No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    তোমাকে চাই -একটি প্রজন্মের আত্মকথা

    তোমাকে চাই -একটি প্রজন্মের আত্মকথা

    Story image

    কাল তেইশে এপ্রিল। উনিশ শো বিরানব্বই সালের তেইশে এপ্রিল কী কী ঘটেছিল? আমরা আন্তর্জাতিক স্তরে কী কী ঘটেছে এসব নিয়ে ভাবনা মুলতুবি রাখি। একটু ভেবে দেখি বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিসরে এই দিনটি কেন গুরুত্বপূর্ণ? উত্তর ঔপনিবেশিক বাঙালির আইকন সত্যজিৎ রায় এইদিন প্রয়াত হন, কয়েক দশক জুড়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক গরিমা যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। ঋত্বিক ঘটক, যাকে বাঙালির আত্মস্থ করতে আরও একটা শতাব্দী লেগে যাবে, যদি ততদিন বাঙালি টিকে যায়, সেই তিনি মারা গিয়েছিলেন আগেই, কবির ভাষায় স্পর্ধা গিয়ে বিনয় আসার সূত্রপাত ঘটল বাংলার সাংস্কৃতিক যাপনে। 'যুক্তি তক্কো' এবং 'গপ্পো'-র সাংস্কৃতিক অভ্যাস মুছে যাচ্ছিল। বাংলা গানও তার তথাকথিত স্বর্ণযুগ পেরিয়ে তখন এক বিচিত্র পাথরের দেওয়ালের সম্মুখীন। রবীন্দ্রনাথের পরের বাংলা গান তখন পেরিয়ে এসেছে নিউ থিয়েটার্স, কমল দাশগুপ্ত, হিমাংশু দত্ত অখিলবন্ধু ঘোষকে, আইপিটিএ আন্দোলনকে, হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে, সলিল চৌধুরীকে, সুধীন দাশগুপ্ত নচিকেতা ঘোষকে, শ্যামল মিত্রকে, এবং 'মহীনের ঘোড়াগুলি'-র অভ্যুত্থানকে। তারপর বাংলা গান যখন শ্যাওলা পড়ে যাওয়া প্রায় ধ্বংসাবশেষে মুষড়ে পড়েছে, তখন, আশির দশকের শেষের দিকে একটি অ্যালবাম বেরোয়। তখন চল ছিল ক্যাসেটের। ক্যাসেটটির নাম 'অন্য কথা অন্য গান'। অল্পশ্রুত এই ক্যাসেটটির স্রষ্টা ছিল 'নাগরিক', যার পুরোভাগে ছিলেন এক ব্যক্তি, যিনি প্রবাসে সাংবাদিকতা করেছেন বহুদিন,  ঘুরে এসেছেন নিকারগুয়ার বধ্যভূমি থেকে, যার চেতনায় রয়েছেন লালন, রয়েছেন জয়দেব, রয়েছেন রামপ্রসাদ। রয়েছেন শ্যামল মিত্র হিমাংশু দত্ত। রয়েছেন সলিল। রয়েছেন ডিলান পীট সীগার লেওনার্ড কোহেন উলফ বিয়ারম্যান। এই মধ্যবয়সী সুদর্শন ব্যক্তির ব্লু জিনসের ডেনিম শার্ট পরে গীটার হাতে বসে থাকা একটি আলোকিত ছবি, প্রেক্ষাপটে তুমুল অন্ধকার, এই ছবিটিই বাংলা গানের গতিপথ পাল্টে দিল। কবীর সুমন। তখন সুমন চট্টোপাধ্যায়। ওই ছবিটি ছিল একটি ক্যাসেটের প্রচ্ছদ। উনিশ শো বিরানব্বই সালের তেইশে এপ্রিল যে ক্যাসেটটি সূর্যের আলো দেখেছিল, ক্যাসেটটির নাম 'তোমাকে চাই'। অন্ধকারের নিষ্ক্রিয়তার দায় নিয়ে আলোর দিশারী হয়ে ওঠা একটি ক্যাসেট, ছবিটি যেন তারই চিহ্ন। নবারুণ ভট্টাচার্য বলেছিলেন এই ক্যাসেট টি বাংলা সংস্কৃতির 'প্যারাডাইম শিফট'। এই শব্দটি টমাস কুন ব্যবহার করেছিলেন বৈজ্ঞানিক ভাবনা বদলের এলাকায়। শুধুই তো গান নয়, সাংস্কৃতিক চেতনা, একটা প্রজন্মের চেতনা নির্মাণ করেছে এই ক্যাসেটের দুটো পিঠ।

    এবার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসা যাক। 'সুমনের গান' শীর্ষক একটি সন্দর্ভের সঙ্গে বহুদিনের পরিচয় আমার। অনেক ছোটবেলায় লালন মঞ্চে দেখা একটি অনুষ্ঠান, তখনও বোধ জাগরুক নয়, তবুও স্মৃতিতে একটা আলগা ছবি ভাসে। মনে আছে শ্রোতারা ভেসে যাচ্ছিল অবারিত সুরের জ্যোৎস্নায়। মনে আছে বাবার মুখে শোনা নব্বইয়ের গোড়ার দিকের একক অনুষ্ঠানগুলোর উদ্দাম স্মৃতি। বঙ্গাব্দের সময়ের অনুষ্ঠানের স্মৃতি। কানোরিয়া জুটমিলের আন্দোলনে সুমনের সরব অংশগ্রহণের স্মৃতি। অনীতা দেওয়ানের নারকীয় ঘটনা প্রথম জানতে পারা এবং জানতে পেরে লজ্জিত হওয়া তো 'সুমনের গান'-এর সূত্রেই। 'সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান' বলে একটি কালো চটি বই, স্বতন্ত্র প্রকাশনীর। বইটির প্রথম পাতায় সই করা ছিল নাম। তখন ক্লাস টেন। স্কুলে যাওয়ার পরিমাণ কম। ততদিনে ঘটে গেছে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম। ক্লাস টেনের বছরে ঘটল লালগড়। গড়বেতা, কেশপুর এই জায়গাগুলোর নাম উঠে আসছে। গ্রামবাংলার হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো নামগুলো নিয়ে নাগরিক পরিসরে মেমরি গেম খেলার আবহ তৈরি হচ্ছে। একটু পুরনো হয়ে যাওয়া ক্যাসেটগুলো তো তখনই শোনা। টেপরেকর্ডারে বাজত ক্যাসেটগুলো। অঙ্ক কষতে কষতে আমি শুনতাম। সেই উত্তাপের আবহেই 'বসে আঁকো', 'ইচ্ছে হল, 'জাতিস্মর' ,'ছোট বড় মিলে', 'পাগলা সানাই', 'নিষিদ্ধ ইস্তেহার' এই ক্যাসেটগুলো খুঁজে পাওয়া আলমারির অন্দরমহল থেকে। 'গানওলা', 'ঘুমোও বাউন্ডুলে' এইগুলো ছিল না বাড়িতে। ক্যাসেটের ওপরের প্রচ্ছদগুলোও তখন মুখস্থ। 'ইচ্ছে হল'-তে খাঁচাবন্দী কাক এবং জানলার ছবি, 'জাতিস্মর'-এ রয়েছে চার্মস ব্র্যান্ডের সিগারেটের বিজ্ঞাপন। এরকম।

