার স্বান্যিধ্যে। শুভেচ্ছা অফুরন্ত। 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @