‘তোমারি মুখ পানে চাহি’—একই সুর, তিন গানের আশ্চর্য গল্প

‘আমারি গান আঁখিজলে
তোমারি লাগি পলে পলে
ফুটিয়া প্রেম-শতদলে
বিরহে প্রিয় ঝরে যায়।’
‘ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্তর সুরে’ নতজানু প্রেমের এই গান গাইছেন শ্যামল মিত্র। গানের আশ্চর্য কথাগুলির জন্ম দিয়েছিলেন শৈলেন রায়। তারপর, শ্যামল মিত্রর কণ্ঠ ম্যাজিকের বাসা বুনল। আমরা প্রায় সবাই এমনটাই জানি। আমাদের, আমাদের আগের প্রজন্মেরও কৈশোর-যৌবন মাতাল হয়েছিল যে এই গানে। সুমন যতই বলুন ‘ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্তর’ কথা, তাঁর এই একটি গানকে অন্তত বিস্মৃতি ছুঁতেও পারেনি।
অথচ, এই আপাত জানা আর গভীর মুগ্ধতার ভিতরেও দিব্যি চারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অভ্যেস। গানটিকে আঁকড়ে বাঁচলেও আমরা তাই অনেকে মনেও রাখিনি এই গানের এক আশ্চর্য ইতিহাস। জনপ্রিয়তা ঠিক কোন জায়গায় পৌঁছলে একই সুরে তিন-তিনবার রচনা করতে হয় ভিন্ন ভিন্ন গান। কিংবা আসলে একই গান, শুধু বদলে গেছে ভাষার পোশাক। সুরের দেহটি একইভাবে বয়ে গেছে গান থেকে গানে। একই সুরে একাধিক গানের দৃষ্টান্ত খুব যে কম, তা নয়। কিন্তু, হিমাংশু দত্তর এই গান বা গানগুলি তার মধ্যেও নিজবৈশিষ্ট্যেই অতুলনীয়।
কুমিল্লা থেকে এসে মহানির্বাণ রোডে আশ্রয় নেওয়ার পর ততদিনে পাঁচ-ছয় বছর পার করে ফেলেছেন হিমাংশুকুমার দত্ত। পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়িতে রাগসংগীতের বিদ্যালয় থেকে ‘সুরসাগর’ উপাধিতে ভূষিতও হয়েছেন ইতিমধ্যে। নজরুল ইসলাম সেই সময়ে বাংলা গানের সনাতনী ধারাকে নিয়ে ইচ্ছেমতো পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছেন। স্বদেশি গানগুলি ছাড়া রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য গান জনমানসে অতটাও ছড়িয়ে পড়েনি তখনো। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দিলীপকুমার রায় এবং ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘সুরবিতর্ক’ বেশ ঢেউ তুলেছে বাংলার সাংস্কৃতিক সমাজে। এমনই প্রেক্ষাপটে হিমাংশুকুমার নিজেকে প্রস্তুত করছেন সুরকার হিসেবে। গানের গলা ততটাও ভালো নয় তাঁর। কিন্তু, ইচ্ছে তো সুরকার হওয়ার। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের পর শুনছেন ইউরোপীয় সংগীত। তাঁর সুরারোপিত গান গাইছেন স্বয়ং শচীনদেব বর্মন। ‘আলোছায়া দোলা উতলা ফাগুনে’, ‘যদি দখিনা পবন আসিয়া ফিরে গো দ্বারে’, ‘বাজে রিনিকি ঝিনি’র মতো গান জনপ্রিয়ও হচ্ছে। গ্রামাফোন রেকর্ড কোম্পানি থেকে রয়্যালটিও আসছে ভালোই। খ্যাতি ও অর্থ দুইয়েরই স্বাদ পাচ্ছেন হিমাংশু দত্ত।
আরও পড়ুন
বোতলপুরাণ ও এক বিচিত্র বিদূষকের গান
১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি। ইতালির র্যামেলা গানের একটি সুর ভারী কানে ধরল তাঁর। শৈলেন রায়কে দিয়ে একটি গান লিখিয়ে জুড়ে দিলেন সেই সুরের কাঠামোতে। ‘তোমারি পথ পানে চাহি, আমারি পাখি গান গায়/ শিশির-নীরে অবগাহি, কানন পথে ফুল ছায়।’ এরপর রেকর্ডিং-এ গানটি গাইলেন মাধুরী সেনগুপ্ত। গানের সুর যেন ঘোর লাগিয়ে দিল আপামর বাঙালির কানে। এই সুর কেবলমাত্র একটা গানেই শেষ হয়ে যেতে পারে না। আরো গান চাই, একই সুরে। জনপ্রিয়তার দাবি এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে, কয়েক মাসের মধ্যেই হুবহু একই সুরে মনোজ ভট্টাচার্যকে দিয়ে আরেকটি গান লেখালেন হিমাংশুকুমার। নতুন গানে শুরুর তিনটি শব্দ আগের গানের স্মৃতি ধরে রাখতেই যেন প্রায় এক। শুধু 'পথ' হয়েছে 'মুখ'। বাকি গানের ভাষা অবশ্য আলাদা--- ‘তোমারি মুখ পানে চাহি, আমারি আঁখি মুরছায়/ আপন মনে তরীখানি বাহিয়া বেলা বয়ে যায়। সহসা এলে কীগো ভুলে/ কানন ছেয়ে গেল ফুলে/ তোমারি অধরের কূলে কামনা ব্যাকুলিয়া যায়।’
