মারাদোনা-মেসির আগেই খেলার মাঠে জাদু দেখিয়েছিলেন এই বাঙালি ফুটবলার

সময়টা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক। এরিয়ান্স ক্লাবের মাঠে অনুশীলন শুরু করে দিয়েছে একঝাঁক তরুণ ফুটবলার। কড়া নজরে, ছোকরাদের প্র্যাক্টিস জরিপ করছেন প্রবাদপ্রতিম কোচ দুখিরাম মজুমদার। নতুন ফুটবলারদের মধ্যে একটি ছেলে চমৎকার। দোহারা গড়ন। গতি, স্ট্যামিনা চোখে পড়ার মতো। বল-কন্ট্রোল অসম্ভব ভালো। প্রায় ম্যাজিকের মতো প্রতিপক্ষকে কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। ছেলেটার ফুটবলবোধ অবাক করে দিল দুখিরামকে। সারা মাঠ দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা, হাজারে একজন খেলোয়াড়ের মধ্যে মেলে। ছেলেটিকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন দুখিরাম...
ছোকরার নাম সৈয়দ আব্দুস সামাদ। বাড়ি বিহারের পূর্ণিয়া। মাঠের কাছে ঘর পায়নি, তাই প্র্যাক্টিসে আসতে হামেশাই দেরি হয়। হিন্দু রক্ষণশীল পাড়া। ‘যবন মুসলমানের’ ঘর মেলে না। দুখিরাম ব্যবস্থা করলেন তৎক্ষণাৎ। সামাদ তৎক্ষণাৎ হয়ে গেল ‘সন্তোষ’। হিন্দু নামে ঘর ভাড়া পেতে আর কোনো অসুবিধায় পড়তে হল না।
মেসি-মারাদোনার আগেও গড়ের মাঠে জাদু দেখিয়েছিলেন আব্দুস সামাদ। জাদুই বটে। মাপা সেন্টার থেকে কখনো নিখুঁত ক্রসে গোল। কখনও ছ-সাতজনকে কাটিয়ে পেনাল্টি বক্সে বল পাঠানো। চামড়ার গোলকটা নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করে ফেলতে পারেন। মাঠের যেকোনো অংশ থেকেই তাঁর ভয়ঙ্কর দৌড় শুরু হয়। বুট পরা গোড়া ফুটবলাররা সামাদের পা-কে ভয় পেত। পেলে-গ্যারিঞ্চার ‘বিউটিফুল গেম’ গড়ের মাঠে দেখাচ্ছিলেন ইন্দ্রজালের রাজা।
ময়দানের তাঁবুতে সামাদ সম্পর্কে নানা গল্পকথা শোনা যায়। দুটি গল্প সবচেয়ে বিখ্যাত। সেকালে ফুটবলারদের ‘মান’ যত না ছিল, ‘মানি’ ছিল না এক্কেবারেই। অনেক খেলোয়াড়কেই ভাড়া করে নিয়ে আসা হত বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জের টুর্নামেন্টে। পৃষ্ঠপোষকতা করতেন জমিদারবাবুরা। তেমনি এক টুর্নামেন্টে ‘খেপ’ খেলতে গিয়েছেন সামাদ। প্রথমার্ধে চার গোলে হারছে টিম। এদিকে সামাদের ট্রেন লেট। সেকেন্ড হাফের শেষদিকে খেলতে নামলেন তিনি। নিমেষেই পাঁচ-ছ’জনকে কাটিয়ে গোল। পরপর পাঁচবার। খেলা শেষে অম্লানবদনে টাকা পকেটে, ফিরতি ট্রেন ধরলেন।
অন্য ঘটনাটি ইন্দোনেশিয়ায় ঘটেছিল। সর্বভারতীয় দলের হয়ে খেলছেন তিনি। খেলা চলাকালীন দু’বার শট নিলেন গোলে। প্রতিটি শট বারপোস্টে লেগে ফিরে এল। সামাদ চ্যালেঞ্জ জানালেন, “গোলপোস্টের উচ্চতা কম”। এত বড়ো কথা! অনেক ঝুটঝামেলার পর রাজি হল মাঠের কিউরেটর। ফিতে দিয়ে মেপে দেখা গেল সাধারণ উচ্চতার চেয়ে গোলপোস্ট চার ইঞ্চি নিচু।
