No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    থিয়েটার হবে নমনীয়, বহনীয় ও সুলভ : তৃতীয় থিয়েটার ধারায় ভেবেছিলেন বাদল সরকার

    থিয়েটার হবে নমনীয়, বহনীয় ও সুলভ : তৃতীয় থিয়েটার ধারায় ভেবেছিলেন বাদল সরকার

    Story image

    হাল আমলের সাধারণ বাঙালি দর্শক আবার নতুন করে বাদল সরকারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ চলচ্চিত্রটির ব্যাপক সাফল্যের পরে। থিয়েটারের মানুষজন একটু কলার তুলে ঘুরেছেন বাদল সরকার (নাকি) তাদের লোক বলে, সগর্বে বলেছে জয় সিনেমা, জয় থিয়েটার, জয় জনতার জয়। বাদল সরকার শতবর্ষে পদার্পণ করলেন এ বছর। এখানে একটা কথা বলা জরুরি, বাদল সরকার মানে শুধু ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ আর ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ নয়। আসলে বাদল সরকারের তৃতীয় থিয়েটারের ধারণাটা কী ছিল, সেটি কেনই বা তৃতীয় থিয়েটার সেটি হয়তো অনেকেই জানেন না এখনও। আজ একটু খুঁজে দেখা যাক তৃতীয় থিয়েটার বিষয়টা আসলে কী?

    সবকিছুকে কাউন্টার করার জন্য তৈরি হল থার্ড থিয়েটার। যেখানে দর্শক এবং অভিনেতা একই আলোকবৃত্তের মধ্যে, একই তলে থাকবে, অর্থ সেখানে আলাদা করে কোনো গুরুত্ব পাবে না।

    তৃতীয় থিয়েটার (Third Theatre) খোঁজার আগে খুঁজে বার করতে হবে প্রথম এবং দ্বিতীয় থিয়েটার কোনগুলো। বাদল সরকার (Badal Sircar) প্রথম এবং দ্বিতীয় থিয়েটার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন লোকনাট্য এবং নগরকেন্দ্রিক মঞ্চনাট্যকে। তবে তাঁর মতে এই দুই ধারাতে কিছু কিছু সমস্যা ছিল। লোকনাট্য জনসাধারণের কাছে খুব সহজে পৌঁছে যেতে পারলেও সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল মূল্যবোধ প্রচারিত হত। আবার অন্যদিকে শহরের মঞ্চনাট্য প্রগতিশীল ভাবধারা মূল্যবোধ তুলে ধরলেও তা কেবলমাত্র শহরবাসী মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত দর্শকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এইখান থেকেই বাদল সরকার একটি তৃতীয় বা বিকল্প ধারা থিয়েটারের কথা বলেন এবং এই থিয়েটার কেমন হতে পারে সেই বিষয়ে তিনি একটি মতামত দেন। 

    তৃতীয় থিয়েটার হবে –

    ১) নমনীয় বা ফ্লেক্সিবল : যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবস্থায় করা যাবে
    ২) বহনীয় বা পোর্টেবেল : যা সহজে স্থানান্তরে নিয়ে যাওয়া যাবে
    ৩) সুলভ বা ইনএক্সপেন্সিভ : যা টাকার উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল নয়

    এই তিনটি কথা থেকে একটি প্রাথমিক রূপ ধারণা করা গেলেও, তৃতীয় থিয়েটার সম্পর্কে সম্পূর্ণ বোঝা সম্ভব নয়। এই প্রাথমিক দিকনির্দেশগুলি থেকে কিছু ধারণা পাওয়া গেলেও, ঠিক কোন কোন সীমাবদ্ধতা থেকে তৃতীয় থিয়েটার গড়ে উঠল এবং তৃতীয় থিয়েটারের মূল বৈশিষ্ট্য কী, তা বোঝা সম্ভব নয়। সে বিষয়ে ধারণা পেতে আমাদের দেখে নিতে হবে প্রসেনিয়ামের গঠন। 

    প্রথমেই বলা হয়েছে লোকনাট্য ফর্মের দিক থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকলেও, তার কন্টেন্টে সমস্যা আছে, আর শহরে থিয়েটারের প্রধান সমস্যা তার ফর্ম। বাদল সরকার যদিও মনে করেছিলেন ফর্ম এবং কন্টেন্টকে সেভাবে আলাদা করা যায় না, অল্টারনেটিভ থিয়েটার সার্বিকভাবে ফর্মের উপর গুরুত্ব দিলেও তৃতীয় থিয়েটার তা দেবে না, তৃতীয় বা থার্ড থিয়েটার ফর্ম এবং কন্টেন্টের মধ্যে পেণ্ডুলামের মতো দুলবে, তবে তার পরেও প্রসেনিয়াম নিয়ে কিছু কথা থেকেই যায়। 

    বাদল সরকারের তৃতীয় থিয়েটার মূলত দুই ভাবে উপস্থাপিত হয়। একটি কোনো ছোটো ইন্টিমেট স্পেসে, যেখানে হাতে গোনা কিছুজন দর্শক উপস্থিত থাকবেন, প্রত্যেক দর্শকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে, এটিকে বলা হয় অঙ্গন মঞ্চ। অন্যটি হল মুক্ত মঞ্চ।

    প্রথমত, যে কোনো থিয়েটার অডিটোরিয়ামকে দুটি ঘরে ভাগ করে নেওয়া যায়, একটি ঘরকে বলা হচ্ছে মঞ্চ, অন্য ঘরটিতে বসেছেন দর্শক। দুটি ঘরকে আরও বেশি করে আলাদা করে নেওয়ার জন্য মাঝখানে ঝোলানো হয়েছে পর্দা। মঞ্চে অভিনয় করা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এমন আচরণ করছেন যেন তাদের সামনে কোনো দর্শক উপস্থিত নেই, চলে আসছে চতুর্থ দেওয়াল বা ফোর্থ ওয়াল কনসেপ্ট। এ তো গেল একটি দিক, এবার যদি দর্শক এবং অভিনেতার তলকে ভাবা হয়, তাহলে সেটাও হচ্ছে ভিন্ন। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, অভিনেতারা থাকছেন আলোতে, দর্শকরা থাকছেন অন্ধকারে। এটা কি বিভাজন করে দেওয়া নয়? 

    ধরুন D থেকে F রো পর্যন্ত টিকিটের দাম ৩০০ টাকা। এবার যে ব্যক্তি D রো’র মাঝের সিটটি পেলেন আর যে ব্যক্তি F রো’র কোনার সিটটি পেলেন, তাদের মধ্যেও দেখার ভিন্নতা তৈরি হল, কিন্তু দুজনে একই মূল্যের টিকিট কেটেছেন। 

    এই সবকিছুকে কাউন্টার করার জন্য তৈরি হল থার্ড থিয়েটার। যেখানে দর্শক এবং অভিনেতা একই আলোকবৃত্তের মধ্যে, একই তলে থাকবে, অর্থ সেখানে আলাদা করে কোনো গুরুত্ব পাবে না। 

    বাদল সরকারের মতে থিয়েটারের মূলে আছে রিচুয়াল বা প্রথা। এখানে যে রিচুয়াল পালন করছে ও যে সেটি প্রত্যক্ষ করছে, তাদের দুজনেরই যোগদান ছিল। থিয়েটারের ক্ষেত্রেও সেটি হওয়া প্রয়োজন। বাদল সরকার এখানে একটি থিয়েটার উপস্থাপনার চারটি ভাগের কথা বলেছেন, নাটক, নাট্যায়ন, নাট্যাভিনয় ও নাট্যানুষ্ঠান। শহুরে থিয়েটারে যেন প্রথম তিনটি হয়েই থিয়েটার শেষ হয়ে যায়, নাট্যানুষ্ঠানের অর্থাৎ অভিনেতা দর্শক ইন্টারাকশনের কোন জায়গা সেখানে থাকে না। তৃতীয় থিয়েটার সেখানে নাট্যানুষ্ঠানকে গুরুত্ব দেয়। কোনো দর্শক এসে থার্ড থিয়েটারে নির্লিপ্ত ভাবে বসে থাকতে পারেন না। তিনি কখনোই ‘আমি বসে আছি আমাকে হাসাও আমাকে কাঁদাও’ এই মনোভাব নিয়ে থাকতে পারেন না। থার্ড থিয়েটারে অভিনেতাদের সঙ্গে দর্শককে একাত্ম হতেই হবে, দর্শককেও হয়ে উঠতে হবে অভিনয়ের একটি অংশ।

    বাদল সরকারের তৃতীয় থিয়েটার মূলত দুই ভাবে উপস্থাপিত হয়। একটি কোনো ছোটো ইন্টিমেট স্পেসে, যেখানে হাতে গোনা কিছুজন দর্শক উপস্থিত থাকবেন, প্রত্যেক দর্শকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে, এটিকে বলা হয় অঙ্গন মঞ্চ। অন্যটি হল মুক্ত মঞ্চ। এখানে অভিনেতারা দর্শকদের জন্য অপেক্ষা করবেন না, অভিনেতারা নিজেরাই পৌঁছে যাবেন দর্শকদের কাছে। অভিনেতারা পৌঁছে যাবেন শ্রমিকদের মাঝে, কৃষকদের মাঝে, খেটে খাওয়া মানুষদের মাঝে। সেখানে প্রত্যেক ইন্ডিভিজুয়াল দর্শকের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক তৈরি না হলেও, তৈরি হবে একটি মাস (mass)। গুরুত্ব পাবে দর্শক। 

    বাদল সরকারের এই থার্ড থিয়েটারের চিন্তাভাবনার সঙ্গে গ্রটোভস্কির ‘পুয়োর থিয়েটার’ বা বোয়ালের ‘থিয়েটার অফ দ্য অপ্রেসড’-এর কিছু ক্ষেত্রে মিল থাকলেও, এই ভারতীয় সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা একটি স্বতন্ত্র থিয়েটার দর্শন হিসেবে, থিয়েটার আন্দোলন হিসাবে, তৃতীয় থিয়েটার আগেও যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এখনও আছে, আগামীতেও থাকবে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @