সত্তরের দশক, মধ্যরাতের পার্ক স্ট্রিট ও অ্যাংলোদের বিখ্যাত ‘ট্রিঙ্কাজ’

গত শতকের তিনের দশক। টি রুম ও কনফেকশনারি হিসেবে এক সুইস দম্পতির হাত ধরে যাত্রা শুরু হয়েছিল পার্ক স্ট্রিট এলাকার বিখ্যাত বার/ রেস্তোরাঁ ট্রিঙ্কাজের। তাঁদের পদবীর নামানুসারেই নাকি এমন নামকরণ। যদিও সেই দম্পতির নাম জানা যায় না। ১৯৫৯ সালে হাত বদল হল। ওম প্রকাশ পুরী ও এলিস জোশুয়া কিনে নিলেন ট্রিঙ্কাজ। তারপর থেকেই ট্রিঙ্কাজের ব্যবসায় রমরমা। রেস্তোরাঁর পাশাপাশি লাইভ মিউজিকেরও আয়োজন করেন তাঁরা। পাঁচের দশকের শেষ থেকে প্রায় আটের দশক পর্যন্ত ভারতের একমাত্র বিনোদন রাজধানী ছিল খাস কলকাতা। পাশাপাশি ভারতের আর্থিক রাজধানীও ছিল এ শহর। ফলে অধিকাংশ কর্পোরেটরা কলকাতাতেই থাকতে পছন্দ করতেন। যদিও কলকাতায় লাইভ মিউজিকের বাণিজ্য শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রাক্কালে মার্কিন সেনাদের সুবাদে। মধ্যরাতে সময় কাটানোর একমাত্র সঙ্গী। পার্ক স্ট্রিট ছাড়াও ছিল গ্রেট ইস্টার্ন, ধর্মতলা, চৌরঙ্গী চত্বর। ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল বিভিন্ন হোটেল এবং নাইট ক্লাব।
সাইরা বানু, এলিস জোশুয়া এবং দিলীপ কুমার (সাগিনা মাহাতোর মৃত্যুর সমসাময়িক ছবি)
সারাদিনের নানারকম ব্যস্ততার পর রাত্রের বিনোদন খুঁজে নিতেন আধুনিকমনস্ক মানুষ। ওই মধ্যরাতেরই ফসল কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ঊষা উত্থুপ। সেই সময় উনিই ছিলেন একমাত্র শিল্পী, যাঁকে প্রতিদিন শাড়ি পরতে দেখা যেত। ঊষা গাইতেন ক্যালিপ্সো। আর চারদিকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা ফক্সট্রট, রাম্বা, সাম্বা, চা-চা-চা নাচতেন। সে এক সময় ছিল বটে!
ট্রিঙ্কাস-এর মালিক বদলের পর ওম পুরী, স্মরণ পুরী এবং এলিস জোশুয়া (১৯৫৯)
ট্রিঙ্কাসে গাইছেন ঊষা উত্থুপ (১৯৭৩)
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল বার, রেস্তোরাঁর ধরন, এমনকি লাইভ মিউজিকও। কলকাতা খানিক তার মেজাজ হারাল। পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাত বদলে গেল। কিন্তু ট্রিঙ্কাজ এখনও স্বমহিমায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আজও। সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওম প্রকাশ পুরীর পুত্র দীপক পুরী জানিয়েছিলেন, বহু রেস্তোরাঁ ও বারে স্টুয়ার্ড ও কর্মচারীরা ছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, কারণ তাঁরা ইংরেজিতে কথা বলতে পারতেন। সে সময়ে খদ্দেররা মূলত ছিলেন পাশ্চাত্য দ্বারা প্রভাবিত এবং ব্রিটিশ রাজের হ্যাং ওভার ছিল সকলের মধ্যেই। যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারত অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ই তখনকার কলকাতাকে নির্মাণ করছিল এবং সেরা সংগীত প্রতিভাও ছিল তাদের মধ্যেই। ট্রিঙ্কাজে ঊষা উত্থুপ ছাড়াও সেইসব অ্যাংলোদের ভিড়ও ছিল দেখার মতো।
এখনকার ট্রিঙ্কাজ
সত্তর-আশির দশকে ট্রিঙ্কাজে গিয়ে প্রেম করা মানে ছিল বেশ একটা দেখনসই ব্যাপার। সবার সাধ্যে কুলাত না। কিন্তু প্রেমিক বা প্রেমিকাকে দেখিয়ে দেওয়ার যে বীরত্ব, তা কাজ করত ট্রিঙ্কাজে এলে। তখনও মোবাইল ফোন মানুষের জীবন অধিকার করেনি। ট্রিঙ্কাজে কেউ গান ধরলে প্রেমিকা আলতো হাসতেন, আর প্রেমিক হয়তো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন প্রেমিকার দিকে। কারোর পলক পড়ছে না। বাড়ি ফেরার পথে ফেলে আসতেন কত কত স্মৃতি, ভালোলাগা। সত্তরের দশক, সেই নারী, সেই পুরুষ, আদরের দাগ, কিংবা কোনো সমকামী যুগল হুশ করে পেরিয়ে গেলেন একে অপরের কাঁধে হাত রেখে। প্রথাগত ‘নিয়ম ভাঙার খেলা’ ছিল সেসব। ছিল বিরহের একাকিত্ব-নিঃসঙ্গতা। ‘আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকি?’ হয়তো অনেককিছুই বাকি থেকে গেছে। দেওয়ালের গায়ে কান পাতলে এখনও শোনা যাবে একা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা আলোদের চিৎকার। যতদিন পার্ক স্ট্রিট গান গাইবে, ততদিন ট্রিঙ্কাজে আলো জ্বলবে, অটুট থাকবে সবকিছু। এই ডিসেম্বরের শহরে এগুলোই তো একটুকরো প্রেম। ঠিক যেমন কবি লিখেছেন, “কেবল সময় সন্ধে হলে/ নিজেই নেশার দরজা খোলে/ ক্লান্ত পায়ে বয়স ঢোকে ম্যাগনোলিয়া’য়... ট্রিঙ্কাজ-এ...”
ছবি সৌজন্যেঃ ট্রিঙ্কাজ