সংবাদ পাঠে রূপান্তরকামী মহিলা, বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে ৫০-এর বাংলাদেশ

২০২১ সাল আমাদের মনে করাবে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর। যুদ্ধ, রক্ত, শ্রম, উপার্জন এবং স্বাধীন হওয়ার লড়াইয়ে ৫০ বছর আগে জিতে গিয়েছিল একদল বাঙালি। সোচ্চার কণ্ঠে বলতে পেরেছিল, বাঙালিয়ানা বিফলে যায় না। সেইসঙ্গে নারীদের কথাও সেদিন ঘোষিত হয়েছিল বেশ জোরালো ভাবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর যদি বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় ফিরে তাকাই, তাহলে মেয়েদের অবস্থান কতটা বুঝব? কতটা প্রগতিশীল হতে পেরেছে স্বাধীন বাংলাদেশ? প্যাট্রিয়ার্কি এবং হোমোফোবিয়া কতটা ঝেড়ে ফেলতে পেরেছে? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর স্বাধীনতার ৫০ বছর পর নিজেই দিল বাংলাদেশ। যা গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার মাস মার্চ। সেখানকার একটি জনপ্রিয় বেসরকারি টেলিভিশনের ব্যতিক্রমী উদ্যোগে নড়েচড়ে বসেছে সমগ্র দেশ। আজ নারী দিবস। আজকের দিন থেকেই টেলিভিশনে নিয়মিত সংবাদ পাঠ করবেন রূপান্তরকামী নারী তাসনুভা আনান। সেই চ্যানেলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “আমরা জানি, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল দেশের মানুষের মুক্তি, সবার জন্য বাসযোগ্য, বৈষম্যহীন একটি সমাজ গড়ে তোলা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে গর্ব করার মতো অনেক অর্জন থাকলেও বৈষম্যহীন ও সবার জন্য নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এই ব্যর্থতার কারণে সবচেয়ে বড়ো অবহেলিত জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রূপান্তরকামীরা অন্যতম।”
তাসনুভা আনান (শিশির) - ছবিসূত্রঃ ফেসবুক
কিন্তু কে এই তাসনুভা আনান? জন্মগতভাবে তিনি একজন পুরুষ হলেও মনে-প্রাণে তাঁর লড়াই ছিল মহিলাদের হয়ে কথা বলা। কিন্তু এই ধরনের গল্পে যেমনটা হয় আরকি! বাধ সেধেছিল সমাজ। প্রত্যেকটা দিন অবহেলার শিকার। পরবর্তীতে তিনি লিঙ্গ পরিবর্তন করে মহিলা হন। কিন্তু লড়াই আরও কঠিন হতে থাকে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার সমাজের অবহেলিত মানুষদের জন্য নানা প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছেন। এমনকি ভোটার তালিকায় সমান মর্যাদায় যাতে নাগরিকরা নিরাপদ থাকতে পারেন, তার কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। শোনা যায়, বিপুল সংখ্যক রূপান্তরকামীদের ভাতাও দেওয়া হয়। কিন্তু সামাজিকভাবে কি কোনও পরিবর্তন আদৌ এসেছে? এ প্রসঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার দিক উল্লেখ করিঃ
১) ব্রিটিশ ধর্মযাজক রিভারেন্ড স্ট্যানলি আন্ডারহিল ৯১ বছর বয়সে আত্মপ্রকাশ করে জানান, তিনি সমকামী। নিজের যৌন পরিচয় নিয়ে তিনি বলেন, “আমি সমকামী হিসেবেই জন্ম নিয়েছিলাম।” সারাজীবন তিনি কুসংস্কারের মধ্যে কাটালেও এখন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যদিও তাঁর সমাজ তাঁকে মেনে নিতে নারাজ। বৃদ্ধ বয়সে নানাভাবে হেনস্থাও হতে হয় তাঁকে।
২) মধ্য আমেরিকার দেশ পানামার কড়া লকডাউনের সময়কালীন অবস্থা। মার্কেটের সামনে লম্বা লাইন। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন মণিকা। সবার বাঁকা চোখ তাঁর দিকে। হঠাৎ সেখানে ছয়জন পুলিশ এলেন। লাইন থেকে মণিকাকে বের করে দেওয়া হল। মণিকার বক্তব্য অনুযায়ী, পুলিশ প্রায় দুই ঘন্টা তাঁর দেহতল্লাশি করেছিলেন। আর একজন বুকে চাপ দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, তুমি তো মেয়ে নও। তারপর রূপান্তরকামীদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি অপমানজনক শব্দপ্রয়োগ করলেন সেই পুলিশের দল।