    অঙ্ক কষতে কষতেই শোনা 'তোমাকে চাই'-এর সবকটা গান। উচ্চারণের দৃঢ়তায় যে কথাগুলো কানে আসত খাতার পেছনে লিখে রাখতাম, পরে বেসুরো গলায় গানগুলো গাওয়ার বেয়াদবি চেষ্টার স্বার্থে। সুরের আঙ্গিকে নাগরিক স্বরের সন্ধান করতে করতেই চিনতাম নব্বইয়ের ওই সময়টাকে। ভেবে দেখার মতন তখন সোভিয়েত ভেঙেছে। আন্তর্জাতিকতামনস্ক বাঙালির বহুদিনের লালিত স্বপ্ন এই সোভিয়েতকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙালি বৈদগ্ধ্যের সিংহভাগ নির্মাণ করছিল বামপন্থা। সোভিয়েত ভাঙল, সোভিয়েত দেশ পত্রিকা বন্ধ হল। গ্যাট চুক্তি সাক্ষর হয়ে গ্লোবাল বাজার ঢুকে পড়ল দেশে। নয়া উদারনীতির হাওয়াতে বাঙালি মধ্যবিত্তের বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার দূর্গ কাঁপছিল হাওয়ায়, বালির বাঁধের মতন, 'বিপজ্জনক বাড়ি'-র মতন। বাজারী রুচিহীন সংস্কৃতির বিপ্রতীপে যে সংস্কৃতিবোধকে খাড়া করা হচ্ছিল মধ্যমেধাই সেখানে রাজা হয়ে বসছিল। সুমন এইসময়ের ত্রাণকর্তা। অন্তত প্রজন্মের একটা অংশের কাছে। বব ডিলানের গানের লাইন ছিল 'দ্য টাইমস দে আর চেঞ্জিং'। এইসময় টা বদলাচ্ছিল ভেতর থেকে, ক্রমশ বোমার মতন নিউক্লিয়ার হয়ে উঠছিল সমাজ, বিচ্ছিন্ন। সুমন এইসময় যৌথতার কথা বলেছেন, ভালবাসার কথা বলেছেন। গান বেঁধেছেন সৈনিকের মতন। সুমন ঐতিহাসিক প্রতিভা, অসামান্য জিনিয়াস। কিন্তু তিনি সময়োত্তীর্ণ নন, যুগন্ধর নন। তার সময়কে বাদ দিয়ে সুমনকে পাঠ করা উচিত নয়।

    'তোমাকে চাই' গানটি প্রথম যখন শুনেছিলাম তখন মনে হয়েছিল, ''নাগরিক ক্লান্তিতে তোমাকে চাই''-এ আদতে এক মহাজীবনের উচ্চারণ। যে উচ্চারণ থেকেই আদতে বলে ওঠা, "আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর/তোমাকে শুনিয়ে আমি যাব বহুদূর"। পণ্যায়নের সময়, বিচ্ছিন্নতার সময় এ এক সমষ্টির স্বরলিপি। আগামীর আহ্বান। 'আগামী' শব্দটি কতবার এসেছে সুমনের গানে। বার্গম্যানের 'দ্য সেভেন্থ সীল'-এর সঙ্গে অনেকে মিলিয়েছিলেন 'পাগল' গানটিকে। "সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে"-এই স্পর্ধা আদতে 'পাগল'-এরই থাকে। মিশেল ফুকো যে পাগলামিকে রেখেছিলেন সভ্যতার বিপ্রতীপে। 'তিনতালের গান' কেন স্লোগানধর্মী রাজনৈতিক গানের ঐতিহ্যে এক অন্তর্ঘাত তা বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। গানটির শরীরের মধ্যেই সেই অভিনবত্ব লোকানো। মজার বিষয় সুমন কিন্তু সমষ্টিকে ডাক দিচ্ছেন ব্যক্তিক অবস্থান থেকে। "আমাকে না আমার আপোষ কিনছ তুমি/বল কে জিতল তবে জন্মভূমি জন্মভূমি", "বেচি দিন পাল্টে দেওয়ার গানের জবান/কোনোদিন হয়তো অন্য আর কোনো গান/টাকাডুম টাকডুমাডুম নিয়ম ছেড়ে/মানুষের জন্য সুদিন আনবে কেড়ে"-এই ভাষ্য ব্যক্তির, বিশ্বব্যাপী বাজার সংস্কৃতির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রতিস্পর্ধী নাগরিকের, যে বলে "আশা নিয়ে ঘর করি/আশায় পকেট ভরি"। যে 'বাকি দু আনা' পেয়ে যাওয়ার আশা রাখে। যে বলে "ছুটবে কোথায় প্রেম তালকানা/গোপনীয়তার নেই মালিকানা"।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @