No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ৭৫তম বার্লিনে তিলোত্তমা সোম অভিনীত ‘বাক্স বন্দি’ : একজন শ্রমজীবী মহিলার প্রেমের গল্প

    ৭৫তম বার্লিনে তিলোত্তমা সোম অভিনীত ‘বাক্স বন্দি’ : একজন শ্রমজীবী মহিলার প্রেমের গল্প

    Story image

    বার্লিন আর বাঙালির সম্পর্ক আজকের নয়। ১৯৮৪ সাল। বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (Berlin International Film Festival) প্রদর্শিত হয়েছিল এক বাঙালি চলচ্চিত্রকারের ছবি। সত্যজিৎ রায়ের ঘরে-বাইরে। ওই একই বছর বার্লিনের প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয়েছিল আরও একটি বাংলা ছবি। ভোম্বল সর্দার। পরিচালক নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়। তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। বিশ্বজুড়ে সিনেমার আবেদন, ভাষা বদলেছে। এসেছে নতুন প্রজন্ম। ভারত তথা বাংলা থেকে তরুণ প্রজন্মের একাধিক পরিচালকের ছবি বার্লিন গেছে। বছর দুই আগেই, ২০২৩-এ ৭৩তম বার্লিনের প্যানোরোমা বিভাগে মনোনীত ও প্রদর্শিত হয়েছিল কলকাতার মেয়ে শ্রীময়ী সিংহ-পরিচালিত তথ্যচিত্র ‘অ্যান্ড, টুওয়ার্ডস হ্যাপি অ্যালিস’। দু-বছরের মধ্যে ফের বার্লিনে পাড়ি দিল আরেক বঙ্গ-তনয়ার সহ-পরিচালিত ও সম্পাদিত ছবি। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি, ৭৫তম বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (75th berlinale)-এর নব-সংযোজিত ‘আউটস্যান্ডিং ডেবিউ ফিচার’ (Outstanding Debut Feature) বিভাগে প্রদর্শিত হলো তনুশ্রী দাস এবং সৌম্যানন্দ সাহির যুগ্মপরিচালনায় বাস্ক বন্দি তথা শ্যাডো বক্স (Shadow box)।

    বাক্স বন্দি সেইসব শিরোনামহীন, বিনোদনহীন প্রেমের গল্পগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে, যেগুলো আমাদের চোখে পড়ে না, আগ্রহ জন্মায় না। বিশেষ ভাবে দেখলে স্পষ্ট হয়, সমাজ ও মনের নানা দিক।

    প্রায় বছর পনেরো আগে, পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে দেখা তনুশ্রী-সৌম্যানন্দর। সিনেমা বানাতে গিয়েই বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম-দাম্পত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর হওয়ার পর, তনুশ্রী বেশ কিছুদিন থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১১ সালে, পুনে থেকে চলচ্চিত্র সম্পাদনায় ডিপ্লোমা সহ স্নাতক হন। সম্পাদক হিসাবে সারা বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রসংশিত হয়েছেন একাধিকবার। সহ-পরিচালনা তো বটেই, এ ছবি সম্পাদনাও করেছেন তনুশ্রী। সৌম্যানন্দও একাধিক ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি এ ছবির সহ-পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সিনেমাটোগ্রাফার ও সহ-প্রযোজক। দিল্লির সেন্ট স্টিফেনস কলেজে দর্শন নিয়ে পড়াশোনা। তারপর, পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে সিনেমাটোগ্রাফি। সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে একাধিক ছবির জন্য কান, বার্লিন, সানড্যান্স, লোকার্নো, রটারডামের মতো চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছেন। তাঁর সাম্প্রতিকতম কাজের মধ্যে রয়েছে অস্কার-মনোনীত ‘অল দ্যাট ব্রিদস’ এবং নেটফ্লিক্স সিরিজ ‘ব্ল্যাক ওয়ারেন্ট’। এবার, বাক্স বন্দি-র মধ্যে দিয়ে একসঙ্গে পরিচালনা জগতে পা রাখলেন তনুশ্রী এবং সৌম্যানন্দ।

    বাক্স বন্দি সেইসব শিরোনামহীন, বিনোদনহীন প্রেমের গল্পগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে, যেগুলো আমাদের চোখে পড়ে না, আগ্রহ জন্মায় না। এর স্তরে স্তরে জমে থাকে আবর্জনা, অশান্তি, অবসাদ, জীবনসংগ্রাম। বিশেষ ভাবে দেখলে স্পষ্ট হয়, সমাজ ও মনের নানা দিক। বাসে, লোকাল ট্রেনের লেডিস কামরায়, পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, ঘরের কাজে নিত্য যাঁদের দেখি, যাঁরা মহিলা হওয়ার আলাদা কোনও সুযোগ-সুবিধা না নিয়েই অক্লান্ত শ্রম দিয়ে যান। পুষ্টিকর খাবার, সুচিকিৎসা, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ভালো জীবনযাপন - তাঁরা যেন সব ভালো কিছুর থেকে বঞ্চিত হতেই জন্মেছেন! তাঁরা জানেন না সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েত কাদের বলে, শ্রেণিবিভাজন কী। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের তোয়াক্কা না করেই পৃথিবীর ল্যাব্রিন্থে টিকে থাকার লড়াই জারি রাখে। এমন অবধারিত দুঃস্বপ্নের মধ্যেই এঁদের মধ্যে অনেকে স্বপ্ন দেখে, ভালোবাসে। এ ছবিতে মায়া (তিলোত্তমা সোম) তেমনই একজন।

    তনুশ্রী'র কথায় “বাক্স বন্দি, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একটা প্রেমের গল্প। মায়ার গল্প। ভিন্ন সংস্কৃতিতে বিয়ে করে একঘরে হয়ে যাওয়া, সামাজিক অপমানকে উপেক্ষা করে এক শ্রমজীবী মহিলার দৈনন্দিন লড়াই, একা হাতে পরিবারকে সামলানোর গল্প। ৭৫তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের নতুন বিভাগে আমাদের ছবি মনোনীত হয়েছে, এটা ছবির সঙ্গে জড়িত সকলের কাছেই অপরিসীম আনন্দ ও সম্মানের।” 

    চন্দন বিশ্ত, তিলোত্তমা সোম, তনুশ্রী দাস এবং সৌম্যানন্দ সাহি (বাঁদিক থেকে)

    এ ছবি অবসাদ সম্বন্ধে সামাজিক ট্যাবু, অসচেতনতা নিয়ে কথা বলেছে। শুটিং চলাকালীন বারবারই বদলাতে থেকেছে ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ। রশদ জুগিয়েছে সমকালীন পরিবেশ, মানুষ।

    ধূলিধূসর এক শহরতলিতে জীবনসঙ্গী সুন্দর (চন্দন বিশ্ত) আর স্কুলপড়ুয়া ছেলে দেবু’কে (সায়ন কর্মকার) নিয়ে মায়ার সংসার। বাড়ির অমতে, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে বিয়ে করার জন্য পরিজনেরা সম্পর্ক রাখে না তার সঙ্গে। সংসার সামলাতে একাধিক কাজ করতে হয় তাকে। একাধারে গৃহপরিচারিকা, চিকেন ফার্মের কর্মী ও জামাকাপড় ইস্ত্রি’র কাজ। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সাইকেলে চেপে বেরিয়ে পড়ে সে। অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মী সুন্দর, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD)-এ আক্রান্ত। সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষামূলক কাজের জন্যে ব্যাঙ জোগাড় করে দেয় সে। এহেন পেশার জন্য প্রতিবেশীদের কাছে সে হাসির পাত্র। একদিন রাতে হঠাৎ-ই হারিয়ে যায় সুন্দর। কিছুদিন পরে একটা খুনের ঘটনায় সন্দেহভাজনদের তালিকায় তার খোঁজ মেলে। পুলিশের পাশাপাশি তাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে মায়া। একদিন  ক্ষুধার্ত এবং আতঙ্কিত অবস্থায় গোপনে বাড়ি ফেরে সুন্দর। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নের মুখে পড়ে তাদের দাম্পত্য, পারিবারিক যৌথতা। হাল ছাড়ে না মায়া… এতদিনের শ্রমে-ভালোবাসায় গড়ে তোলা এক চিলতে সংসার ফিরে পেতে চায়।

    এ ছবি অবসাদ সম্বন্ধে সামাজিক ট্যাবু, অসচেতনতা নিয়ে কথা বলেছে। মানসিক অবসাদ নিয়ে অনেক সচেতন মানুষই সচেতন নন। শ্যুটিং চলাকালীন বারবারই বদলাতে থেকেছে ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ। রশদ জুগিয়েছে সমকালীন পরিবেশ, মানুষ। সিনেমার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকেই একাধিক ভূমিকা পালন করেছেন। “শ্যুটিংয়ের সময় তনুশ্রীর ফ্ল্যাটে আমাদের রান্না করে খাওয়াতেন যে মহিলা, ওঁর জীবনের সঙ্গেও কীভাবে যেন জুড়ে গেছিলাম আমরা। এমনকি ওঁর পারিবারিক অশান্তি মেটানোর চেষ্টা করেছি।” বঙ্গদর্শন.কম-কে বলছিলেন এই সিনেমার কাস্টিং-ডিরেক্টর ও অন্যতম অভিনেতা সুমন সাহা। 

    “প্রথমে ঠিক হয়েছিল পুরুলিয়াতে শ্যুটিং হবে, পরে চিত্রনাট্যের চাহিদা অনুযায়ী ঠিকঠাক একটা মফস্বল খুঁজছিলাম আমরা। শ্যুটিংয়ের জন্য আমি, সৌম্যানন্দ আর তনুশ্রী প্রায় এক বছর আগে থেকে ব্যারাকপুর, পলতা, টিটাগড় অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছি। বেশিরভাগ শ্যুটিং হয়েছে ব্যারাকপুরে।” বলেন সুমন।

    সুমন আরও জানালেন, “আমার আর তনুশ্রী’র জন্য যেটা সব থেকে চ্যালেঞ্জিং ছিল, সেটা হল তিলোত্তমার ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করা সায়ন কর্মকারকে তৈরি করা। তখন ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠেছে সদ্য। ছেলেটি যোগা-এক্সপার্ট। বাড়ি ব্যান্ডেল অঞ্চলে। অভিনয় নিয়ে কোনওরকম জ্ঞান ছিল না ওর বা ওর পরিবারের কারোর। প্রায় ছ’মাস ধরে ওকে প্রশিক্ষণ দিই। শ্যুটিংয়ের সময় ওর মাথায় একটা বিষয় খুব ভালো ভাবে গেঁথে দিয়েছিলাম আমরা, যে টিভির সিরিয়ালে যেমন দেখো, ওরকম অভিনয় চাই না আমাদের। সেটা ও অমান্য করেনি। আসলে একটা সুবিধা ছিল যে, অভিনয় নিয়ে আগে থেকে ওর কোনও সচেতনতা ছিল না। ও জানতো না তিলোত্তমা-কে বা তনুশ্রী-কে। এই সিনেমার জন্য ওয়ার্কশপ করিয়েছিলেন অনামিকা হাসকার। সেখানে ওর প্রতিক্রিয়া দেখে আমরা অবাক হয়ে গেছিলাম।”

    মোট ১৭ জনের সহ-প্রযোজনায় তৈরি হয়েছে এই ছবি। প্রযোজনা করেছেন নরেন চন্দভারকর (মুনউইভ ফিল্মস), শৌনক সেন এবং আমান মান (কিটারবিট ফিল্মস), সৌম্যানন্দ সাহি-জিম সারাভ (ওয়ান্ডারফুল এন্টারটেইনমেন্ট), বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে (আন্দোলন ফিল্মস), নিখিল আদবানি (সুমিত্রা গুপ্তা ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টস), তিলোত্তমা সোম, ধীর মোমায়া (জুগাড় মোশন পিকচার্স), সিদ্ধার্থ মীর (ব্রিজ পোস্টওয়ার্কস), ডমিনিক ওয়েলিনস্কি-ইসাবেল গ্লাচ্যান্ট (শাশা অ্যান্ড কোং), প্রশান্ত নায়ার (নোমাড মিডিয়া অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট), অঞ্জলি পাতিল (অনাহত ফিল্মস), অনু রাঙ্গাচার (গ্র্যাটিটিউট ফিল্মস), ইশান চন্দক (ক্রিস ক্রস কন্টেন্ট), এবং শ্রুতি গাঙ্গুলী (honto88)।

    বার্লিনে বাক্স বন্দি-র গ্র‍্যান্ড প্রিমিয়ার হয়েছে ১৬ ফেব্রুয়ারি। এছাড়াও উৎসবের তিন দিন আলাদা আলাদা থিয়েটারে প্রদর্শিত হবে এই ছবি। বার্লিনের পর্ব মিটলে দেশ-বিদেশের অন্যান্য চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতেও পাঠানো হবে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @