ভূতলেখকদের কারিকুরি

ভূতেরাও লেখে। বই লেখে। সাড়াজাগানো অনেক বইয়ের লেখক ভূত। সেই সব বই থেকে যশ-খ্যাতি ইত্যাদি অর্জনও করে তারা। কিন্তু এর জন্য তারা মানুষ বা তাদের সমাজে নিজেদের পরিচিতি হাজির করতে বিন্দুমাত্র উৎসাহ বোধ করে না। এসব কথা মোটেও নতুন নয় যদিও। তবে বহু চর্চিতও নয়। ইংরেজিতে যাঁদের ঘোস্ট রাইটার বলা হয়, পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই সেই ভূতলেখকরা কম-বেশি বিরাজ করছে, কোথাও কোথাও প্রবল বিক্রমে। কবে এবং কীভাবে তারা লিখতে শুরু করল কিংবা কেই-বা আদি ভূতলেখক, যাকে পরবর্তীতে অনুসরণ করে উত্তরসূরিরা পথ চলতে শুরু করল বলা মুশকিল। আসলে লেখালেখির প্রকাশ্য জগতে ভূতলেখকরা একধরনের আন্ডারওয়ার্ল্ডের বাসিন্দা। তবে সভ্যতার গোড়ায় অর্থাৎ লেখা-পড়া ব্যপারটা শুরু হওয়ার সময় থেকেই ভূতলেখকদের নিয়ে কথাবার্তা ও নানা গুজব প্রচারিত ছিল। বিশ্বখ্যাত বেশ কিছু ধ্রুপদি সাহিত্য যেমন হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াড, অডিসি বা শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটসহ বেশ কিছু নাটক ও সনেটকে অনেকে ভুতুড়ে বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে আবার কিংবদন্তি কয়েকজন লেখক-শিল্পীর বিষয়ে জানা যায়, জীবনের শুরুতে তাঁরা অন্যের হয়ে ভূতগিরি বা ঘোস্টিং করেছেন। যেমন মোজার্ট একসময় অন্য সংগীতকারের হয়ে বেশ কিছু লিরিক কেবল লিখে দেননি, সুরারোপ করেও তাঁদের খ্যাতির পরিচর্যা করেছেন।
এই ভূতলেখক কারা? তার আগে বলা দরকার মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়েই কিন্তু অন্যের জন্য বই লেখা। একাজে সৃজনশীল, মননশীল ও আত্মজীবনীমূলক বই যেমন থাকে, গবেষণাপত্র, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তৃতা, এমনকী ছাত্রছাত্রীদের টার্ম পেপারও বাদ যায় না। মূলত রাষ্ট্রপ্রধান, রাজনীতিক, সিনেমা তারকা, খেলোয়াড়দের আত্মজীবনী ও স্মৃতিচারণামূলক বই লিখতে ভূতলেখকেরা ভাড়া খাটে। এমনও শোনা যায়, অনেক প্রকাশনা সংস্থা তাদের বাজারচলতি বই ছাপতেও ঘোস্ট রাইটারদের ভাড়া করে থাকে। থ্রিলার বা রহস্যকাহিনির ক্ষেত্রে এটা বেশ কাজে খাটে বলে শোনা যায়। পাঠক মূল লেখকের বই ভেবে খুশিমনে বইগুলো কেনে ও পড়ে। তাই মূল বইয়ের চেয়ে ভুতুড়ে বই বেশি পাঠকপ্রিয় হওয়ার ঘটনা আশ্চর্যজনক কিছু নয়।
পাকিস্তানের শাসক আইয়ুব খানের আত্মজীবনীমূলক বই ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স’-এর ভূতলেখক কে ছিলেন, এ নিয়ে নানা গুজব একসময় বেশ প্রচলিত ছিল। কেবল তাই নয়, এর বাংলা তর্জমা নিয়েও তৎকালীন নেতৃস্থানীয় একজন বুদ্ধিজীবীর নাম প্রায়ই উচ্চারিত হত। ঘটনা হল বারাক ওবামা, হিলারি ক্লিনটন সবার বই-ই তো ভূতলেখকদের লেখা। রাষ্ট্রশাসকদের লেখক হওয়ার স্বপ্নটা প্রায় মজ্জাগত। বাংলাদেশের জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালীন তাঁর কাব্যপ্রতিভার আচমকা বিস্ফোরণ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তা দপ করে নিভে গেল। সেই কাঁচা পদ্যগুলো কোন ভূতের কলম থেকে বেরিয়েছিল তা নিয়ে রসিকতা তো কম হয়নি। তা বলে কি রাষ্ট্রনায়করা ভূতলেখকদের দিয়ে নিজের নামে বই লেখা থামিয়েছেন?
লেখার ক্ষমতা অনুযায়ী ভূতলেখকদের পারিশ্রমিকের তারতম্য রয়েছে। বিষয়টা নির্ভর করছে, যাঁর নামে বইটা লেখা হচ্ছে, তাঁর ব্র্যান্ড ভ্যালু। নিউইয়র্ক টাইমস একবার হিলারি ক্লিনটনের স্মৃতিচারণামূলক বইয়ের খবর ফাঁস করে জানিয়েছিল, যিনি এটা লিখে দিচ্ছেন, তিনি মজুরি পাচ্ছেন পাঁচ লাখ ডলার, আর স্বয়ং হিলারি নিজের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাবদ প্রকাশকের কাছ থেকে আগাম নিচ্ছেন আট মিলিয়ন ডলার। এটা যে খুব উঁচু দরের পারিশ্রমিকের নমুনা তা বলাই বাহুল্য। খবর সূত্রে যতদূর জানা যায়, ১৫০ থেকে ২০০ পৃষ্ঠার একটা বইয়ের জন্য একজন প্রতিষ্ঠিত ঘোস্ট রাইটার একাজের পারিশ্রমিক বাবদ ১৫ থেকে ২০ হাজার ডলার পেয়ে থাকেন।
একথা বলাই বাহুল্য যে ভূতলেখকরা মূলত লেখক এবং অনেকেই শক্তিমান লেখক। কিন্তু সার্থক লেখকজীবনের কোনো স্বাদই কি তাঁরা পান? নাকি তাঁরা তাঁদের আকাঙ্ক্ষাকে কখনোই সে পথে ধাবিত করেন না? বাস্তব ঘটনাটা কী? একটা তুমুল সাড়াজাগানো বই অন্যের হয়ে লেখার পর বেশ কিছু টাকাপয়সা হাতে এলেও নিজের শ্রমের বিনিময়ে অন্যের খ্যাতি কিম্বা জনপ্রিয়তা কি একটুও পীড়া দেয় না? না, দেয় না। এমনটাই বলছেন একজন ব্রিটিশ ঘোস্ট রাইটার এন্ড্রু ক্রফটস তাঁর ‘কনফেশনস অব আ ঘোস্ট রাইটার’ বইয়ে। ক্রফটস দীর্ঘদিনের একজন নামীদামি ঘোস্ট, বহুকাল নিজেকে আড়ালে রাখার পর স্বনামে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর পক্ষে লোকচক্ষুর আড়ালে বা আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকা সম্ভব হয়নি। সাংবাদিকরা তাঁর সাক্ষাৎকারও ছেপেছেন। হোরাশিয়া হ্যারোড নামে লন্ডনের ইকোনমিক টাইমস-এর সাংবাদিককে কথা প্রসঙ্গে ক্রফটস জানিয়েছেন, যেদিন থেকে তিনি নিজেকে ঘোস্টিংয়ে নিয়োজিত করেছেন, খ্যাতির মোহ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন। তাই অন্যের নামে লেখা বই পাঠক-সমাদর পেলেই তিনি খুশি, আর মোদ্দা কথা হল কাজটা আনন্দদায়ক। তাঁর মতে, যে কোনো ধরনের অহং-এর শেকড় সমূলে উপড়ে তবে এ কাজে নামতে হয়। পৃথিবীতে মানুষ তার প্রয়োজনের সব কাজকর্ম নিজে করে না, অনেক কিছুই অন্যকে দিয়ে করায়; বাড়িঘর বানানো থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি সারানো- তাছাড়া আউটসোর্সিংয়ের ব্যাপারটা যেখানে সারা দুনিয়াতে রয়েছে, সেখানে বই লেখার মতো কাজে কেন একই নীতি প্রযোজ্য হবে না।
আরও পড়ুন
দুনিয়ার যত খাপছাড়া শহর
ক্রফটসের বক্তব্য খুবই সোজাসাপ্টা। তাঁর যুক্তি যেমনই হোক, এর থেকে একজন ঘোস্ট রাইটারের মনমানসিকতা কিছুটা হলেও বোঝা যায়। ক্রফটস নিজের কাজ সম্বন্ধে তাঁর বইয়ে চাঞ্চল্যকর একটি কথা বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই ভাড়ায় বই লেখা মানে প্রচুর টাকা কামান, কিন্তু এর পাশাপাশি দুনিয়ার সেরা পণ্ডিতদের কাছে শিক্ষালাভও তো হয়। উদাহরণ হিসেবে বলছেন, ডারউইনের হয়ে যদি কাউকে দ্য অরিজিন অব দ্য স্পিসিস বা এডওয়ার্ড গিবোনের হয়ে দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার লিখতে হত, তাহলে ব্যাপারটা কি এমন হত না যে, টাকা ঢেলে বিশ্বসেরা মনীষীরা তাঁদের চিন্তাভাবনা ও জ্ঞানভাণ্ডারের দরজা খুলে দিয়েছেন। শিক্ষালাভের এমন অকল্পনীয় সুযোগ আর কী হতে পারে।
যদিও ডারউইন, গিবোন, কার্ল মার্ক্স, মিশেল ফুকো, এডওয়ার্ড সৈয়দ তাঁদের বইপত্র গোস্টদের দিয়ে লেখাননি। দুনিয়ার কোনো সেরা মনীষীই তা করেননি। ভূতগিরি বা গোস্টিং করার ক্ষেত্রে সেরা পণ্ডিত, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিকদের কাছে একাধারে শিক্ষালাভ ও অর্থ উপার্জনের বিষয়টি আত্মরক্ষাপ্রসূত কল্পনাবিলাস বই কিছু নয়।
তবে এটা ঠিক যে ভূতলেখকেরা নামজাদা ব্যক্তিদের জীবনী-আত্মজীবনী বা ওই জাতীয় বই লিখতে গিয়ে তাঁদের বিষয়ে এমন সব চাঞ্চল্যকর খবর পান যা এক দিক দিয়ে চোখ খুলে যাওয়ার ঘটনাই বটে। সে দিক থেকে টাকা রোজগারের বাইরে ভূতগিরির অন্য প্রাপ্তি হচ্ছে, খ্যাতিমান মানুষজনের সংস্পর্শে আসা এবং তাঁদের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে গভীরভাবে জানা।
একজন ভূতলেখক নিজের অভিজ্ঞতার বয়ান দিতে গিয়ে বলেছেন, তাঁকে একবার মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যাবতীয় আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা সমেত, আসল কথা তাঁকে এক ধনাঢ্য বৃদ্ধের নাতি-নাতনিরা ভাড়া করছিল উদ্দেশ্য শেষ ইচ্ছা পূরণে বৃদ্ধর জন্মদিনে এই ভূতলেখককে সারপ্রাইজ হিসেবে উপস্থাপন করা এবং আত্মজীবনী লেখানো।
ভূতলেখকের কাজে নিজের জ্ঞানগম্যি বা আমিত্ব ফলানোর সুযোগ নেই। এ কাজে যিনি তাঁকে ভাড়া করেছেন তাঁর জবানিকে যতটা সম্ভব অনুসরণ করে উপস্থাপন করা। ওই ব্যক্তির চিন্তাভাবনা, কল্পনাশক্তি, বলার ভঙ্গিকে ততদূর গভীর পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে লেখার প্রস্তুতি নেওয়া, যাতে বইটি যে তাঁরই লেখা—এ ধারণায় কোনো ফাঁকফোকর থেকে না যায়। এদিক দিয়ে দিয়ে কাজটা খুব যে সহজসাধ্য সেরকমটা নয়।
প্রশ ঊঠতেই পারে ঘোস্টিং বা ভূতগিরি কি বেআইনি? প্রমাণসাপেক্ষে যেকোনো ধরনের অনৈতিক কাজ-এর মতো এ-ও বেআইনি হতে বাধ্য, তবে এটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে সেই দেশের প্রচলিত আইনি ব্যবস্থার ওপর।