দুনিয়ার যত খাপছাড়া শহর

প্রায় ১৯৫টি সার্বভৌম দেশ রয়েছে এই দুনিয়ায়। এক একটি দেশের মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার শহর। শহর বললেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাস্তার ধারে আকাশ্চুম্বী বাড়ি, বিশালাকৃতির বাজার, হোটেল, সিনেমা হল, অসংখ্য মানুষ, গাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। সরকারি-বেসরকারি যাবতীয় আফিস কাছারিগুলির অবস্থানও শহরেই। আসলে মানুষের সবরকম সুযোগ-সুবিধার কেন্দ্রস্থল হল শহর। পৃথিবীতে নামি-দামি শহরের সংখ্যা কম নয়। এছাড়া পৃথিবীতে রয়েছে এমন আশ্চর্য শহর যে কথা শুনলে সত্যি আশ্চর্য হতে হয়। সেরকম কয়েকটির কথা এখানে বলা হল।

বুড়ো মানুষদের শহর
কেবলমাত্র বয়স্ক মানুষরাই বাস করেন এই শহরে। সেখানে নেই কোনো শিশু-কিশোর-তরুণ এমনকি কোনো মধ্যবয়সি মানুষ। কমবয়সি হলে এখানে বসবাসের অনুমতি মেলে না। হ্যাঁ, ঠিক এরকমই এক শহর রয়েছে আমেরিকা মহাদেশের ফ্লোরিডা সংলগ্ন অঞ্চলে। ওই শহরটির নাম দ্য ভিলেজেস। ফ্লোরিডা ও অন্যান্য শহরের মানুষ অবসরপ্রাপ্ত জীবনে বসবাসের জন্য এখানে স্থায়ী ঠিকানা করেন। এ শহরের জনসংখ্যা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। এক লাখের বেশি বৃদ্ধ বাস করেন এই শহরে। তবে শহরে থাকার অনুমতি নেই কোনো শিশুর। এ শহরে তারা একরকম নিষিদ্ধই বলা চলে। দ্য ভিলেজেসের পরিচিতি অবশ্য কেবল এর অধিবাসীদের কারণেই নয়, ভায়াগ্রার কালোবাজারির জন্যও। প্রতি পুরুষ মাথাপিছু এখানে দশজন নারীর সঙ্গ পেয়ে থাকেন। বয়স্কদের একরকম ডিজনি ওয়ার্ল্ড বলা চলে শহরটিকে। এ শহরে রয়েছে প্রচুর গলফ খেলার মাঠ। থাকতেই হবে। বয়স্কদের শহর বলে কথা। দিনের বেশির ভাগ সময় এখানকার অধিবাসীদের কেটে যায় গলফ খেলেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গলফ খেলার মাঠটিও আছে এ শহরে। তবে কেবল গলফ খেলেই নয়, তার সঙ্গে বিভিন্ন নিষিদ্ধ ও ভয়াবহ খেলা খেলেও নিজেদের সময় কাটান এখানকার বয়স্করা।

মৃত্যু ঊপত্যকা
অন্তত ১৮৯০ সাল পর্যন্তও ওই শহরে মানুষের বসবাস ছিল। কিন্তু তারপর সেখানে আর মানুষের দেখা মিলত না-ই বলা যায়। শহরটি ক্যালিফোর্নিয়ায়, নাম কোলমা। ১৮৪৯ সালেও সরকারি হিসাব অনুসারে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ ছিল এখানে। এরপরই গোল্ড রাশ শুরু হল। সোনার খোঁজে সানফ্রান্সিসকোয় পাড়ি জমাল এই শহরের হাজার হাজার মানুষ। ফিরেও এলো একসময় তবে সঙ্গে করে নিয়ে এলো রোগের বীজ। একের পর এক মারা পড়তে লাগল মানুষ। ১৮৮০ সালের ভিতরে শহরটির ২৬টি সমাধিস্থল ভর্তি হয়ে গেল। কিছু দিন পর মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকলে শহরবাসী নতুন সমাধিস্থল তৈরি শুরু করে। কিন্তু ১৯০০ সালে সানফ্রান্সিসকো সরকার এ শহরে আর কোনো নতুন কবরস্থান তৈরি নিষিদ্ধ করে দেয়। কারণ সমাধি হিসেবে ওই পরিমাণ জমি ব্যবহার জমির অপচয় বলে চিহ্নিত করে তারা। এ ছাড়াও ওই সমাধিগুলো রোগ ছড়াচ্ছে বলেও দাবি অনেকের। কোলমায় এখন জীবিত মানুষের সংখ্যা মাত্র ১২ হাজার। প্রচুর সমাধি রয়েছে এখানে। কোলমা শহরের ৭৩ শতাংশই সমাধিতে পূর্ণ। খ্রিস্টান ধর্ম ছাড়াও ইহুদি, চীনা কিংবা অন্য ধর্মেরও।
নকল শহর
শহর আবার নকল কী করে হয়! হলেও সেটা কি সত্যিকারের শহর? হ্যাঁ, একেবারেই বাস্তব শহর, তবে সেটা অন্য একটি শহরের নকল। নাম টেমস টাউন। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এটি কোন শহরের নকল। টেমস নদীর শহর লন্ডনকে অনুকরণ করে তৈরি হয়েছে এই শহর চিন দেশের ভিতরে। যেমন চিনের অনুকরণে পৃথিবীর সব দেশেই রয়েছে ছোট-বড় নানা রকমের চায়না টাউন তেমনই ব্রিটেনের অনুকরণে আছে টেমস টাউন। কী নেই সেখানে, ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ স্থাপত্য, রাস্তা, লাল রঙের টেলিফোন বুথ থেকে শুরু করে ব্রিটেনের স্থানীয় সব ধরনের খাবার পাওয়া যায় ওই নকল শহরে। কেবলমাত্র টেমস টাউন নয়, চিন দেশে নকল শহর রয়েছে আরো একটি। টেমস টাউনের পাশাপাশি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া হলস্ট্যাটের অনুকরণের আরেকটি হলস্ট্যাট তৈরি করেছে তারা নিজেদের দেশে।
চীনের গোয়াংডং প্রদেশে তৈরি ওই শহর নির্মাণ করতে খরচ হয়েছে প্রায় ৯৪০ মিলিয়ন ডলার। অস্ট্রিয়ায় অবস্থিত আসল হলস্ট্যাটের অনুসরণে চার্চ, রাস্তা, কাঠের ঘর সবকিছুই ছবির মতো সাজানো আছে সেই শহরে।
আরও পড়ুন
লিলিপুটদের প্রাচীন গ্রাম
একটি শহর ভাগীদার দুই দেশ
কীভাবে সম্ভব এমনটা। কিন্তু ঘটনা এরকমই। আর সেকারণেই বলা। সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত বাসিংগান এম হকরহেইন নামের এই শহরটি সুইসদের হলেও জার্মানও ওই শহরের অংশীদার। মোটকথা, একটা শহর হয়েও সুবিধা নেয় দুই রাষ্ট্র। এভাবে দুটো দেশের সুবিধা পাওয়ায় সুবিধাভোগী শহর হিসেবেই পরিচিত বাসিংগান এম হকরহেইন শহরটি। মানচিত্রে বাসিংগান এম হকরহেইন শহরের মূল ভূমিটি জার্মানি থেকে পৃথক হয়েছে একটি সরু জমির কারণে। যেটা অনেক জায়গাতে ৭০০ মিটারেরও কম চওড়া। আর সুইজারল্যান্ডে তো এর অবস্থান পাকাপাকিভাবেই রয়েছে। অবাক করা ব্যাপার হলেও এটাই বাস্তব। কেবল যে দুটি দেশ এর সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে তা নয়, জার্মান ও সুইস দুটো দেশেরই আলাদা পোস্টাল কোড আছে এ শহরটির। একই ব্যাপার ঘটেছে টেলিফোন কোডের ক্ষেত্রেও। যে কোনো সমস্যায় পড়লে এখানকার মানুষ ডাকতে পারে দুটো দেশের পুলিশকেই। যদিও সুইস পুলিশ স্বাভাবিকভাবে তাড়াতাড়ি চলে আসে। এই পুরো ব্যাপারটির শুরু ১৪ শতক থেকে। অস্ট্রিয়ার বাসিংগানের লর্ড সুইজারল্যান্ডের কাছে শহরকে না দিয়ে জার্মানদের কাছেই সমর্পণ করেছিলেন। পরবর্তীতে শহরের অধিবাসীরা কী চায় সেটা নিয়ে নির্বাচন হলেও কোনো শেষ সিদ্ধান্তে আসা যায়নি এখনো।

