একদৌড়ে শৃঙ্গজয়ের সময় অজ্ঞান হওয়া যাবে না

দৌড়নোর প্র্যাক্টিস শুরু করেছিলাম একদৌড়ে পাহাড়ে ওঠা নামার লক্ষ্যে। তাই, ধীরে ধীরে কীভাবে ২কিমি থেকে ১০ কিমি, ২১ কিমি, ৪২ কিমি হয়ে ৭৪ কিমিতে পৌঁছেছি, বিভিন্ন ট্রেক রুটে দৌড়েছি, আগের লেখাগুলোতে বলেছি। কিন্তু, পাহাড়ে যদি দ্রুত উঠতে যাই, আমার পার্টনার বা গাইড আমার সমান পেসে না থাকার সম্ভবনাই বেশি। তাই, এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, একাকী দ্রুত পাহাড় বেয়ে ওঠার জন্য নিজেকে তৈরি করা।
পর্বত আরোহণের নানা পদ্ধতি রয়েছে, তার মধ্যে আল্পাইন পদ্ধতি বেছে নিলাম নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য। এবার একটু বলে নেওয়া যাক,আল্পাইনিজম কী।
ইউরোপের আল্পস পর্বতমালা আরোহণের পদ্ধতিকে বলা হয় আল্পাইনিজম। আল্পস পর্বতমালা খুব বেশি উচু না হওয়ায় এবং সব চূড়োগুলোর নিচে বেস ক্যাম্পে খুব সহজেই পৌঁছনো যায় বলে পর্বোতারোহীরা নীচ থেকে একদিনেই শৃঙ্গজয় করে নেমে আসে। আল্পাইনজিমকে এক ধরনের খেলাই বলা চলে। যদিও, এর জন্য প্রয়োজন পড়ে প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার, দরকার পড়ে লম্বা প্রস্তুতির।
আমিও শুরু করলাম সেই লম্বা প্রস্তুতি। আল্পাইনজিমকে বলা হয় দশবিদ্যার খেলা, মানে দশটা খেলার সমষ্টি। দৌড়ের প্রস্তুতি শুরু করার জন্যে এরোবিক সক্ষমতা, মানে বাংলায় আমরা যাকে বলি দম, সেটি আগেই বাড়তে শুরু করেছিল। পায়ের পেশিও লম্বা যাত্রার উপযোগী হয়ে বাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু এইগুলো শুধুমাত্র শরীরের নিম্নাংশের জন্যে। আল্পাইন ক্লাইম্বিং এর জন্যে দরকার পড়ে শরীরের ঊর্দ্ধাঙ্গও। মানে কোর, কাধ, হাত থেকে আঙুল—সবারই প্রয়োজন পড়ে একইভাবে। সেইভাবেই তৈরি করতে হয়।
শুরু করলাম কৃত্রিম ওয়ালে রকক্লাইম্বিং, শুরু করলাম সাঁতার, শুরু করলাম নানাধরনের যোগাসন (স্ট্রেন্থ ট্রেনিং)। এই পর্যায়টি সোজা ছিল না। বিশেষত আমার মত চাকুরীজীবির জন্য। সকালে দু'ঘন্টা ট্রেনিং, সারাদিন অফিস করে রাতে দু-তিনঘন্টা ট্রেনিং। যথাযথ বিশ্রাম নিয়ে ফের পরের দিন... কিন্তু মাথার মধ্যে সারাক্ষণ হাতছানি দিচ্ছে হিমালয়ের সেই চুড়ো।
হিমালয়ের চুড়ো একা আরোহণের জন্য আমি এখনো প্রস্তুত নই, তাই একজন সঙ্গী থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হিমালয়ের দুর্গম কোনো প্রান্তে দুজন মিলে ক্লাইম্ব করার সাহস সবার থাকে না। থাকলেও দিনের পর দিন যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া, প্ল্যানিং করা, আরও বহু কাজ থেকে যায়। আমি সৌভাগ্যবান, ক্লাইম্ব করার জন্য পার্টনার হিসেবে পেলাম সুমন সরকারকে। ওর কথা বলেছিলাম প্রথম সান্দাকফু ফালুট দৌড়ের সময়। আমার সঙ্গে মানেভঞ্জন থেকে ফালুট টানা ১২ ঘন্টা দৌড়ে উঠেছিল। আমার মতোই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের প্রাক্তনী। খুব ভালো যোগব্যায়াম ও রকক্লাইম্বিংও করতে পারে। ওর শুধু দরকার ছিল নিয়মিত দৌড়ের মাধ্যমে এরোবিক ক্যাপাসিটি বাড়ানো।
দুজনে প্রায় প্রতিদিনই দৌড়তে বেরোতাম এবং নানা পরীক্ষা চালাতাম নিজেদের উপর। কোনোদিন হয়তো আগের রাতে ও ভোরে কিছু না খেয়েই সকালে দু'ঘন্টা দৌড়লাম, কোনোদিন বা দু'ঘন্টা মাত্র দু’চুমুক জল খেয়েই দৌড়লাম। উদ্দেশ্যে একটাই, নিজেদের সাধ্যসীমা পরীক্ষা করা, অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার আগে ঠিক কতটা কষ্ট নিতে পারি। হিমালয়ে গেলে কোনোভাবেই অজ্ঞান হওয়া যাবে না, কারণ ওখানে আমাদের উদ্ধার করার জন্য কেউ থাকবে না।
পাশাপাশি চলতে থাকলো পিক বাছাই, কোন চুড়োটা আমরা নিজেরা ক্লাইম্ব করব? একদম সোজাও নয় আবার খুব কঠিনও নয়, উচ্চতা থাকবে ৬০০০ মিটারের দিকেই। নানাকিছু দেখে ঠিক করলাম কোয়ারাং রেঞ্জের ১, ২, ২বি, ৩-- একসঙ্গে এই চারটি পিক চেষ্টা করব। কোয়ারাং ২ সুমন আগেই ক্লাইম্ব করেছে দলনেতা হিসেবে, কিন্তু তখন গাইড শেরপা আর বড় টিম ছিল।
এবারে সেই হিমালয়ের দুর্গম প্রান্তে আমরা থাকব, কেবল দুজন...
(চলবে)