হেয়ার সাহেবের মৃত্যু ও একটি বিস্মৃত সমাধি

বাড়ির কাছেই আরশি নগর। তবু পড়শির সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় না। ডেভিড হেয়ারের সমাধি প্রসঙ্গে এমন কথাই খাটে। গোলদিঘি মানে এখনকার কলেজ স্কোয়ারে সে সমাধি রয়েছে ঠিকই। কিন্তু কলেজ স্কোয়ার দিয়ে যে অগণিত মানুষের প্রত্যহ চলাচল, তারা ক’জনই বা জানে তা, আর ক’জনই বা চেনে মহামতি ডেভিড হেয়ারকে! অবশ্য এই অচেনার দায় সেই মানুষদের ওপরে বর্তায় না। এ এক গভীরতর বিস্মৃতি। প্রায় অসুখের মতোই।
খুব অল্প সময়ের নোটিশেই মৃত্যু গ্রাস করেছিল ডেভিড হেয়ারকে। ১৮৪২ সালকে এই মৃত্যুর কারণে ‘চিরস্মরণীয় দুর্বৎসর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এদেশে এসে প্রথমে তিনি ঘড়ি বিক্রি ও সারাই ইত্যাদি কাজেই মগ্ন ছিলেন। ঘড়ির কারবারি ডেভিড হেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কীভাবে যেন জড়িয়ে গেলেন সমাজসংস্কারের কাজে। সে কাজে তিনি এতই মগ্ন ছিলেন যে, নিজের ঘড়ির দোকান বিক্রি করে দিয়েছিলেন তাঁর এক বন্ধু গ্রে সাহেবের কাছে। তাঁরা একত্রে থাকতেন ‘কয়লাঘাটের নিকটস্থ’ অঞ্চলে, এখনকার হেয়ার স্ট্রিটে।
৩১শে মে রাত্রি একটায় কলেরার জীবাণু মেলে হেয়ারের শরীরে। ভয়ঙ্কর বমি শুরু হয়ে যায়। ডেভিড হেয়ার নাকি বুঝতেই পেরেছিলেন, মৃত্যু গ্রাস করেছে তাঁকে। বন্ধু গ্রে’কে বলেছিলেন কফিনের ব্যবস্থা করতে। পরের দিন সকালে, ডেভিড হেয়ারের প্রিয় ছাত্র, মেডিকেল কলেজ উত্তীর্ণ ডাক্তার প্রসন্নকুমার মিত্র দেখতে আসেন। কলেরা হলে ব্লিস্টার দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। প্রসন্ন মিত্র ব্লিস্টার দিতে থাকেন ঠিকই। তবে হেয়ার তা নিষেধ করেন। তিনি নাকি বলেছিলেন, “প্রসন্ন! আর ব্লিস্টার দিও না, আমাকে শান্তিতে মরিতে দাও...”।
পয়লা জুন, সন্ধেবেলা হেয়ারের মৃত্যু হয়। গোটা কলকাতা জুড়ে এই খবর ছড়িয়ে পড়লে, গোটা কলকাতাই প্রায় ভেঙে পড়ে তাঁর বাড়িতে। ছোটো বড়ো নানান বয়সের ছেলে জড়ো হয়ে যায়। রাধাকান্ত দেব থেকে শুরু করে কলকাতার শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিতে সেই বাড়ি প্রায় ভেঙে পড়ার জোগাড়। শোনা যায়, সেদিন, অর্থাৎ পয়লা জুন, ১৮৪২ – বাস্তবিকই আকাশ ভেঙে পড়েছিল কলকাতা শহরে। এতগুলো মানুষের অবিরত কান্না, তার মধ্যে প্রবল ঝড় জল বৃষ্টি। এভাবেই হেয়ারের শবযাত্রা। লোকে লোকারণ্য ছিল রাজপথ। বউবাজারের চৌরাস্তা থেকে মাধব দত্তের বাজার পর্যন্ত হাজার হাজার লোক সেই যাত্রায় পা মিলিয়েছিল। কেউ গাড়িতে, কেউ বা পায়ে হেঁটে সঙ্গ দিয়েছিল হেয়ার সাহেবকে। সমস্যা হয়েছিল সেদিন, সমাধি নিয়ে। কোথায় শায়িত হবেন মহামতি হেয়ার। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী তিনি ছিলেন না। তাই, খ্রিস্টিয় কবরস্থানে তাঁর জায়গা হল না। অগত্যা, তাঁরই জমিতে রাখা হল তাঁকে। হিন্দু কলেজের কাছে, গোলদিঘির ধারে- আজও শায়িত তিনি।
ডেভিড হেয়ারের সমাধি
এই সমাধি নিয়েও নাকি বেশ কিছু গোঁড়া হিন্দু পরে সমস্যা করেছিল। বলেছিল, মৃতদেহ পচে নাকি এতই দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, যে সে অঞ্চলে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। গোলদিঘির জলও নাকি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। মামলাও রুজু হয়েছিল কোর্টে। অবশ্য শেষমেশ ডেভিড হেয়ারই জিতেছিলেন।
আরও পড়ুন
গড়িয়ার সঙ্গে জুড়ে আছে চৈতন্যদেবের স্মৃতি
কলকাতা শহরের আজ অনেকটাই বদলে গেছে। আমূল রূপান্তর ঘটেছে শিক্ষাব্যবস্থায়। হেয়ার সাহেবের নাম আজ আর ক’জনই বা মনে রেখেছে। ঠিক যেরকম মুছে গেছে, হেয়ার সাহেবের বাড়ির চিহ্নস্বরূপ শিলাফলকটি। হেয়ার স্ট্রিট ও চার্চ লেনের সংযোগস্থলে নিক্কো ভবনের উত্তর দিকের গেটের পূর্ব দেওয়ালে রয়েছে সেই শিলালিপি –
“In memory of David Hare
On thid site formerly stood
the residence of
DAVID HARE
Born 1775, Died 1842.”
আজকের সাংস্কৃতিক সামাজিক দুঃসময় হয়তো এই হারিয়ে-ফেলা গুলোরই মূল্য দিচ্ছি আমরা। ডেভিড হেয়ারের ভুলে যাওয়া সমাধিটি, বা এই ফলকটি তার সামান্য উদাহরণমাত্র।
ঋণ : ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ - শিবনাথ শাস্ত্রী
‘কীর্তিবাস কলকাতা’- তারাপদ সাঁতরা