বাংলা জুড়ে বাঘেদের অসংখ্য দেবদেবী, তারা নিজেদের মধ্যে ভয়ংকর লড়াই করেন

পৃথিবীর সব প্রাচীন সংস্কৃতিতেই বনের গাছপালা আর জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করার, ভালোবাসার কথা বলা আছে। তাই, কত নামের কত রূপের নানান বনদেবতা, বনদেবীর গল্প প্রচলিত আছে দেশে দেশে। জঙ্গলে গিয়ে মানুষ কোনো বিপদে পড়লে সেই দেবদেবীরা তাদের রক্ষা করবেন, এরকম বিশ্বাসও গড়ে উঠেছে। কখনো দেখা যায়, কোনো বিশেষ জন্তু-জানোয়ারের নিজস্ব দেবতার কথাও বলে থাকেন সেই সব মানুষেরা, জঙ্গলের সঙ্গে যাদের নিবিড় যোগ। এর মধ্যে কোথাও লুকিয়ে আছে টোটেমপুজো, কোথাও বা অন্য কোনো বিশ্বাস।
আদিকাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের জঙ্গলে জঙ্গলে বাঘের আস্তানা। বাংলার নিজস্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগার তো বিশ্বখ্যাত। এক সময়ে গোটা বাংলা ছিল অরণ্যসংকুল। সুন্দরবন ছাড়াও উত্তরবঙ্গ, ছোটোনাগপুর এবং বাংলার নানা প্রান্তে বাঘেরা রাজকীয় মহিমায় দাপিয়ে বেড়াত। এখন যন্ত্রসভ্যতার বিস্তার ঘটায় বাংলার জঙ্গলগুলোতে বাঘের আনাগোনা অনেক কমে গেছে। সুন্দরবনেও বাঘের সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে।
সে যাই হোক, যে দেশে বাঘের এত রমরমা, সেখানে বাঘের দেবদেবীরা থাকবেন না, তা অসম্ভব। সুন্দরবন দিয়েই শুরু করা যাক। এখানে বাঘের দেবদেবীদের মধ্যে সবথেকে বেশি আলোচিত দক্ষিণ রায়, বনবিবি এবং বড়খাঁ গাজি। দক্ষিণরায়কে মনে করা হয় বাঘেদের রাজা। তিনি বসে থাকেন বাঘের ওপর। যোদ্ধাদের মতো তাঁর বেশ। কুমিরদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কালুরায়ের পুজো করা হয়। বনবিবিকেও সুন্দরবনের মানুষ শ্রদ্ধাভরে বন্দনা করেন। হিন্দুদের কাছে তিনি বনদুর্গা, বনচণ্ডী ইত্যাদি নামেও পরিচিত। মুসলমানরা তাঁকে পিরানি মনে করেন। লোকের বিশ্বাস, বনবিবি আদতে আরব দেশের মেয়ে। এছাড়া পির বড়খাঁ গাজিকেও মনে করা হয় ব্যাঘ্রকুলের অধিষ্ঠাতা। দক্ষিণরায়, বনবিবি আর বড়খাঁ গাজির পারস্পরিক যুদ্ধ নিয়ে অনেক গল্প চালু আছে। কবি কৃষ্ণরাম দাসের ‘রায়মঙ্গল’-এ পাওয়া যায় দক্ষিণরায় আর বড়খা গাজির ভয়ংকর লড়াইয়ের গল্প। তবে, দক্ষিণবঙ্গের মানুষ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এঁদের সবাইকে পুজো করে থাকেন।
এই দক্ষিণরায়কে সুন্দরবনের মুসলমানরা কখনো কখনো কালু গাজি বা পির গোরাচাঁদ নামেও ডেকে থাকেন। উত্তরবঙ্গের মুসলমানরা তাঁকে সোনা গাজি বলেন মাঝেমধ্যে। আবার উত্তরবঙ্গের হিন্দু-মুসলমান সবাই দক্ষিণরায়কে সোনারায় নামে বন্দনা করেন। সোনারায়ের বাহন বাঘ। তিনি মালোকোচা ধুতি পরে থাকেন। পাশাপাশি, রাজবংশীদের উপাস্য কুমিরদেব, মেছদের হাগড়ামাড়াই, কোচবিহারে ডংধরা, ডুয়ার্সে বীরবাঘ, জলপাইগুড়িতে মহারাজা ঠাকুরের মতো বাঘ দেবতার অসংখ্য নাম।এছাড়া আছেন কোচবিহারে বাঘের দেবী ভাণ্ডারী, ময়মনসিংহে বিপদনাশিনী, কাঠুরেদের শলেশ্বরী।
সাঁওতালরা বাঘের দেবতাকে সীমা সাড়ে অথবা গোঠসীম নামে ডেকে থাকেন। বীরভূমে বাঘরাই চণ্ডীর পুজো হয়। মধ্য বাংলায় প্রচলিত আছে বাঘরায়ের পুজো। লোকে মনে করে, তিনি দক্ষিণরায়েরই আরেক রূপ। বাংলার পশ্চিম অঞ্চলেও বাঘরায়ের উপাসনা দেখা যায়। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের মতো জেলাগুলিতে বাঘের দেবতা বাঘুত খুব জনপ্রিয়। বাঘুত পূজিত হন বিহার এবং ওড়িশাতেও। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে বাঘের দেবতাকে শালপিন নামে পুজো করেন সাধারণ মানুষ।
বাংলার নানা জায়গায় বাঘের এত দেবদেবী, এরা সবাই লোকসংস্কৃতির অঙ্গ। এঁরা কেউ পৌরাণিক দেবতা নন, সবাই লোকদেবতা বা লোকদেবী। সম্প্রীতির বাংলায় হিন্দু-মুসলমান-আদিবাসী নির্বিশেষে সব মানুষ এঁদের বন্দনা করেন। জেলায় জেলায় গ্রামীণ মানুষের ছবি, গান, নাটক এবং অন্যান্য শিল্পেও উঠে এসেছেন বাঘ এবং বাঘের দেবদেবীরা।
তথ্যঋণ – মিহির চৌধুরী কামিল্যা, দেবব্রত নস্কর, আহাদ হায়দার।