৩) ফিরে আসি বাংলাদেশে। ২০১৪ সালে প্রথম এলজিবিটি পত্রিকা ‘রূপবাণ’ প্রকাশিত হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপক আলোড়ন পড়ে, আসতে থাকে হুমকি। ওই বছরেই খুন হন পত্রিকার দুই সম্পাদক। তাঁদের কুপিয়ে হত্যা করা হয়। কারণ? এই পত্রিকা নাকি হিংসা ছড়াচ্ছে, যৌনতার বিকৃতি করছে।
বিশ্বের নানা প্রান্তে এই তিনটি ঘটনা ব্যাখ্যা করার কারণ, এখনও পৃথিবীর নানা ‘স্বাধীন’ এবং ‘এগিয়ে থাকা’ দেশ একেবারেই উন্মুক্ত নয় সমকামী এবং রূপান্তরকামীদের নিয়ে। তৃতীয় বিশ্বের কথা ছেড়ে দিলেও প্রথম বিশ্বে নিজের যৌনতার ইচ্ছা প্রকাশ করার জন্যও হেনস্থা হতে হয় অসংখ্য এলজিবিটি মানুষকে।
সংবাদ পাঠ করছেন তাসনুভা - ছবিসূত্রঃ ফেসবুক
সেই জায়গায় বাংলাদেশের এমন উদ্যোগ তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বের ম্যাপকে। এই টেলিভিশন চ্যানেলের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশ, সমাজ ও সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের প্রতি বিশেষ দায়িত্ববোধ থেকে এবং অন্যদের উজ্জীবিত করতে এমন উদ্যোগ নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তাঁদের বার্তা বিভাগ পরিচালনার কর্তৃত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সকল মহিলা সাংবাদিক সহকর্মীদের হাতে। এবার রূপান্তরকামীদের মধ্যে সম্ভাবনাময় ব্যক্তিদের সংবাদ ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যুক্ত করার এহেন সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সমাজব্যবস্থাকে দেখিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা। চ্যানেল কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস, আরও অনেক মানুষকে এগিয়ে আসতে এবং উৎসাহ জোগাতে সাহায্য করবে তাদের সিদ্ধান্ত।
তাসনুভা আনান (শিশির) বাংলাদেশের বেশ জনপ্রিয় মুখ। এতদিন তিনি পেশায় ছিলেন মডেল, অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী। পাশাপাশি তাসনুভা একজন মানবাধিকার কর্মীও। কিন্তু এখনও সমাজের প্রত্যেকটি কোণায় কোণায় যে পরিমাণ কান্না লুকিয়ে আছে, অজস্র শুচিবাই চাপা পড়ে আছে সেসব কি তাসনুভা প্রকাশ্যে আনতে পারবেন? তাঁর মতো অসংখ্য রূপান্তরিত পুরুষ/মহিলা কি নিজেদের অবস্থান স্বকণ্ঠে বলতে পারবেন? নাকি রাষ্ট্র বা পারিপার্শ্বিক সমাজে ঢাকা পড়ে যাবে হাড়হিম করা উল্লাস? আমাদের নজর থাকবে সেদিকেও।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে তাসনুভা জানিয়েছেন তাঁর নতুন কর্মকাণ্ডের কথা। তিনি বলেন, “স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন বা চিরাচরিত প্রথা ভাঙতে পারছি, এটা আমার জন্য একটা বড়ো প্রাপ্তি। আমি বিশ্বাস করি, চাইলে যে কেউ নিজের যোগ্যতায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারে। এখন সবাই ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে ভাববে। আর আমার অনুভূতির কথা যদি বলেন, এটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।”
আজ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসে তাসনুভা এবং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তাসনুভাদের মতো সকল রূপান্তরিত মানুষদের স্যালুট জানাচ্ছে বঙ্গদর্শন।