মেন টাউন থেকে তাজহাট। তাজহাট থেকে মহামেডান ক্লাব। শেষ বয়সে রেলওয়েজের হয়ে খেলতে নেমেছিলেন। পাশে ছিলেন পুত্র, ছোটো সামাদ। পিতা-পুত্রের একই টিমে খেলার নজির কলকাতা মাঠে খুব বেশি দেখা যায় না।তাঁর খেলার বিস্তৃত বৰ্ণনা দিয়েছেন তৎকালীন এরিয়ান্স-গোলকিপার রাম ভট্টাচার্য। তিনি লিখছেন, “...সামাদ সাহেব লেফট আউটে দাঁড়িয়েই আছেন। বাবু প্লেয়ার, তাঁর কাছে বল না গেলে চেষ্টা করে বল ধরতে তিনি রাজি নন। এমন সময় একটা বল গিয়ে পড়ল সামাদের পায়ে। সেন্টার লাইনের কাছ থেকে, মাঠের বাঁদিক দিয়ে সামাদ বল নিয়ে ছুটতে লাগলেন। বিপক্ষের ইন সাইড, রাইট হাফ ব্যাক, সেন্টার হাফ, রাইট ব্যাক, লেফট ব্যাক, একের পর এক লাফিয়ে পড়তে লাগল সামাদের ওপর। কিন্ত অদ্ভুতভাবে সামাদ দু’পায়ে ট্যাকলিং করে, লাফিয়ে লাফিয়ে সরে গিয়ে আঘাত এড়িয়ে একেবারে বিপক্ষের গোলকিপারের সামনে হাজির হলেন। গোলকিপার লাফিয়ে পড়ল সামাদের পায়ের ওপর, আর ঠিক সময়েই সামাদ আস্তে আস্তে বলটাকে ঠেলে দিলেন গোলের মধ্যে গোলকিপারের নাগালের বাইরে দিয়ে। অবিশ্বাস্য গোল! সাদা গ্যালারি, সবুজ গ্যালারির সাহেব, ভারতীয় সবাই দাঁড়িয়ে উঠে নাচছে, চেঁচাচ্ছে, হাততালি দিচ্ছে এমন অপূর্ব খেলা দেখে...”।
ইউরোপীয়-ভারতীয় দলের ম্যাচে সামাদ একাধিকবার ‘বেস্টম্যান’ হয়েছেন। রামবাবুর বৰ্ণনা আসলে ‘গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি’কেই মনে করায়। সামাদ সাহেব কর্মজীবন কাটিয়েছেন স্টেশন সুপার হয়ে। দেশভাগের পর চলে গেলেন ওপার বাংলায়। পার্বতীপুরে। কেন? হয়তো কলকাতা ময়দানে, ভারতীয় ফুটবলমহল তাঁর কদর ভুলে গিয়েছিল। পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন গোষ্ঠ পাল। উপেক্ষিত সামাদ। পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতির সম্মান পেয়েছিলেন। সামাদ-পুত্র, বহুবার পীড়াপীড়ি করা সত্ত্বেও আর পশ্চিমবঙ্গে পা রাখেননি তিনি। হয়তো তাঁর মনে জমছিল অভিমান। পোড়া ভারতবর্ষ হয়তো ফুটবলমাঠে দেখেছিল তাঁর ধর্মটুকুই...
তবুও, ময়দানের আলোআঁধারিতে, গল্পকথায় রয়ে গিয়েছেন বাজিকর। ভাগ্যিস সে যুগে টেলিভিশন ছিল না। নাহলে মেসি-মারাদোনা মার্কো ভান-বাস্তেন-জর্জ বেস্টের আগে এক ভারতীয় ফুটবলারেরই নাম শুনত বিশ্ববাসী।
তথ্যঋণঃ বঙ্গদর্শন, রোর বাংলা, যুগান্তর এবং ‘দুটি নয়ন মেলে’ - রাম ভট্টাচার্য।
চিত্রঋণঃ ডেইলি স্টার।