জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একদৌড়ে পরেশনাথ পাহাড়ে তিন-তিনবার ওঠা-নামা

ব্রিটেনে ‘থ্রি পিক চ্যালেঞ্জ’ নামে এক জনপ্রিয় প্রতিযোগিতা হয়। যেখানে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ওয়ালসের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ছুঁতে হয়। শৃঙ্গগুলো মোটামুটি দৌড়েই ওঠা যায়, উচ্চতাও ৯০০-১৫০০ মিটারের মধ্যে। তবে, শৃঙ্গগুলো প্রায় ২৫০-৩০০ কিমি দূরে দূরে অবস্থিত, তাই মাঝের অংশগুলোতে গাড়ি নিজেকেই চালিয়ে যেতে হয়। আমরাও প্ল্যান করলাম এ’রকম কিছু।
কলকাতার কাছাকাছি পাহাড়ে দৌড়, যাকে বলে ট্রেল রানিং-এর খুব বেশি সুযোগ নেই। তাই কলকাতার সবচেয়ে কাছে নতুন ট্রেল রানিং-এর রাস্তা খুঁজতে ‘দ্য আলট্রা হিমালয়ানস’-এর বন্ধুবান্ধবরা মিলে চলে গেলাম এবার পরেশনাথ পাহাড়ে। টিমে আমি ছাড়াও ছিল শংকরদা, দেবাঞ্জনদা এবং অর্পিতাদি।
মার্চের শুরুতেই, মোটামুটি গরম পড়তে শুরু করে দিয়েছে। আমরা কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করলাম রাত ১২টার দিকে। চারচাকার ছোটো গাড়ি দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে বেয়ে ছোটাচ্ছিল দেবাঞ্জনদাই। ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম ঝাড়খণ্ডে। ধানবাদ পেরিয়ে যখন নিমিয়াঘাট পৌছলাম, তখন সবে ভোরের আলো ফুটেছে।
আরো পড়ুন
একদৌড়ে সান্দাকফু মাত্র পৌনে ছ’ঘন্টায়
নিমিয়াঘাটের দূরত্ব কলকাতা থেকে প্রায় ৩৫০ কিমি। সাধারণত এই দিক দিয়ে কেউ পরেশনাথ পাহাড়ে ওঠে না, পুরোটাই জঙ্গলের রাস্তা। পরেশনাথ পাহাড় এমনিতে জৈন ধর্মাবলম্বী মানুষদের তীর্থস্থান, ২৪ জন তীর্থংকরের মধ্যে ২০ জন এখানেই নির্বাণ লাভ করেছিলেন। তীর্থযাত্রীরা ওঠেন মধুবনের দিক দিয়ে, সুন্দর বাঁধানো রাস্তা ধরে। গোটা ভারতবর্ষ থেকে প্রচুর তীর্থযাত্রীরা এখানে আসেন। কিন্তু আমরা ধরলাম নিমিয়াঘাট থেকে নির্জন জঙ্গলের রাস্তা। নির্জন রাস্তা বেয়ে চারজন দৌড়চ্ছি, আশেপাশে শুধু পাখির ডাকে মন ভরিয়ে দিচ্ছে। মাত্র দু’সপ্তাহ আগেই এরকম এক জঙ্গলে ঢুকে হাতির তাড়া খেয়েছিলাম, সেই ভয়ও মাঝেমধ্যে চেপে ধরছে।
ছোটনাগপুর মালভূমির অন্তর্গত পরেশনাথ পাহাড় ঝাড়খণ্ডের উচ্চতম পাহাড়, উচ্চতা ১,৩৮৪ মিটার। আবহাওয়া ঝকঝকে থাকলে এখান থেকে নাকি মাউন্ট এভারেস্টও দেখা যায়! ছড়িয়ে থাকা নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে দৌড়নোটা বেশ চ্যালেঞ্জিং, প্রায় ১০ কিমি পেরিয়ে সবাই উঠে এলাম পরেশনাথ শৃঙ্গের মন্দিরে। তাপমাত্রার পার্থক্যটা স্পষ্ট বোঝা যায়, নিচের থেকে উপরে তাপমাত্রা বেশ কম। চারিদিকে বহু দূর দূর অবধি সমতলের ক্ষেত, গ্রাম, শহর দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর সেই দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে দেয়। পরেশনাথ পাহাড়ের উপরে অনেকটা বিস্তৃত রাস্তা জুড়ে মন্দির, পুকুর, ভিউ পয়েন্ট রয়েছে। সেই অংশগুলি দৌড়তে দৌড়তে দেখে নিয়ে নেমে গেলাম মধুবনের দিকে। এরপর আবার উঠে এলাম পরেশনাথ পাহাড়ে, নেমেও গেলাম নিমিয়াঘাটের দিকে। তীর্থযাত্রীরা বা স্থানীয় লোকজন এরকম অদ্ভুত ড্রেসের লোকজন আগে দেখেনি, যারা বারেবারে এরকম উঁচু শৃঙ্গ এত দ্রুত বারেবারে উঠছে নামছে! তাই তাদের কৌতূহলও মেটাতে হচ্ছিল।
ট্রেল রানিং নতুন খেলা হিসেবে উঠে আসছে, অথচ কলকাতার কাছাকাছি কোনো পাহাড়ে প্র্যাহক্টিসের জায়গা নেই। অযোধ্যা পাহাড়ে দৌড়ের রাস্তা খুঁজে বের করতে গিয়ে হাতির তাড়া খেয়েছিলাম। হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরেশনাথ পাহাড়ই কোলকাতার ট্রেইল রানারদের নতুন গন্তব্য হয়ে উঠবে। তবে আমাদের চ্যালেঞ্জ তখনও শেষ হয়নি, দেবাঞ্জনদা ফের ৩৫০ কিমি গাড়ি ছুটিয়ে কলকাতা ফিরল রাতে। অর্থাৎ টানা প্রায় ২০ ঘণ্টা নিজের মানসিক ও শারীরিক জোর নিখুঁতভাবে ধরে রাখতে হয়েছিল, আর এভাবেই চলছিল আমাদের এল্পাইন স্টাইলে পাহাড়ে চড়ার প্রস্তুতি।