No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    নবদ্বীপের ‘চাক্কু দই’ – এমন স্বাদ বিশ্বে বিরল

    নবদ্বীপের ‘চাক্কু দই’ – এমন স্বাদ বিশ্বে বিরল

    Story image

    মাছে-ভাতে বাঙালির আভিজাত্য ধরা আছে শেষ পাতে। এদিকে, শেষ ভালো যার তার সবটাই ভালো হতে বাধ্য। আর সেই শেষটা যদি হয় দই দিয়ে তাহলে সব দিক থেকেই যাকে বলে ‘জমে ক্ষীর’। অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ, ‘সবুরে মেওয়া ফলে’ অর্থাৎ ধৈর্য ধরে কোনওকিছুর জন্য অপেক্ষা করলে তার ফল হয় মিষ্টি। দই পাতার সঙ্গেও এই ধৈর্যের যোগ অনিবার্য। মিঠে দুনিয়ায় দইয়ের তাই বিশেষ কদর। তার কৌলিন্য বাধা আছে তার শ্বেত শুভ্র রঙে। অথচ, বর্ণে গন্ধে স্বাদে কোনও অংশে পিছিয়ে নেই চন্দনরঙা ক্ষীর দই। বাঙালির নবরূপকার শ্রীচৈতন্যদেব, মানবতার নতুন পাঠশালা, ভক্তিরস বিতরণ, বৃহৎতন্ত্রসারের জন্ম ইত্যাদির মতো ‘লাল দই’-ও, প্রাচ্যের ‘অক্সফোর্ড’ বলে পরিচিত নবদ্বীপের (Nabadwip) বিশেষ কীর্তি।

    সৃষ্টির পর হতে, এতকাল ধরে যে ছিল ধবধবে সাদা, সে হঠাৎ লাল হতে গেল কেন! এ প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে নবদ্বীপের পুরোনো আলাপচারিতায়। ইতিহাস তথ্য দেয় নবদ্বীপে এই লাল দইয়ের আনুমানিক জন্ম সাল বিশ শতকের তিনের দশক। তবে আবিষ্কর্তাকে কে, তা নিয়ে আছে যথেষ্ট মতভেদ। কারোর মতে ফাঁসিতলার দুই ব্যবসায়ী ভাই কালী ঘোষ (Kali Ghosh) ও হরি ঘোষই (Hari Ghosh) লাল দইয়ের জনক। আবার অনেকেই বলেন সেই সময়ের জনপ্রিয় ময়রা কালীপদ মোদক (Kalipada Modak) ওরফে কালী ময়রাই লাল দইকে সর্বজন পরিচিত করে তোলেন। উদ্ভাবক যেই হোক না কেন, তাঁরা যে প্রায় সমসাময়িক তা নিয়ে মতান্তর নেই। ভিন্নমত নেই লাল দই সৃষ্টির কারণ ও প্রণালী নিয়েও।

    জানা যায়, ঢিমে আঁচে মোষের দুধে অল্প অল্প জল দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে ফুটিয়ে দুধকে ঘন এবং লাল করে তুলতেন স্বর্গীয় কালী ঘোষ ও তাঁর ভাই হরি ঘোষ। এরপর, সেই ঘন ও লালচে রঙা দুধে তৈরি লাল ঘোল বহু মানুষের রসনা তৃপ্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত৷ এই লাল ঘোল থেকেই লাল দইয়ের পরিকল্পনার জন্ম। সুস্বাদু লালচে ঘন দুধকে ফুটিয়ে ফুটিয়ে ক্ষীর বানালে তার স্বাদ আরও বাড়বে তা তাঁরা ভালোই বুঝেছিলেন। শুরুর দিন থেকেই এই লাল দইয়ের বাজার চাহিদা তাই তুঙ্গে। কালী ঘোষ, কালীপদ মোদক প্রমুখের পাশাপাশি নবদ্বীপে নিত্যহরি ঘোষের ঐতিহ্যবাহী ‘সত্য নারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’, দেড়শো বছরের পুরোনো ‘লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ প্রভৃতি নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে স্বাদে এবং বর্ণে লাল দইয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। পুরোনো ঐতিহ্য মেনে এ কালের লাল দই প্রস্তুকারকরাও সদা তৎপর।

    কারোর মতে ফাঁসিতলার দুই ব্যবসায়ী ভাই কালী ঘোষ ও হরি ঘোষই লাল দইয়ের জনক। আবার অনেকেই বলেন সেই সময়ের জনপ্রিয় ময়রা কালীপদ মোদক ওরফে কালী ময়রাই লাল দইকে সর্বজন পরিচিত করে তোলেন।

    গরু বা মহিষের ঘন সাদা দুধ থেকে লাল দই তৈরির পদ্ধতি কিন্তু বেশ সময়সাপেক্ষ। কাঠের জ্বালে ছ-সাত ঘণ্টা ফুট দিয়ে লাল করা দুধ পরিমাণে এক তৃতীয়াংশ হওয়ার পর তা নামিয়ে বিভিন্ন মাপের মাটির ভাঁড়ে ঢেলে চট জড়ানো হয়। উনুনে কাঠের বদলে রাখা হয় কয়লার গনগনে আঁচ। সারারাত ধরে ওই আঁচের চারপাশে এরপর সাজিয়ে দেওয়া হয় ভাঁড়গুলিকে। ভোরের আলো আকাশের কপাল ছুঁতে না ছুঁতেই সারি সারি ভাঁড়ে দেখা মেলে লাল দইয়ের। কোনও কৃত্রিম রং ছাড়াই কারিগরের মুন্সিয়ানায় সাদা দুধ পরিণত হয় লাল দইয়ে। দুধ ফুটিয়ে ফুটিয়ে ক্ষীরের মতো হয়ে যায় বলে এই লাল দইকে অনেকেই পয়োধি বা ক্ষীর দইও বলেন। সবচেয়ে মজার বিষয় একটানা দশ দিন পর্যন্ত না ছোঁয়া অবস্থায় রেখে দিলে স্বাদে এবং গুণমানে একেবারে অক্ষত থাকে নবদ্বীপের বিশেষ এই সৃষ্টিটি। আর সবচেয়ে অবাক করা কাণ্ড যেটি, তা হল হাজার নাড়াচাড়া কিংবা ওলট-পালটেও ভাঁড় থেকে এক ফোঁটাও গড়িয়ে পড়ে না এই লাল দই।

    লাল সুন্দরীর প্রসাদ পেতে হলে রীতিমতো চাকু বা ছুরির সহায়তায় তাকে স্পর্শ করলে তবে মুখে আসে অমৃতের স্বাদ। চাকু বা ছুরি দিয়ে কেটে তুলতে হয় বলে এই দইকে অনেকে ‘চাক্কু দই’-ও বলেন। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ব্যাখ্যাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও বলে বলে ছক্কা মেরে ঘোল খাইয়ে দেয় এই লাল দই। হাজার ঝক্কি ঝামেলাতেও দিব্বি যেন মেকআপটি ঠিক থাকে এই লালচে সুন্দরীর। অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে পূজা-পার্বণ সবেতেই নবদ্বীপের গর্ব এই লাল দইয়ের দরাজ উপস্থিতি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজকাল বাড়ি বসেও দিব্যি অনলাইন মারফত মিলতে পারে এই লোভনীয় লাল দই। আর তারপর! চোখ বুজে শুধুই অমৃত ভক্ষণ।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @