স্বাধীনতার ৭৫-এ আদিবাসী রাষ্ট্রপতি

গল্প প্রচলিত আছে, সপ্তম রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং নাকি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির (Indira Gandhi) গাড়ির দরজা খুলে দিতেন। বিখ্যাত কার্টুনিস্ট আবু আব্রাহাম এঁকেছিলেন, বাথটবে স্নান করতে করতে, বাথরুমের দরজার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে একটা কাগজে একজন সই করছেন, যেটা নাকি জরুরি অবস্থা জারির (Emergency) নির্দেশনামা। ফখরুদ্দিন আলি আহমেদকে এই ভাবেই এঁকেছিলেন আবু আব্রাহাম। এতকিছুর পরেও, রাষ্ট্রপতিই ভারতের প্রথম নাগরিক। অত্যন্ত সম্মানজনক পদ। বিদেশেরও তিনি দেশের প্রতিনিধি।
পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের (Presidential Election 2022) মুখে দেশ দাঁড়িয়ে। এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একজন সাঁওতাল মহিলা, দ্রৌপদী মুর্মুকে (Draupadi Murmu) প্রার্থী করে শাসকদল বিজেপি সবাইকে বেশ খানিকটা চমকেই দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি ভোটে অঙ্কের হিসেবে এনডিএ-র যত ভোট প্রাপ্য, তা প্রয়োজনের থেকে সামান্য কমই ছিল। তবে বিজেপি নিশ্চিত ছিল, বিরোধীরাও মোটামুটি জানত, ওইটুকু ভোট বিজেপির ভোট ম্যানেজাররা ব্যবস্থা করে নেবে সহজেই।
ইতিমধ্যেই ওয়াই এস আর কংগ্রেস, বি জে ডি, নীতিশ কুমারের জেডিইউ, মায়াবতীর বিএসপি-সহ কয়েকটি এনডিএ বহির্ভূত দল জানিয়ে দিয়েছে তারা দ্রৌপদী মুর্মুকে সমর্থন করবে। ফলে এটা ধরেই নেওয়া যায় ভারত তার ৭৫তম স্বাধীনতার বছরে (75 Years of Independence) দেশের সর্বোচ্চ পদে একজন আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতি পেতে চলেছেন। আগামী ১৮ জুলাই হবে রাষ্ট্রপতি ভোট। ফল ঘোষণা ২১ জুলাই।
বর্তমানে দেশে আদিবাসীর সংখ্যা দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ। ফলে প্রকৃত অর্থে তিনিও একজন সংখ্যালঘু প্রতিনিধি। এটা অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু যখন স্বাধীনতার ৭৫ বছরে ঘটনাটা ঘটছে, তাকে স্বাগত জানানো উচিত সকলেরই। এমনকি বিরোধী ঐক্যের জন্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণকারী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) ইতিমধ্যেই মন্তব্য করেছেন, আগে জানলে তাঁরাও দ্রৌপদীকে সমর্থনের কথা বিবেচনা করতেন। পৃথিবীর বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিজেপির এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই দু-হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছে। আবার এটাও ঠিক এই লেখা যখন লিখছি, তখন কেন্দ্রে বিজেপির মন্ত্রীসভায় ৭৭ জনের মধ্যে একজনও মুসলিম মন্ত্রী নেই, বিজেপির লোকসভা সদস্যদের একজনও মুসলিম নয়, বিজেপির রাজ্যসভা সদস্যদের মধ্যেও একজনও মুসলিম জনপ্রতিনিধি নেই। এটা কি ‘ইনক্লুসিভ’ রাজনীতির লক্ষণ? সেই প্রশ্নও উঠছে।
আদিবাসী রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন প্রসঙ্গে আমরা একবার দেখে নিই, আধুনিক ভারত গঠনে আদিবাসীদের কী অবদান। ২০০৮ সালে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে একটি রিপোর্ট জমা পড়েছিল। বিষয়, কেন মাওবাদীদের হিংসার রাজনীতি আদিবাসীদের আকর্ষণ করছে? সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ১৯৪৭ সাল থেলে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্রায় ২.৫ কোটি হেক্টর। যার ভিতর অরণ্য ৭০ লক্ষ হেক্টর। এই জমি অধিগ্রহণের ফলে প্রায় ৬ কোটি মানুষ হয় উচ্ছেদ হয়েছেন বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের ৪০ শতাংশই আদিবাসী। যদিও ভারতের জনসংখ্যার মাত্র ৮.০৩ শতাংশ আদিবাসী মানুষের বাস।
দেশের উন্নয়নে এত বড়ো যোগদান সত্ত্বেও আদিবাসীরা এখনও দেশের সব থেকে পিছিয়ে পড়া অংশ। ফলে একজন আদিবাসী যখন দেশের রাষ্ট্রপতি হবেন, দেশ আসলে কিছুটা ঋণ-ই পরিষোধ করবে এর মধ্যে দিয়ে। যদিও প্রশ্ন থাকবে, হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিনিধি দ্রৌপদী মুর্মু কতটা আদিবাসীদের প্রতিনিধি আর কতটা আরএসএস (RSS)-বিজেপির (BJP) প্রতিনিধি। কারণ, তিনি একজন আদিবাসী নেত্রী হয়েও, অভিযোগ উঠেছে, ওড়িশায় যখন কর্পোরেটের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের আন্দোলন চলছিল, তাঁকে আদিবাসীদের পাশে দেখা যায়নি। বিজেপি কি তাঁকে মনোনয়ন দিয়ে শুধুই একটা প্রতীক তৈরি করতে চাইছে? শুধুই প্রচারে ব্যবহার করার একটা কৌশল এই মনোনয়ন? সময়ই সে কথা বলবে।
আমরা যদি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে লেখা দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের চিঠিপত্রের দিকে নজর দিই তো দেখতে পাব, ডাঃ প্রসাদ কীভাবে নেহরুকে পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাধীন নির্বাচন কমিশন তৈরি করার ব্যাপারে। শুধু তাই নয়, আরও নানা বিষয়ে যে তিনি নেহরুকে তাঁর স্পষ্ট মতামত জানাতেন, তার প্রমাণ ওই সব চিঠির পাতায় পাতায় রয়েছে। তবে এটাও ঠিক, এই উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেশে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রপতি ভবন আর সরকারের সম্পর্কটা (কে আর নারায়ণনের মতো এক আধ জন ব্যতিক্রমী চরিত্রকে বাদ দিলে) হয়ে উঠল, (ভালো রাজনৈতিক ভাষায় বলতে হলে বলতে হয়) ‘বন্ধুত্বের’। তার সব থেকে ভয়ঙ্কর প্রমাণ, ইন্দিরা গান্ধি যখন ক্যাবিনেট মিটিং না করেই ১৯৭৫-এর ২৫ জুন, রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমেদকে মাঝ রাত্তিরে কুড়ি লাইনের চিঠি লিখে জরুরি অবস্থা জারি করিয়েছিলেন। যে চিঠির শুরুটা ছিল এই ভাবে, “...information has reached us, which indicates that there is an imminant danger to the security of India being threatened by internal disturbance. The matter is extremely urgent... in the circumstances, and in case you are so satisfied, a requisite proclamation under article 352(1) has become necessary.”
রাষ্ট্রপতি কোনও বৈঠক করলেন না, কোনও গোয়ান্দা রিপোর্ট দেখতে চাইলেন না, এক কথায় সই করে জরুরি অবস্থা জারি করে দিলেন। দু-ঘণ্টার মধ্যে কেটে দেওয়া হল সমস্ত খবরের কাগজের লাইন। শুরু হয়ে গেল লক্ষাধিক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে মিসায় গ্রেফতার। বুলডোজার দিয়ে সংখ্যালঘু গরিব মানুষদের বস্তি উচ্ছেদ। এই ইতিহাস তো সকলের জানা।
এই যে সরকার এবং রাষ্ট্রপতি ভবনের হাতে হাত ধরা মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, এটা কি গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো? এই তর্ক কিন্তু মাঝে মধ্যেই উঠেছে। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলই এর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা, রাষ্ট্রপতি, এর মধ্যে দিয়ে সংবিধানে একটা ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স’-এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেটা গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। এই কথাটা আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মনে রাখতে চাইছে না।
তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস-সহ ১৮টা বিরোধী দলের প্রার্থী যশোবন্ত সিনহা (Yashwant Sinha) কিন্তু এই প্রশ্নটা তুলেছেন। বলেছেন, রাষ্ট্রপতি সরকারের রাবার স্ট্যাম্প নয়, এই শর্তেই তিনি ভোট চাইবেন। তিনি জিতবেন না, সেটা তিনিও জানেন। কিন্তু কিছু প্রয়োজনীয় কথা দেশ জুড়ে তিনি যদি বলেন, সেটা কাজের হতে পারে। যশোবন্ত সিনহা অবশ্য বিরোধীদের প্রথম পছন্দ ছিল না। শারদ পাওয়ার, ফারুক আবদুল্লা, গোপালকৃষ্ণ গান্ধি, তিন জনের কেউই রাজি না হওয়ায় প্রাক্তন আমলা, চন্দ্রশেখর এবং বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সদস্য যশোবন্ত সিনহাকে বিরোধীরা বেছে নেয়। খুব ভালো বাছাই হয়েছে সে কথা বলা যাবে না।
একজন আদিবাসী মহিলাকে প্রার্থী করার পিছনে বিজেপির ভোটের অঙ্কটা কাজ করেছে। এই বছরেই গুজরাটে বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে যথেষ্ট আদিবাসী ভোট রয়েছে। সামনের বছর নির্বাচন মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, ছত্তিশগড়-সহ আরও ১০টি রাজ্যে। এই মোট ১১টি রাজ্যে সংরক্ষিত আদিবাসী আসনের সংখ্যা ৩০০-র বেশি। আদিবাসী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে এখানে বিজেপির আসন বাড়তে পারে। তাছাড়া ৫৪৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৪৭টি এসটি-র জন্য সংরক্ষিত। আদিবাসী রাষ্ট্রপতি বেছে নেওয়ায়, ২০২৪-এর লোকসভা ভোটেও তার প্রভাব পড়তে পারে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়াকে কেন্দ্র করে একটা হালকা করে হলেও বিরোধী ঐক্যের ছবি ফুটে উঠেছে। সেই ঐক্য কি আরও বড়ো ঐক্যের দিকে এগোবে? বিরোধীদের জন্য খুবই চিন্তার বিষয় হল, দেখা যাচ্ছে, অত বড়ো কৃষক আন্দোলনের প্রভাব সেভাবে উত্তরপ্রদেশে বা পাঁচ রাজ্যের উপ নির্বাচনে পড়ল না, উন্নাও, লখিমপুরখেড়ি, হাথরসের মতো কেন্দ্রে বিজেপির ভোট বৃদ্ধি হল, যেভাবে অগ্নিবীর বিরোধী আন্দোলনের মধ্যেই সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টির দুটি লোকসভা আসন কেড়ে নিল বিজেপি, যে ভাবে পতন ঘটল মহারাষ্ট্রের উদ্ভব সরকারের, তাতে এটা স্পষ্ট, ২০২৪-এর জন্য জোট বাঁধার কাজ আগের থেকেও অনেক বেশি আন্তরিকতার সঙ্গে, অনেক বেশি খোলা মন নিয়ে করতে না পারলে বিজেপির মুখোমুখি দাঁড়ানোটাই কঠিন হবে বিরোধীদের। বিরোধীরা কি তার জন্য তৈরি?