বিশ্বস্ত প্রতিবেশীর অনুভূতি

অনেকদিন পরে কথাটা আবার মনে পড়ল। ১৯৭৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী যখন ক্ষমতাচ্যুত হলেন তখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মোরারজী দেশাই। তিনি বিশ্বভারতীর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। আর তখনই তিনি জানিয়ে দেন যে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের আচার্য হওয়ার যোগ্যতা তাঁর নেই। সেইমত গুজরাতি সাহিত্যিক উমাশংকর যোশীকে আচার্য পদে নিয়োগ করা হয়। তবে একমাত্র মোরারজী দেশাই ছাড়া তাঁর আগে পরে কোনো প্রধানমন্ত্রীই এমন সিদ্ধান্ত নেননি।
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। ইন্দিরা গান্ধীও জীবনের একটা আবেগঘন সময়ে শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিলেন। তাঁরা দুজনেই এই প্রতিষ্ঠানের পরিমণ্ডল সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কিন্তু বাকি আর কোনো রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে কোনোরকম রবীন্দ্রপ্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। সেই কারণেই মোরারজী দেশাইয়ের সিদ্ধান্তকে তখন সুবিবেচনাপ্রসূত বলেই মনে হয়েছিল।
কথাটা নতুন করে মনে পড়ল সদ্য সমাপ্ত বিশ্বভারতী সমাবর্তনের চেহারা দেখে। সেখানে নরেন্দ্র মোদী রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কবির জামাতা বলে চালিয়ে দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক অনুগামীরা ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানও দিলেন – যে স্লোগানের সঙ্গে রামভক্তির কোনো সম্পর্ক নেই – এই স্লোগান বিগত ২৫ বছর ধরে উচ্চারিত হয়ে থাকে অপর ধর্মের বিরুদ্ধে ডাণ্ডাবাজি করার জন্য।
আরও পড়ুন
রামচন্দ্রের বঙ্গবিজয়
সমাবর্তন ঘিরে এইসব কাণ্ডকারখানা যখন ঘটছে তখন মঞ্চে উপবিষ্ট আছেম প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ নন, তেমন দাবিও তিনি কোনোদিন করেননি। কিন্তু যেহেতু তাঁর দেশের রাজনৈতিক আদলের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আগাগোড়া সম্পৃক্ত হয়ে আছেন তাই তাঁর চলনে বলনে কখনওই রবীন্দ্রনাথ ভ্রান্ত উদ্ধৃতির শিকার হন না। ফলে এই মানুষটির উপস্থিতিকে সম্মান জানানোর জন্যই ভারতীয় পক্ষের যথোচিত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ ছিল।
আমরা জানি পাকিস্তানি সরকারের ক্ষতচিহ্ন আজও বাংলাদেশের শরীর থেকে মুছে যায়নি। সেই কারণেই ভারতের কাছ থেকে যথোচিত সমাদর, সম্মান তিনি প্রত্যাশা করতে পারেন। সেইটুকু পাবার জন্য তাঁর এবং তাঁর সরকারের তরফে তিনি চেষ্টার কোনো কসুর করেননি। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করা তার একটি বড় প্রমাণ। বিপরীতে গঙ্গার জল, ছিটমহল বা তিস্তার জল নিয়ে বোঝাপড়ায় আদতে ভারতের যে দীর্ঘসূত্রিতা, তা কেবল তাঁকে আহত করেনি, তাঁর রাজনৈতিক বিপন্নতাও ডেকে এনেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে কোনো ঔপনিষদিক অনুভূতির মাহাত্ম্য বর্ণনা করেননি। রবীন্দ্রভাবনার ত্রিসীমানায় তিনি যাননি। তিনি নিজের সরকারের মনগড়া সাফল্য নিয়ে ঢাক পিটিয়েছেন। এই ভাষণ শেখ হাসিনাকে প্ররোচিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু হাসিনা ভারত সম্পর্কে তাঁর আন্তরিক অনুভূতির কারণেই সেই পথে হাঁটেননি। তিনি রবীন্দ্রমহিমার মুগ্ধতাই কেবল প্রকাশ করেছেন। এই উপলক্ষ আরও তাৎপর্যময় হতে পারত যদি ভারত তার বিশ্বস্ত প্রতিবেশীর মনের কথা জানার চেষ্টা করত।