পরশুরামের হাতে তিনি উকিল, সত্যজিৎ বানালেন সওদাগরি অফিসের কেরানি

শীতের দুপুর থেকেই বৃষ্টি। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কার্জন পার্কের উত্তর পশ্চিম কোণে আশ্রয়স্থলে দাঁড়িয়ে আছি। একটিমাত্র মানুষ সেখানে বসে ছাতার বাটের উপর দু’হাত রেখে তার উপর থুতনি ঠেকিয়ে। মুখে প্রসন্ন মৃদু হাসি। মুখটি বেশ চেনা চেনা ঠেকলো। সাহস করে জিজ্ঞাসা করলাম - চিনতে পারছেন?
- কে? কী চাই?
- আপনি পরেশ দত্ত না?
- বাপ তো তেমন নামই রেখেছিলেন।
- তা এখানে কী মনে করে? আবার কী পরশ পাথর খুঁজছেন?
প্রশ্নটা শুনেই পরেশবাবু তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন। বেশ স্মার্টলি বললেন - পাথরের যুগ শেষ ভায়া। এখন হাওয়ার পরশ চলছে।
পরেশবাবু ছাতা খুলে সটান হাঁটতে শুরু করলেন।
আনন্দধারা
৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল হওয়ার পর পরেশচন্দ্র দত্ত ওরফে তুলসী চক্রবর্তী বেজায় খুশি। কুড়িয়ে পাওয়া নুড়ি পাথর নিয়ে সোনার হরিণের পিছনে ছুটতে গিয়ে তিনি সেবার যথেষ্ট নাকাল হয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি কলকাতা ছেড়ে লিলুয়ায় নির্বাসন নেন। স্ত্রী গিরিবালা ওরফে রানিবালাকে সঙ্গে নিয়ে।
পরেশবাবুর দুটি পরিচয়। পরশুরামের হাতে তিনি উকিল। সত্যজিৎ রায় তাঁকে বানালেন সওদাগরি অফিসের কনিষ্ঠ কেরানি। সোনা কেলেঙ্কারির পর পরেশবাবু আদি পরিচয়টি বেছে নেন। প্রবীণ নাগরিক হিসেবে ৮% সুদে কিছু ফিক্সড ডিপোজিট আর হাওড়া কোর্টে ফৌজদারি আসামিদের জামিনের পিটিশন লিখে মিঞা-বিবি’র সংসার চলে যায়।
নোট বাতিল হওয়ার পর পরেশবাবু অনেকটা চনমনে হয়েছেন। ঘরে গিরিবালার গলায় কন্ঠি, কপালে তিলক। তিনিও যথেষ্ট পুলকিত। সারাদিন গুনগুনিয়ে গান করেন - ‘এই দেহেতে মদন রাজা করে কাছারি- সে যে দুষ্টু ভারি।’ মদন বলতে কবি এখানে কাকে বোঝাচ্ছেন তা নিয়ে পরেশবাবু একটি ধন্দে পড়লেন। লিলুয়া থেকে হাওড়া একটা মাত্র স্টেশন। দীর্ঘকাল পান চিবতে চিবতে যাতায়াত করেছেন। কিন্তু এখন কামরায় তিষ্টনো দায়। সকলেরই যেন বাপ মরেছে। সেই পরশ পাথরের যুগে গানি মার্কেটের পাগলাগুলোর মত। মোবাইল কানে নিয়ে যেন পর-পারের চোদ্দপুরুষের সঙ্গে কথা কইছে। নোট বাতিলের তে-রাত্রি না পোহাতে আদালতে এসে শুনলেন অম্বিকা মোক্তার গতকাল রাত তিনটেয় এটিএম লাইনে মুখে গাঁজলা তুলে সকলের মায়া কাটিয়েছে। পরেশচন্দ্র অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। সকলেই স্তম্ভিত। তিনি হাসতে হাসতে বললেন - তেহাত্তর বছর বয়সেও অম্বিকা বালক রয়ে গেল।
ভাগ্যলক্ষ্মী ব্যাঙ্ক
মাস পয়লা বাড়ির কাজের লোক হরিয়া ওরফে জহর রায়কে নিয়ে পরেশবাবু ব্যাঙ্কে যান রাহা খরচ তুলতে। তিনি ব্যাঙ্কে ঢুকে গেলে হরিয়া বাইরে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফোকে। ব্যালেন্স চেক করার জন্য অটোমেটিক মেশিনে পাশবই ঢুকিয়ে দেখলেন ব্যাঙ্ক তো নয় যেন মেছো বাজার। পাশবই বেরতেই পরেশবাবুর চক্ষু স্থির। তার নামে ৯৫০ কোটি টাকা জমা পড়েছে। পরশ পাথর যখন সব সোনা করে দিচ্ছিল তখন তিনি শিব-কালী-হরি এই তিন দেবতার নাম নিয়ে ডাক ছেড়ে কেঁদেছিলেন। আজ দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বললেন - আবার আমাকে বোকা বানানো? এবার তোমাদের যমের দক্ষিণ দুয়ার দেখাবো। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝেছেন শিব হল আদালত, কালী পুলিশ আর হরি ভিজিলেন্স। হরি নালিশ দাখিল করে। শিবের হুকুম পেলে কালী মাথা কাটে।
উকিলবাবু দৃপ্ত পদে ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে হরিয়াকে বললেন
- মা-কে গিয়ে বলবি ব্যাঙ্ক এখনও ডিম পাড়েনি।
- মা তো এখন বোষ্টমী। ডিম দিয়ে উনি কী করবেন?
- তুই দূর হ হতভাগা।
পরেশবাবু সোজা কোর্টে এলেন। আগাম জামিনের জন্য নিজের নামে কেভিয়েটের পিটিশন পাকা করে নিজেই সশরীরে ছোট জজের কোর্টে হাজির হলেন। জজ সাহেব মুচকি হেসে বললেন - আবার কী পরশ পাথর নাকি?
- না হুজুর তেমন কিছু নয়।
পরেশবাবুর কেভিয়েট পাকা হয়ে গেল।
প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাস
পরেশবাবুর তলব পেয়ে তাঁর পুরোনো সচিব প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাস ওরফে কালী ব্যানার্জি সাত সকালে ল্যাপটপ সহ লিলুয়ার বাড়িতে হাজির।
পরেশবাবু কোন রকম ভূমিকা না করেই বললেন
- প্রিয়তোষ আমি আবার দান সাগরে ভাসবো।
- শেষে আমাকে আবার কিছু গিলতে হবে না তো স্যার?
- প্রিয়তোষ প্রস্তর যুগ শেষ। এখন যা হচ্ছে তা হাওয়ায় হাওয়ায়।
- আপনার টাইম লাইন বলুন।
- সেটা কী জিনিস?
- অর্থাৎ কবে কী করতে চান।
- প্রথমেই আমি সমস্ত রাজনৈতিক দলকে ১০ কোটি টাকা করে দান করবো।
প্রিয়তোষ ল্যাপটপ ঘেঁটে বলল
- দেশে তো সতেরোশ রাজনৈতিক দল আছে।
- সে-কি? এ তো দেখছি রাবণের গুষ্টি।
- তবে জাতীয় স্তরে আছে সাতটি- আর রাজ্যস্তরে দুটি।
- তার মানে নয়টি। তাতে দাঁড়াছে নব্বই কোটি। ওটা আমার হাতের ময়লা।
- এদের দান করলে আপনি আয়কর আইনের আশি জি জি সি ধারায় কর ছাড় পাবেন।
- বাঃ। তোফা তোফা।
- কিন্তু আপনি সবাইকে চাঁদা দিলে তো বোঝা যাবে না আপনি কার লোক?
- শুরুতে আমি কারও লোক নই। এখন ওরা সবাই আমার লোক।
সোনার কেল্লা
প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাসের তৎপরতায় ছোটো গোবিন্দপুরের সোনার কেল্লায় পাঁচ হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে। লিলুয়ার পাট চুকিয়ে পরেশবাবু সস্ত্রীক চলে এসেছেন। আসার দিন থেকেই বালি ঘন্টু, পাইপ টক্কা, হাতুড়ি ভজা আর ঝিলিক জগা অর্থাৎ ভজঘট বাহিনী পরেশবাবুর পায়ে গড় দিয়েছে। তাদের বলা হয়েছে যা কথা সব প্রিয়তোষের সঙ্গে। গিরিবালাদেবী আবার কণ্ঠি ছেড়ে সালঙ্করা হয়েছেন।
আপাতত পরেশবাবুর সামনে তিনটি কাজ। সোনার কেল্লা অ্যাপার্টমেন্টে তাঁর একটি পূর্ণাবয়ব স্ট্যাচু বসবে। সেটি ২৪ ঘন্টা ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরবে। অর্থাৎ তিনি সকলের দিকে নজর রাখবেন। কাজের বরাত ভজঘট বাহিনীর উপর। মূর্তি মনের মত না হলে তাদের গলা কাটা যাবে।
তিনি একটি কলেজ খুলবেন। সেখানে বিনামূল্যে পড়ানো হবে। কলেজ এর নাম ইনস্টিটিউট অফ ক্রাইম এন্ড প্রিজম। বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি বাংলার তরুণ সমাজকে শেখাতে চান কী করে জেলে যেতে হয় এবং জেলে ঢুকলে কী করে জামাই আদরে থাকতে হয়।
পরেশবাবুর তৃতীয় ইচ্ছা যুগান্তকারী। তিনি চাঁদে যাবেন। প্রিয়তোষ এই বিষয়ে নাসার সঙ্গে ই-মেল চালাচালি শুরু করেছে।
ট্যাটন খ্যাটন
পরেশবাবুর ত্রিফলা ব্রত নিয়ে কাগজ, টিভি, নেট, ফেসবুক সর্বত্র যা বিজ্ঞাপন হয়েছে তাতে তাঁকে একবার দেখার জন্য ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। একদিন বৈঠকখানায় ঢুকেই তিরিক্ষি মোজাজে তিনি প্রশ্ন করলেন
- প্রিয়তোষ সাত-সকালে এই জোড়া বলদ কোথা থেকে এল?
দুই সাক্ষাৎপ্রার্থী লাফিয়ে উঠে বলল
- মামা আমরা এখন জোড়া বলদ নই। আমরা একই বৃন্তে জোড়া ফুল।
- খোলস বদলেছিস? তাই বল। আয় আয় কাছে আয়। ছোটোবেলায় কত কোলে পিঠে চড়েছিস।
দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে অন্দরে ঢুকতে ঢুকতে তিনি হাঁক পাড়লেন
- হ্যাঁ গো শুনছো। ট্যাটন খ্যাটন এসেছে। ওদের একটু নুচি আর হালুয়া করে দেও।
পরেশবাবু ভাগ্নেদের নিয়ে খোশ গল্পে মজে গেলেন। তাঁর এই শ্রীবৃদ্ধির কাহিনি গোপন রেখে তিনি দেশ উদ্ধার নিয়ে ভাষণ দিলেন। তিনি যে এখন যথেষ্ট পুলকিত সে কথা বোঝানোর জন্য এক হাতে এটিএম আর অন্য হাতে পেটিমের কার্ড নিয়ে নাচতে নাচতে বললেন
- আমার অ্যাটম আর প্যাটম। যেন আমার ট্যাটন খ্যাটন! ট্যাটন খ্যাটন!! তোরাই তো দেশের ভবিষ্যৎ। তোরাই তো মরা গাঙে বাণ ডাকাবি।
- সে বাণ আমরা অলরেডি ডাকিয়েছি।
- কবে? কোথায়? কীভাবে?
- কেন? তোমার ধজা মারা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে?
- তার মানে?
- প্রভুদয়াল গড়গড়িয়ার নোটের পাহাড় তো এখন ভাগ্যলক্ষ্মী ব্যাঙ্কে।
হঠাৎ ঘরের পরিবেশ বদলে গেল। পরেশবাবু দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আবার দ্রুত পায়ে ফিরে এলেন। তাঁকে দেখে ট্যাটন খ্যাটন আঁকতে উঠে বলল
- মামা তুমি কী সুইসাইড করবে নাকি?
- কেন? আমি এখন আনন্দধারায় ভাসছি। সুইসাইড করব কেন?
- তোমার রিভালভার তো নিজের দিকে তাক করা।
- সে আর তোদের দিকে ঘোরাতে কতক্ষণ। স্ট্যান্ড আপ। গেট আউট।
- নুচি হালুয়া শেষ হল না-তো।
- তুরন্ত নিকালো হিয়াসে।
ট্যাটন খ্যাটন নুচি হালুয়া নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। নামতেই তাদের দুদিকে দুই দুই চারখানা বাইক। প্রত্যেক বাইকের গায়ে লেখা ‘ভজঘট’। তারা নুচি হালুয়া দেখিয়ে বললো
- শেষ খাওয়া খেয়ে নে।
মিড দ্য প্রেস
সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারায় আত্মপ্রকাশ করলেন পরেশবাবু। ঘুঘু রাজনীতিকদের পিছনে ফেলে তিনি একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চললেন। “তুলকালাম” দৈনিক পত্রিকার টেপা চক্কত্তি ঝাঁঝিয়ে প্রশ্ন করলেন - আপনি এত টাকা পেলেন কোথায়?
- সেটা আমি নিজেও জানি না। তবে আমার অ্যাকাউন্টের টাকা আমারই।
চ্যানেল চাঁচাছোলা - তার মানে আপনি কালো টাকার মালিক।
- এখন ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি নিয়ে দেশ চালাছে শ্যাওলার নয়ন ছাতি। সে বলে দিয়েছে যে যা পেয়েছেন তা নিয়ে নিন।
- নয়ন ছাতি কে?
- ও হরি। শুধু পত্রকার হলে চলবে? একটু শরৎচন্দ্র পড়ো।
- মধ্যরাতে আপনার বাড়িতে অভিনেত্রীদের যাতায়াত শুরু হয়েছে।
- টিভি সিরিয়ালের ফুলটুসিরা অনেকেই আমার লাইফ পার্টনার হতে চাইছে যে!
- আপনি সবুজ গান্ধি টুপি পরছেন কেন?
- সাদা টুপি কাচা-কুচির ঝামেলা। রামমনোহর লোহিয়া গান্ধি টুপি লাল করেছিলেন। কিন্তু লালের বাজার এখন খারাপ। তাই আমি সবুজে ভিড়েছি। সবুজে থাকলে সময় বুঝে বন্দেমাতরমে যাওয়া যায়, আবার আল্লা হো- আকবরে ফেরা যায়।
চ্যানেল মুলি বাঁশ - আপনি চাঁদে গিয়ে কী করবেন?
- আমার বউকে নিয়ে একটু বেড়াবো। তোমার আপত্তি আছে?
- কালো টাকা বাগিয়েছেন। এবার আপনার বাড়ি তল্লাশি হবে।
- সে ভয়ে কম্পিত নহে এই নরাধম। ক্যাভিয়েট করা আছে।
মিডিয়া বুঝলো ইনি আগের পরেশবাবু নন। তাঁর জন্মান্তর ঘটেছে।
কার্টুন- ঋতুপর্ণ বসু