এই গানের কণ্ঠও এক নারীর—চামেলি দেবী। হিমাংশুকুমারেরই ছাত্রী। এই রেকর্ডের জনপ্রিয়তা প্রথম গানটিকেও ছাপিয়ে গেল। এর কৃতিত্ব অবশ্য অনেকাংশেই চামেলি দেবীর অসামান্য কণ্ঠস্বরের। তবে, প্রথম গানের কথাগুলির থেকে দ্বিতীয় গানের আবেদন আরো তীব্র, স্পষ্ট। এক নারীকণ্ঠে গাওয়া গানে ‘তোমারি অধরের কূলে কামনা ব্যাকুলিয়া যায়’-এর মতো সাহসী উচ্চারণ যে কেমন প্লাবন সৃষ্টি করতে পারে, বলাই বাহুল্য।
একই সুরে দু’দুটি গান। তারপরেও সুরের ঘোর কাটতে চায় না। ‘স্বামী-স্ত্রী’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন হিমাংশুকুমার। পরিচালক-প্রযোজক উভয়ের দিক থেকেই অনুরোধ আসতে লাগল ‘তোমারি পথ পানে চাহি’র সুরে এই ছবিতেও একটা গান রাখতেই হবে। গানের সুরের জনপ্রিয়তা এই অনুরোধ থেকেই স্পষ্ট। আমাদের সংগীত-কেন্দ্রিক ম্যানিয়ার ইতিহাস তো আমরা লিখে রাখিনি কোথাও। হয়তো বাড়াবাড়ি হবে ভেবে কুণ্ঠিত হয়েছি। কিংবা কলের গান নিয়ে তখনো অন্তঃপুরে এক ধরনের নাক সিঁটকানো ছিল বলেই হয়তো জনপ্রিয় গান নিয়ে সচেতন চর্চার কথা বিশেষ মাথায় আসেনি। কিন্তু, সেই ইতিহাস থাকলে বোঝা যেত, ঠিক কোন রসায়নে দু’দুবার দু’দুটি গানে ব্যবহৃত পুরনো সুরকে ফের চলচ্চিত্রে ব্যবহার করতে বলেন পরিচালক! নিশ্চিত দাবি জোড়েন—এই গান শোনার চাহিদাতেই সিনেমা দেখতে ঢল নামবে! একে উন্মাদনা বললে খুব অত্যূক্তি হবে?
আরও পড়ুন
মনে মানবেন্দ্র
সে যাহোক, এমন অনুরোধ ‘এড়ানো কঠিন বড়’। অতএব, হিমাংশুকুমার অনুরোধ করলেন বন্ধু অজয় ভট্টাচার্যকে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই লেখা হয়ে গেল নতুন গান—‘বনের কুহুকেকা সনে/ মনের বেণুবীণা গায়/ দখিনা মধু সমীরণে। অধরা ধরা দিতে চায়/ সহসা এলে যে গো ভুলে/ কানন ছেয়ে গেল ফুলে/ মুকুল মৃদু আঁখি তুলে/ জাগিল সুখ বেদনায়।।’ এবারের গানটি ডুয়েট। নারীকণ্ঠ ছায়াদেবীর। ভারী নরম, ভারী সুন্দর গেয়েছিলেন তিনি এই গান। সঙ্গে অজ্ঞাত এক পুরুষকণ্ঠ। সিনেমায় ব্যবহারের জন্যেই কিনা কে জানে, এই গানটির রেকর্ডের কাটতি আগের দুবারের রেকর্ডকেও ছাপিয়ে গেল।
বিস্ময়ই বটে। কে জানে, হিমাংশুকুমার কীভাবে নিয়েছিলেন গোটা বিষয়টা। এক গর্বিত স্রষ্টা হয়তো পরম তৃপ্তিতে দেখেছিলেন তাঁর সুরারোপিত গান নিয়ে মানুষের পাগলামো। আবার, একটাই গান নিয়ে এহেন মুগ্ধতা তাঁর সুরারোপিত অন্যান্য গানের জনপ্রিয়তায় থাবা বসিয়েছিল নিঃসন্দেহে। পরের সুরগুলি আর কিছুতেই ছাপিয়ে যেতে পারছিল না আগের সুরটিকে। তাই বারবার, দাবি উঠছিল একই সুর ফিরিয়ে আনার। গানের জগতে একটা মাইলস্টোন যেন নিজের অজান্তেই নির্মাণ করছিল স্রষ্টার অন্যান্য গানের বিস্মৃতির ভবিতব্যকে।
বেশ কিছুদিন পরে, গানটি ফের গাইলেন শ্যামল মিত্র। আর গাইলেন শৈলেন রায়ের লেখা একদম প্রথম গানটিই--- 'তোমারি পথ পানে চাহি'। ইতিহাসের নড়চড় হয়নি বিশেষ। শ্যামল মিত্রর গাওয়া গানটি জনপ্রিয়তায় আগের গানগুলিকেও ছাপিয়ে গেল। এই গানের ক্ষেত্রে যেটা হয়ে এসেছে বারবার।
ঋণঃ চাঁদ-চামেলি উপাখ্যান, অশোক মিত্র
প্রচ্ছদের ছবিঃ সুব্রত চৌধুরী (‘বাংলা গান অদীন ভুবন’ বই থেকে)