মেদিনীপুরের ভাদু টুসু

টুসু উৎসব
টুসু একটি জনপ্রিয় উৎসব। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির রাত্রি থেকেই টুসু পরবের আরম্ভ। সারা পৌষমাস ধরে উৎসব চলে। পৌষ সংক্রান্তির দিন এই উৎসব শেষ হয়। মূলত কুর্মী, ভূমিজ, বইগা বা বাগাল সম্প্রদায়ের উৎসব এটি তবে, কোথাও কোথাও সাঁওতাল জনগোষ্ঠীও এই উৎসব পালন করে। টুসু মেয়েদের একান্ত নৃত্যগীতমূলক উৎসব। ছোট ছোট মূর্তি গড়েন কুমোরেরা। টুসু দেবীর গায়ের রং হলদে, মাথায় রাংতার মুকুট, দু’হাতে দুটি পদ্মফুল, এবং শরীরে নানাবিধ অলংকার থাকে। বিবাহযোগ্য মেয়েরাই এই পূজাতে বেশি উদ্যোগী হয়। পূজা হয় সন্ধ্যাবেলায়। নিজস্ব বাড়িতে এবং কেন্দ্রীয়ভাবে পল্লীতেও বারোয়ারি টুসু পূজা হয়। সন্ধ্যার পর মেয়েরা নিজ নিজ বাড়ির মূর্তি নিয়ে প্রশস্ত বারোয়ারি তলায় সমবেত হয়। নৈবেদ্য হিসাবে বড় কাঁসার থাকায় চিঁড়ে, গুড়, ফলমূল রাখা হয়। প্রদীপ জ্বালিয়ে মেয়েরা সমবেত নৃত্যগীতে অংশগ্রহণ করে। সারা পল্লীঅঞ্চল মুখরিত হয়ে ওঠে গানের সুরে। ভক্তি বা শ্রদ্ধার চাইতে মমত্ব ও ভালোবাসাই যেন টুসুদেবীর প্রতি অধিক। টুসু যেন ঘরেরই মেয়ে। কোথাও আবার টুসুতে টুসুতে বিবাহও হয়ে থাকে। পৌষ সংক্রান্তির দিন ভোরে মেয়েরা মাথায় করে দলে দলে গান করতে করতে টুসুকে নিয়ে যায় নদী কিংবা ঝিলে ভাসাতে। এই উপলক্ষে নদীতীরে মেলাও বসে।
লক্ষণীয় যে, দিনের বেলাতে টুসুর পূজা হয় না। এর কারণ, দিনের বেলায় রুজিরোজগারের ব্যবস্থাটা বজায় রাখতেই হয়। অ-আদিবাসী সমাজের মতো সারাদিন ছুটি নিয়ে উৎসবে মাতার ক্ষমতা তাদের নেই। তাছাড়া, আদিবাসী সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। সমাজে মেয়েদেরই বেশি পরিশ্রম করতে হত, বলতে গেলে, সংসারের ভরণপোষণের দায়টা মূলত তাদেরই, আবার যেহেতু পূজাটাও সেই মেয়েদেরই, তাই দিনের বেলায় পূজা করার সময় নেই।
টুসু গানগুলি অনেকটাই পূর্বসূরীদের তৈরি করে যাওয়া হলেও স্বাধীন গান রচনায় এবং পরিবেশনে কোনও বাধা নেই – আশা, আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ, বেদনা, কামনা, বাসনা এই গানের মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে।

ভাদু উৎসব
বাঁকুড়া সীমান্ত ছোঁয়া মেদিনীপুরের অঞ্চলগুলিতে ভাদু জনপ্রিয় উৎসব, টুসুর মতোই। ভাদ্র সংক্রান্তিতে ভাদুর উৎসব। ভাদু কোনও শাস্ত্রীয় দেবী নন, একান্তভাবেই তিনি যেন মানবকন্যা, আমাদের ঘরের মেয়ে। ভাদু কিন্তু অরণ্য আশ্রিত আদিবাসী, যেমন সাঁওতাল, মুণ্ডা, ভূমিজদের উৎসব নয়। এ উৎসব হল হিন্দু সমাজভুক্ত তথাকথিত অন্ত্যজ উপজাতিদের। সাধারণভাবে বাগদী, বইগা, বাউরিদের। এই উৎসব হরষে-বিষাদ মাখানো। এর গানে গানে পাওয়া যায় শ্রমজীবীদের প্রতি দীর্ঘ শোষণ, লাঞ্ছনা, ক্লেশকর জীবনযাত্রার বারমাস্যা, আবার প্রেম-ভালোবাসা-আশা আর ঘর বাঁধার স্বপ্নেও এর সুর রণিত হয়। ভাদু উৎসবে কুমারীদের প্রাধান্য বেশি। নিজের নিজের ভাদু মূর্তি নিয়ে তারা গ্রামের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সমবেত হয়। সেরকম একটি নির্দিষ্ট স্থানই তো নামকরণে আজকের ভাদুতলা! ভাদু একান্ত নৃত্যগীতের উৎসব, এবং একমাস ধরে চলে এই আচার। ভাদ্রমাসের প্রথম দিনে শুরু হয়ে সংক্রান্তিতে তার শেষ হয়। কোনও কোনও লোকবিজ্ঞানীর মতে ভাদু আসলে আদিতে মদনোৎসব ছিল, যাতে নর-নারীরা অবাধ মেলামেশা করত। কুমারীদের প্রাধান্য দেখলে অবশ্য তাই মনে হয়। শেষের দিন কাঁদতে কাঁদতে ভাদু বিসর্জন দেওয়া হয়, কোথাও আবার ভাদুকে নিয়ে শবযাত্রা বের হয়। আসলে, ভাদুর উৎসবকে হরষে-বিষাদ মাখানো বলেছি এই কারণে যে, ‘ভাদু কথা’-তে বলা হয়, ভাদু এক উচ্চবর্ণের অত্যাচারী রাজার কন্যা ছিল। সেই রাজা নিম্নবর্ণের মানুষের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাত। একজন সাধারণ যুবককে ভালোবাসতে গিয়ে সে বাধা পায় তার পিতার কাছে। এর মধ্যে দিয়ে সে নিম্নবর্ণের মানুষের প্রতি রাজার অত্যাচারের স্বরূপ বুঝতে পারে, এবং তাদের সমব্যথী হয়ে পড়ে। রাজা কন্যার আচরণে বিরক্ত হয়। পিতাকে অত্যাচারে নিবৃত্ত করতে না পেরে, এবং প্রেমিকের সঙ্গে মিলন না হওয়ায় ভাদু আত্মহত্যা করে। এই হল কাহিনীর সারসংক্ষেপ। ভাদুকে কেন্দ্র করে এরকম অনেক উপকথা থাকলেও সব জায়গাতেই ভাদু শেষ অবধি মৃত। তাই ভাদুর উৎসব যেন আকাঙ্ক্ষিত প্রেমিক-প্রেমিকার অধিকার প্রতিষ্ঠার উৎসব।
তবে ভাদুর গানে কুমারীর যন্ত্রণা, শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা, সামাজিক কু-আচার ইত্যাদিও ফুটে ওঠে। সেই অর্থে ভাদু আসলে একটি প্রতীক উৎসবে পরিণত, এবং সেই প্রতীকটি হল সামাজিক-অবিচার বিরোধিতার।
(পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অধীনে ‘লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র’ থেকে প্রকাশিত ‘মেদিনীপুর’ গ্রন্থের অন্তর্গত নরেশ জানা’র ‘লোকউৎসব ও মেলা’ প্রবন্ধের নির্বাচিত অংশ)