একজন নাগরিকের শহর
এমন একটি শহরের কথা কী কল্পনা করা যায়। ভাবা গেলেও বাস্তবে কী সেটা সম্ভব। কিন্তু এটাই যে ঘটনা। পৃথিবীতে এমন একটা শিহর রয়েছে যেটার মালিক কেবল একজন। কেবল মালিকই নন, বাসিন্দাও একজন এবং নিরাপত্তাকর্মীও একজন। পৃথিবীর এই আশ্চর্যতম শহরটির নাম মনোওয়ি আর তার সবকিছুই শুধু একজন। উত্তর-পশ্চিম নেব্রাস্কাতে মনোওয়ি শহরটি তৈরি করেছিল চেক চেকোস্লাভাকিয়া থেকে দেশান্তরী হয়ে আসা মানুষরা। ১৯৩০ সালে এ শহরটির জনসংখ্যা ছিল মোট ১৫০ জন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে একটা সময় সেই সংখ্যা এসে দাঁড়ায় মাত্র দুজনে। এলসি এলার আর তার স্বামী। শত ঝামেলার মুখেও টিকে থাকেন তারা টিকে ছিলেন। তবে ২০০৪ সালে এলসির স্বামী রুডিও মারা যান। আর এলসি হয়ে পড়েন এই বিশাল শহরের একমাত্র বাসিন্দা। অনেক বছর আগে মাত্র একজন বাসিন্দাকে নিয়ে শুরু হয়েছিল গোটা শহরের কার্যক্রম। অনেকদিন পর এখনো ৭৭ বছর বয়সী এলসি এলারই এখানকার একমাত্র মানুষ হয়ে বেঁচে আছেন শহরটিতে। কীভাবে আছেন একা একা—খুব কষ্ট করে হলেও শহরের পাঠাগার থেকে শুরু করে সবকিছুরই দেখভাল করেন ওই বয়স্ক মহিলা। কারণ খানিকটা ভেঙে পড়া, খানিকটা ঘাস-পাতায় ঢাকা পড়ে যাওয়া এই অতি পরিচিত শহরটির মেয়রও যে তিনি।

ভুতুড়ে শহর
অনেক শহরের কথাই শোনা যায় কিন্তু এমন কোনো শহরের কথা কি শুনেছেন যেখানে কোনো মানুষ নেই। সেরকম এক শহর কিন্তু সত্যিই আছে। খুব দূরে কোথাও নয়, চীনের মঙ্গোলিয়ায় অবস্থিত এই মানুষহীন শহরটির নাম ওরডস। যাকে মানুষ ভুতুড়ে শহর বলতেই অভ্যস্ত। নির্মাণের সময় অবশ্য এরকম কিছু হওয়ার কথা স্বপ্নেও চিন্তা করেননি এর নির্মাতারা। সে সময় প্রায় এক মিলিয়ন মানুষের বসবাসের জন্যই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেগুলোর মাত্র দুই শতাংশ স্থানই মানুষের সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। ঘটনার সূত্রপাত আজ থেকে প্রায় ২১ বছর আগে। সে সময় কয়লা রাশ শুরু হয় মঙ্গোলিয়ায় আর ভবিষ্যতের কথা ভেবে কোটি কোটি টাকা এখানে বিনিয়োগ করেন বিনিয়োগকারীরা। তৈরি হয় বিশাল বিশাল সব দালান। হাজার হাজার ফ্ল্যাট। কিন্তু সবটাই থেমে যায় যখন মানুষ এখান থেকে চলে যায়। কেবল ফেলে রেখে যায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা দালানগুলো। চলে যায় বিনিয়োগকারীরাও। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে এখানকার প্রতি বর্গফুটের দাম নেমে আসে ১,১০০ থেকে ৪৭০ ডলারে। এরপরই শহরটা ভুতুড়ে হয়ে যায়।